মৃতপ্রায় সিনেমা হল, তারপরও কেন হল মালিকেরা সরকারি সহজ শর্তের ঋণ নিচ্ছেন না
তিন বছর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোভিড-১৯-এর ধাক্কা কাটিয়ে উঠে নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে দেশীয় সিনেমা হল মালিকদের জন্য এক হাজার কোটি টাকার তহবিল থেকে স্বল্প সুদে ঋণসুবিধা চালু করেছিল। কিন্তু এখনো এ তহবিলের বেশিরভাগ অর্থই অলস পড়ে আছে। কেবল ১৮ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংক।
হল মালিকদের কাছ থেকে একদমই সাড়া না পেয়ে ২০২২ সাল থেকে বারবার ঋণ নেওয়ার সময়সীমা বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সর্বশেষ এ মাসের শুরুতে সময় বাড়ানো হয়। ফলে এ বছরের শেষ সময় পর্যন্ত ঋণ নিতে পারবেন হল মালিকেরা।
সিনেমা শিল্পের টিকে থাকা ও ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য আর্থিক সহায়তার দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে এই ঋণ প্রকল্প নেওয়া হয়। এর আওতায় নতুন সিনেমা হল স্থাপনের জন্য উদ্যোক্তারা ১০ কোটি টাকা ঋণ নিতে পারবেন। আর বিদ্যমান মালিকেরা তাদের হল সংস্কারের জন্য ঋণ পাবেন পাঁচ কোটি টাকা।
শপিং মলের মালিকেরাও সিনেমা হল নির্মাণের জন্য এ ঋণ নিতে পারবেন। এক বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ আট বছরে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এই ঋণের সুদের হার মেট্রোপলিটন এলাকায় ৫ শতাংশ এবং তার বাইরে সাড়ে ৪ শতাংশ।
কিন্তু এত সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও হল মালিকেরা কেন এ ঋণ নিচ্ছেন না? ঢাকার মধুমিতা হলের মালিক ইফতেখারুদ্দিন নওশাদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ঋণ নিয়ে কী করব? ভালো কোনো ছবি নেই।'
তিনি বলেন, ভালো গল্প হলে মানুষ সিনেমা দেখে। তাছাড়া ওটিটি প্ল্যাটফর্মে এখন সব সিনেমা পাওয়া যায়; অনেকে সেখানেই সিনেমা দেখে।
এইতো দুই দশক আগেও বিনোদনের জন্য সিনেমা হলে হুমড়ি খেয়ে পড়ত সাধারণ মানুষ। সারাদেশেই দর্শকচাহিদার ভিত্তিতে ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে সিনেমা হল। এতে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হন প্রযোজকেরাও। ফলে তৈরি হয় সুন্দর-সাবলীল গল্পের এবং দক্ষ ও চাহিদাসম্পন্ন শিল্পীদের অভিনীত অনেক সিনেমা।
তখন সিনেমার টিকিটও ছিল সরকারের রাজস্বের একটি ভালো উৎস। অনেকে হয়তো এখনও মনে করতে পারবেন — হলে বিক্রি হওয়া প্রতিটি টিকিট থেকে 'যমুনা সেতু সারচার্জ' কাটা হতো — এর মাধ্যমে ৯০-এর দশকের চলচ্চিত্র দর্শকেরা দেশের বড় প্রকল্পগুলোর অংশ হয়ে ওঠেন। এখনও সাড়ে ৫০০ টাকার টিকিটে ভ্যাট এবং অন্যান্য কর কাটা হয় ২০ শতাংশ তথা ১১০ টাকা।
ম্লান হয়ে যাচ্ছে রুপালি পর্দা
একসময় ঢাকার প্রধান সিনেমা হলের অন্যতম ছিল মধুমিতা। প্রতিটি সিনেমার আগে উৎসুক দর্শকদের দীর্ঘ সারি দেখা যেত এর সামনে। তবে সহজ ঋণের বিষয়টি বিবেচনা করতে এর মালিকের অনিচ্ছাই বলে দেয় বর্তমানে কেমন সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে দেশের বিনোদনশিল্প।
করোনার সময় দেশের অনেক সিনেমা হল সপ্তাহের পর সপ্তাহ বাধ্য হয়ে বন্ধ পড়ে থাকে। তবে এটি সামগ্রিকভাবে চলচ্চিত্র শিল্পের পতনের একমাত্র কারণ ছিল না।
নওশাদ বলেন, ভালো সিনেমার অভাব সারা ইন্ডাস্ট্রিজুড়েই পরিলক্ষিত হচ্ছে। এই সমস্যাটি গত এক দশক বা তারও বেশি সময় ধরে অসংখ্য সিনেমা হল বন্ধ হওয়ার পেছনে ভূমিকা রেখেছে।
ফলে কোভিড কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর এই ঋণ হল মালিকদের কাছে বিশেষ কোনো কাজের নয় বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। অনেক সিনেমা হল ভেঙে বহুতল ভবন, বিপণিকেন্দ্র এবং গুদাম তৈরি করা হচ্ছে।
চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাবেক সভাপতি ও চন্দ্রিমা হলের মালিক কাজী শোয়েব রশীদ এ পরিস্থিতির জন্য দর্শক কমে যাওয়াকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, 'আগের তুলনায় হলে দর্শক কম। তাছাড়া এখনতো সিনেমাই হচ্ছে না। তাই সিনামা হলের আয় কমে গেছে। ফলে মালিকেরা দীর্ঘদিনের এ ব্যবসা বন্ধ করে দিচ্ছেন। অনেকে সিনেমা হল ভেঙে তৈরি করছেন বাণিজ্যিক ভবন।'
২০০০-এর দশক থেকে দর্শকের সংখ্যা কমার দরুন হলগুলো আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে শুরু করে। এতে একের পর এক হল বন্ধ হয়ে যায়। হলের জায়গায় তৈরি হয় বাণিজ্যিক ভবন বা অন্য কোনো স্থাপনা।
ফলে ২০০৩ সালে দেশের সিনেমা হলের সংখ্যা দেড় হাজার থাকলেও তা কমে বর্তমানে কেবল ২০০-এ এসে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে কেবল ৫০ থেকে ৭০টি হলে বছরজুড়ে সিনেমা দেখানো হয়। ঈদ ও অন্যান্য বিশেষ অনুষ্ঠানে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫০-এর কাছাকাছি।
ঋণ সহজ, তবে নেই গ্রহীতা
২০১০ সাল থেকেই চলচ্চিত্র এবং সংশ্লিষ্ট ব্যবসাকে শিল্প খাত হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জোরালো হতে শুরু করে। এই দাবিতে সাড়া দিয়ে সরকার ২০১২ সালে ফিল্ম সেক্টরকে আনুষ্ঠানিকভাবে শিল্প খাতের মর্যাদা দিলে অন্যান্য শিল্প খাতের মতো সমান সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার সুযোগ হয় সিনেমা শিল্পের।
মহামারির ধাক্কার মুখে পড়া হল মালিকদেরসহ সার্বিকভাবে সিনেমা শিল্পকে বৃহত্তর আর্থিক সহায়তা প্রদানের একটি উদ্যোগের অংশ হিসেবে ব্যাংক ঋণ আরও বেশি সহজলভ্য করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি পুনঃঅর্থায়ন প্রকল্প চালু করে।
এ পর্যন্ত এ প্রকল্পের আওতায় প্রিমিয়ার ব্যাংক ১৫ কোটি টাকা এবং ওয়ান ব্যাংক তিন কোটি টাকা বিতরণ করেছে।
প্রিমিয়ার ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী এম রিয়াজুল করিম টিবিএসকে বলেন, 'এ প্রজেক্টে খুব বেশি সাড়া নেই। যারা বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া নিয়ম মেনে আবেদন করছেন, কেবল তাদেরকেই ঋণ দেওয়া হচ্ছে। যেহেতু এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তহবিল, তাই যারা নিয়ন্ত্রক সংস্থার নীতিমালা অনুসরণ করবে না, তাদের ঋণ দেওয়া হবে না।'
তিনি বলেন, এই ঋণ কেবল সিনেমা হলের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। অন্য খাতে ব্যয় করা হলে ঋণ বিতরণকারী ব্যাংককে অতিরিক্ত ২ শতাংশ জরিমানা গুনতে হবে।
কিন্তু কেন এই ঋণ নিচ্ছেন না হল মালিকেরা? ভোলার বোরহানউদ্দিনের রাজমনি সিনেমা হলের মলিক জসিম উদ্দিন হায়দার দ্য বিজনেস স্ট্যার্ন্ডাডকে বলেন, 'নতুন করে সিনেমা হল চালুর ইচ্ছে থাকলে ঋণ নেওয়া যেত। কিন্তু আমি আর সিনেমা ব্যবসা করব না। আমার আর ইচ্ছে নেই এ ব্যবসা করার।'
বেশিরভাগ সিনেমা হল আবাসিক এবং বাণিজ্যিক উচ্চ ভবন এবং গুদামে রূপান্তরিত হয়েছে। ১৯৯০ সালে নির্মিত রাজমনি ২০২১ সালে কোভিডের সময় বন্ধ হয়ে যায়। এটি এখন রেস্টুরেন্টসহ একটি বাণিজ্যিক ভবনে রূপ নিয়েছে।
দরকার ভালো সিনেমাও
সিনেমা হল বন্ধ হলেও মানুষ সিনেমা দেখা বন্ধ করেনি। টেলিভিশন চ্যানেলে দেখার মতো সিনেমা পাচ্ছেন তারা। আর গ্রামাঞ্চলের চায়ের দোকানগুলোতে এসব সিনেমার দর্শকও রয়েছে।
আধুনিক সিনেমা হল এবং পুরোনো ভালো সিনেমা হলগুলোতেও এখনো সিনেমা দেখতে মানুষ টিকিটের লাইনে দাঁড়ান। গত বছর থেকে দেশে মুক্তি পাওয়া হিন্দি সিনেমাগুলোও বেশ দর্শক টানছে।
সাম্প্রতিক চলচ্চিত্র প্রিয়তমা দর্শকদের কাছ থেকে ভাল সাড়া পেয়েছে এবং ব্যবসাসফলও হয়েছে। তিন কোটি টাকা বিনিয়োগের এ সিনেমা আয় করেছে ৪২ কোটি টাকা।
এছাড়া কিছু সিনেমা আন্তর্জাতিক বক্স অফিসেও ভালো করছে।
পরিবেশকদের বরাত দিয়ে বাংলা মুভি ডেটাবেস জানিয়েছে, ২০২৩ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রিয়তমা, পরাণ এবং দেবীর সঙ্গে উত্তর আমেরিকার থিয়েটারগুলো থেকে এক লাখ ডলার আয়ের মাইলফলক অতিক্রম করে হাওয়া বাংলাদেশের সিনেমার তালিকায় শীর্ষস্থান অর্জন করে। এছাড়া ভারতীয় সিনেমার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে লস অ্যাঞ্জেলেসের থিয়েটারে প্রবেশ করে সুড়ঙ্গ।
ঘুরে দাঁড়ানোর আশা
তবে হলগুলোর নতুন জীবন পাওয়া নিয়ে এখনো আশা ছাড়ছেন না শিল্পসংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, মানুষকে হলমুখী করতে কেবল সহজ শর্তে ঋণ দিলেই হবে না, দরকার ভালো চিত্রনাট্য ও ভালো নির্মাণের।
বর্ষীয়ান চলচ্চিত্র নির্মাতা কাজী হায়াৎ বলেন, ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন মুখ ও ভালো নির্মাণের দরকার। তিনি মনে করেন, 'সরকারের অনুদান যদি মানসম্পন্ন চলচ্চিত্রের জন্য নতুন কাস্টিংয়ে ব্যবহার করা হয়, তবে এ শিল্প এগিয়ে যাবে এবং হলগুলো আরও আয় করবে।'
'ইন্ডাস্ট্রিতে ভালো চিত্রনাট্য এবং ভালো নির্মাণের অভাব আছে,' বলেন চিত্রনাট্যকার শাহজাহান সৌরভ।
সিনেমা হলের পরিবেশেরও এক্ষেত্রে বড় প্রভাব রয়েছে। বছরের পর বছর অবহেলার কারণে বেশিরভাগ সিনেমা হলের অভ্যন্তর গুদামের মতো দশায় পৌঁছেছে। এসব হলে নেই পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা, জীর্ণ-শীর্ণ আসনগুলো পরিণগ হয়েছে ছারপোকা ও তেলাপোকার নিরাপদ আশ্রয়ে।
হলগুলোর এমন দশার সংস্কার দরকার। অন্যদিকে চলচ্চিত্র প্রযোজক খোরশেদ আলম খসরুর মতে, আরও বেশি দর্শক পেতে চাইলে সিঙ্গেল স্ক্রিনের পরিবেশ উন্নত করতে হবে।