নোংরা পরিবেশে থেকে আর শুধু ডিম খেয়ে জীবন পার করা রেনেসাঁর প্রতিভাবান চিত্রশিল্পী
রেনেসাঁ যুগের ফ্লোরেন্টাইন শিল্পী পিয়েরো দি কোসিমো (১৪৬২-১৫২২) ছিলেন অদ্ভুত এক মানুষ। ডিম ছিল তার একমাত্র খাদ্য। তিনি একেবারে ৫০ টি ডিম সিদ্ধ করে রাখতেন। এবং যেই পানিতে ডিম সিদ্ধ করতেন, তার মধ্যেই ছবি আঁকার জন্য আঠা বানাতেন। বসবাস করতেন অপরিষ্কার, নোংরা ঘরে। আতঙ্কিত হতেন বজ্রপাতের শব্দে, উচ্চস্বরে কাশির শব্দে এবং স্লোগানের আওয়াজে। অসুস্থ রোগীদের ফেলে যাওয়া থুথু কাশির দাগগুলোতে দেখতে পেতেন শহর, প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং যুদ্ধ। এখান থেকেই ছবি আঁকার বিষয়বস্তু খুঁজে পেতেন তিনি।
জর্জিও ভাসারির মতে, কোসিমো তার জীবনের শেষে এসে এতোটাই অদ্ভুত এবং পাগল হয়ে গিয়েছিলেন যে তাকে তাকে সুস্থ করা একেবারেই অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
তবে রাটগার্স এর শিল্প ইতিহাসের অধ্যাপক সারাহ ব্লেক ম্যাকহ্যামের বর্ণনা থেকে পাওয়া যায় এক ভিন্ন পিয়েরোকে। তার তথ্যবহুল গবেষণাপত্র "পিয়েরো ডি কোসিমো" থেকে জানা যায়, সে সময়কার বতিচেল্লি, লিওনার্দো এবং মাইকেল্যাঞ্জেলোর সমকক্ষ হওয়া সত্ত্বেও রেনেসাঁর ইতিহাসে শিল্পী হিসেবে পিয়েরোকে খুব কম মানুষই মনে রেখেছে।
পিয়েরো দি লরেঞ্জো নামেই এক কামারের ঘরে জন্ম এই শিল্পীর। তাঁর 'কোসিমো" পদবিটি তিনি পেয়েছেন শিল্পী কোসিমো রোজেল্লির কাছে শিক্ষানবিশ হিসেবে থাকাকালে। তাঁর জীবনের অদ্ভুত গল্পের বাইরে তিনি বেশ প্রতিষ্ঠিত শিল্পী ছিলেন। শিক্ষানবিশ থাকা অবস্থায় রোজেল্লির সাথে তিনি ছবি আঁকেন সিসটিন চ্যাপেলে। এটি ছিল তার শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য সবচেয়ে বড় ধাপ।
তিনি ধনাঢ্য অভিজাত শ্রেণির বাড়ি সাজাতে বিভিন্ন গ্রিক এবং রোমান পৌরাণিক গল্প ছবির মাধ্যমে বাস্তবে ফুটিয়ে তুলতেন। এই কারণেই তাদের কাছে এই শিল্পী ছিলেন সবচেয়ে জনপ্রিয়। তাঁর খামখেয়ালি আচরণ এবং ছবিতে নিখুঁতভাবে সবকিছু তুলে ধরার বিষয়টি তাকে অনন্য এক স্থান দিয়েছিল পৃষ্ঠপোষকদের কাছে।
তার এই সাফল্যের পরও রেনেসাঁর শিল্পী হিসেবে মনে রাখা হয়নি তাকে। ১৯৪৬ সালে রবার্ট ল্যাংটন ডগলাসের এক প্রবন্ধের মাধ্যমে প্রথমবারের মত নজরে আসেন পিয়েরো।
২০১৪ সালে প্রথমবারের মত আমেরিকার ন্যাশনাল গ্যালারি অব আর্টে প্রদর্শিত হয়েছিল পিয়েরোর ছবি। যদিও প্রাতিষ্ঠানিক এবং অ্যাকাডেমিক অর্জনই সব নয়, তিনি আরো অনেকের প্রিয় ছিলেন। "রমোলা" উপন্যাসে রেনেসাঁ যুগের ফ্লোরেন্সের বর্ণনায় পিয়েরোকে চরিত্র হিসেবে দেখিয়েছেন জর্জ এলিয়ট। ১৯৩০-এর দশকে পরাবাস্তববাদীরা পিয়েরোকে তাদের অদ্ভুত পূর্বপুরুষ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছে।
ব্লেক ম্যাকহামের বই বিগত কয়েক বছরে পিয়েরোর কাজকে পুনরায় জীবিত করার পেছনে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে। পিয়েরোর ছবিতে ধর্ম নিরপেক্ষ পুরাণের গল্প, প্রতিকৃতি এবং ব্যক্তিগত ভক্তিমূলক চিত্রকর্ম সহ অনেক কিছু জায়গা করে নিলেও তাঁর অধিকাংশ কাজে সময়ের উল্লেখ না থাকায় তাঁর কাজের পরিবর্তনের ব্যাপারে এখনো স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়নি।
ব্লেক ম্যাকহামের হাত ধরেই পিয়েরোর প্রতিভা উন্মোচিত হয়েছে আমাদের কাছে। পিয়েরোর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও তাঁর কাজের ধারা ছিল অনেক বেশি সুসজ্জিত। তার চিত্রকর্মে পুরাণের গল্প উঠে এসেছে নতুন মোড়কে। তার "রিটার্ন ফ্রম দ্য হান্ট" এবং "ফরেস্ট ফায়ার" ছবিতে আদিম মানুষের বর্বর জীবনধারণের চিত্র উঠে এসেছে যা রেনেসাঁ যুগেও ছিল বেশ ভিন্নধর্মী। তার এসব কাজের অনুপ্রেরণা ছিল লুক্রেটিয়াস, ভিট্রুভিয়াস, প্লিনি এবং বোকাচ্চিও।
ব্লেক ম্যাকহামের বর্ণনায় উঠে এসেছে পিয়েরোর কাজের ধরন। তার ধর্মীয় কাজগুলো বেশ জটিল কাজ হিসেবেই ধরা হয়। গির্জায় আঁকা বাইবেলের একটি ধারাবাহিক গল্প "ভিজিটেশন অব বারী এন্ড অ্যান্থনি অ্যাবট" কাজটি যতটা ধর্মীয় তার থেকেও বেশি পরীক্ষামূলক।
পিয়েরোর ছবির পটভূমি, বতিচেল্লি থেকে লিওনার্দোর মত শিল্পীদের সাথে তার সম্পর্ক সবই উঠে এসেছে ব্লেকের এই বইয়ে। তার বইয়ে পিয়েরো প্রচলিত নিয়মের বাইরের হলেও উদ্ভট নয়, খেয়ালি বা স্বকীয় হলেও অদ্ভুত নয়। বাস্তব জীবনে তার অস্বাভাবিকতা, তার নরভূক সমবন্ধীয় ছবি, বিধর্মিতার প্রতি তাঁর আগ্রহ তাকে প্রচলিত ডিম-খাদক প্রতিকৃতি থেকে আলাদা করে দেখায়।
এই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে, রেনেসাঁ যুগের প্রতিভাবান চিত্রশিল্পী পিয়েরোর জীবনী রচনা করতে চাইলে তাঁর এবং তাঁর চিত্রশৈলীর ধারা নিয়ে আরো গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।