৩৭০ ধারা বাতিল: কাশ্মীরের ভারতভুক্তি না বিভক্তি?
‘কাশ্মীর আর বাকি ভারতের মধ্যে বিশ্বাস বা ভরসা-র যে নড়বড়ে সেতুটা ছিল, সেটাও এবার ভেঙে গেল! ভারতই যেহেতু সেই সেতুটা ভেঙে দিয়েছে – তাই এখন কাশ্মীরের রাজনৈতিক নেতৃত্বের, তা সে বিচ্ছিন্নতাবাদীরাই হোন বা মূলধারার ভারতপন্থী রাজনীতিবিদরা – তাদের এখন খুব ভেবেচিন্তে স্থির করতে হবে কাশ্মীরের ভবিষ্যত কাদের সাথে হবে'-
সম্প্রতি (৫ আগস্ট ২০১৯) ভারত সরকার সংবিধানের ৩৭০ ধারা এবং ৩৫(এ) ধারা বিলোপ করেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে এমনটাই বলেন কাশ্মীরের একজন সাধারণ নাগরিক ইরফান জাভিদ।
ভারতের সংবিধানের এই ৩৭০ ধারা একসময় মুসলিম অধ্যুষিত ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা ও স্বশাসনের অধিকার দিয়েছিল। যা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ১৯৪৭ সালের পূর্বে আর কোন ‘দেশীয় রাজ্য’ (প্রিন্সলি স্টেট) পায়নি। এই বিশেষ ধারাটি জম্মু ও কাশ্মীরকে ভারতীয় সংবিধান মেনে নেয়ার বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তি দিয়েছিল। কিন্তু এটা রদের মধ্য দিয়ে কাশ্মীরকে আবারও পরাধীনতার শৃঙ্খলে বেধে ফেলা হলো বলেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকদে র মত।
গত ৫ আগস্ট সংসদে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বিরোধীদের তুমুল বিরোধিতার মধ্যেই এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। এই মর্মে সরকারের পক্ষ থেকে জারি করা একটি বিজ্ঞপ্তিতে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোভিন্দ স্বাক্ষর করেন।
পার্লামেন্টে অমিত শাহ দাবি করেন, কাশ্মীরের আশি শতাংশ মানুষ এটি সমর্থন করে। কিন্তু সেখানকার সাধারণ মানুষ বলেছে, ‘যদি তাই হবে, সরকার মাত্র আট মিনিটের জন্য কারফিউ তুলে নিক, তারপর তারা দেখতে পাবে কীভাবে মানুষ রাস্তায় নামে প্রতিবাদ জানাতে’।
সংবিধানের এই ধারাটি বাতিল করেই ক্ষান্ত হয়নি ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার, রাজ্য থেকে লাদাখকে বের করে তৈরি করা হচ্ছে নতুন এক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল, যার কোনো বিধানসভা থাকবে না। এখন থেকে এর পরিচিতি হবে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে। দুই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল পরিচালিত হবে দুই লেফটেন্যান্ট গভর্নর দ্বারা।
এ ছাড়াও বাতিল করা হয়েছে সংবিধানের ৩৫ (এ) ধারা। এই ধারা অনুযায়ী কাশ্মীরে শুধু স্থানীয় কাশ্মীরিদের চাকরি পাওয়ার ও জমি কেনার অধিকার আছে। এটি বাতিল হওয়ায় এখন থেকে ভারতের যে কেউ কাশ্মীরে জমি কিনতে ও ব্যবসা–বাণিজ্য করতে পারবে।
কিন্তু কাশ্মীরিরা এই পদক্ষেপকে তাদের জনমিতির ওপর আঘাত বলেই বিবেচনা করছে। তাদের আশঙ্কা, যদি কাশ্মীরে বহিরাগতরা আসে এবং ব্যবসা করার সুযোগ পায় তাহলে হয়তো খুব শিগগিরই এটি মুসলিম সংখ্যালঘু অঞ্চলে পরিণত হবে। ফলে কাশ্মীর ভ্যালির প্রায় ৮০ লক্ষ মানুষ এখন পড়ে গেছে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের হাতে।
গত সত্তর বছর ধরে কাশ্মীরিরা ভেতরে ভেতরে স্বাধীনতা বা 'আজাদি'র স্বপ্ন জিইয়ে রেখেছে। তবে ভারত সরকারের এই ঘোষণা তাদের সেই দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নের ওপরে একটা বড় আঘাত বলেই তারা মনে করছে। কেন্দ্রীয় শাসকের এই অসাংবিধানিক সিদ্ধান্ত তারা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না।
৩৭০ ধারা ও এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় জম্মু-কাশ্মীর ভারত বা পাকিস্তান কারোরই অংশ ছিল না। এটা ছিল মহারাজা হরি সিং-এর স্বাধীন রাজতন্ত্র। র্যাডক্লিফের নকশা অনুযায়ী এই রাজ্যকে দুই দেশের মধ্যে বাটোয়ারা করে দেয়া সম্ভব হচ্ছিল না, এদিকে নেহেরু আর জিন্নাহ - দুজনেরই ভূস্বর্গের অধিকার চাই।
অগত্যা মাউন্টব্যাটেন গেলেন হরি সিং-এর কাছে, জিজ্ঞেস করলেন-তিনি কোন ভাগে যেতে চান। কোন সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে রাজা সোজা বেড়াতে চলে গেলেন, মানে লুকিয়ে রইলেন। ব্যস, উপমহাদেশের মাথায় খাঁড়ার মতো ঝুলে রইল কাশ্মীর ইস্যু।
এদিকে ১৯৪৭ সালের ২২শে অক্টোবর কিছু পার্বত্য দস্যু কাশ্মীর আক্রমণ করলে, রাজা হরি সিং ভারতের কাছে 'ইনস্ট্রুমেন্ট অফ অ্যাকসেশন' বা ভারতভুক্তির শর্তে সেনা সাহায্য চেয়েছিলেন। এর পরই সংবিধানের অস্থায়ী ৩৭০ নং ধারা অনুযায়ী জম্মু-কাশ্মীরকে স্বায়ত্তশাসনের বিশেষ মর্যাদা দেবার ব্যবস্থা রাখা হয়।
যার ফলে ১৯৪৯ সালে ভারতীয় সংবিধানে নতুন একটি ধারা যুক্ত হয়, যেটি ‘আর্টিকেল ৩৭০’ নামে পরিচিত। এ ধারা অনুযায়ী জম্মু ও কাশ্মীর ভারতের অংশ হলেও রাজ্যটি বিশেষ স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা পায়।
রাজ্যটির নিজস্ব সংবিধান এবং নিজস্ব একটি পতাকা হয়। এছাড়া পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা এবং যোগাযোগ ছাড়া বাকি সব বিষয়ে রাজ্য সরকার স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার পায়। এমনকি, পার্লামেন্টে রাজ্য সরকারের সহমত ছাড়া কেন্দ্র সরকার জম্মু ও কাশ্মীরে কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারত না।
তখন এ ব্যাপারে ভারতের বক্তব্য ছিল, এই ভারতভুক্তির বিষয়টি কোনো একজন শাসকের মতামতের ভিত্তিতে স্থির হতে পারে না, এর জন্য সে জায়গার অধিবাসীদের মতামত নেওয়া প্রয়োজন।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন বলেছিলেন, ‘আমার সরকার মনে করে, কাশ্মীর আক্রমণকারীদের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার অব্যবহিত পরেই সে রাজ্যের ভারতভুক্তির বিষয়টি রাজ্যের অধিবাসীদের দ্বারা স্থিরকৃত হওয়া উচিত।’
কাশ্মীরের ভারতভুক্তি যে সাময়িক সিদ্ধান্ত, তা ১৯৪৮ সালে জম্মু-কাশ্মীর সম্পর্কিত শ্বেতপত্রে ঘোষণা করে ভারত সরকার।১৯৪৯ সালের ১৭ মে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, সরদার বল্লভভাই প্যাটেল এবং এন গোপালস্বামী আয়েঙ্গারের সম্মতিক্রমে জম্মু-কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাকে একটি চিঠি লেখেন। সে চিঠিতে বলা হয়, ভারত সরকারের স্থির সিদ্ধান্ত হলো জম্মু-কাশ্মীরের সংবিধান সে রাজ্যের অধিবাসীদের নিয়ন্ত্রণের বিষয়।
পরে ৩৭০ ধারার সংশ্লিষ্ট ৩৫(এ) নামক আরেকটি নতুন ধারা যোগ করা হয়। এই ধারাবলে জম্মু ও কাশ্মীরের স্থায়ী বাসিন্দারা বিশেষ সুবিধার অধিকারী হন। যেমন: সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা ছাড়া অন্য রাজ্যের কেউ সেখানে স্থাবর সম্পত্তি কিনতে পারতেন না। কিনতে হলে অন্তত ১০ বছর জম্মু-কাশ্মীরে থাকতে হত। স্থায়ী বাসিন্দা ছাড়া জম্মু ও কাশ্মীরে অন্য রাজ্যের কেউ সেখানে সরকারি চাকরির আবেদন করতে পারতেন না। দিতে পারতেন না ভোটও। জম্মু ও কাশ্মীরের কোনও নারী রাজ্যের বাইরের কাউকে বিয়ে করলে তিনি সেখানকার সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হতেন । অর্থাৎ, তার সম্পত্তিতে তার আর কোনো অধিকার থাকত না। এমনকি, তার উত্তরাধিকারীরাও ওই সম্পত্তির মালিকানা বা অধিকার পেতেন না।
আর এসমস্ত কারণেই ৩৭০ ধারা কাশ্মীরিদের কাছে এতটা তাৎপর্যপূর্ণ।
এই ধারা বিলোপের মধ্য দিয়ে এখন থেকে জম্মু এবং কাশ্মীর 'ইউনিয়ন টেরিটরি' বা কেন্দ্রীয়ভাবে শাসিত রাজ্য হিসেবে পরিচালিত হবে। লাদাখ কেন্দ্রশাসিত তৃতীয় একটি এলাকা হিসেবে বিবেচিত হবে।
উল্লেখ্য, ৩৭০ ধারা শুধু কাশ্মীরের জন্য ছিল না বরং জম্মুর হিন্দু বা লাদাখের বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীরাও এই স্বীকৃতি বা অধিকার ভোগ করে আসছেন গত সত্তর বছর ধরে। আর তাছাড়া বিশেষ মর্যাদা তো ভারতের আরও নানা রাজ্যেও আছে, কিন্তু এটা শুধু মুসলিম-গরিষ্ঠ প্রদেশ বলেই এই অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে বলে কাশ্মীরিদের দাবি।
৩৭০ ধারা বাতিলের পরিপ্রেক্ষিতে কে কি বলছে?
গত ৯ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, তার সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এতে কাশ্মীরে নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। এখানে বিধানসভা থাকবে, নির্বাচন হবে, মুখ্যমন্ত্রী থাকবে, থাকবে মন্ত্রিসভাও।
ভাষণের শেষে তিনি সবাইকে আহ্বান করেন, ‘আসুন আমরা সবাই মিলে একটা নতুন জম্মু-কাশ্মীর, নতুন লাদাখ গড়ি’।
এদিকে কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি টুইট বার্তায় জানান, ‘এই সিদ্ধান্ত কার্যকরভাবে ভারতকে ঐ রাজ্যের দখলদার বাহিনী হিসেবে প্রমাণ করেছে’।
কংগ্রেস নেতা পি চিদাম্বরম বলেন, ‘সরকার যা করেছে, তা দেশ ও গণতন্ত্রের পক্ষে চরম বিপজ্জনক। এই সিদ্ধান্ত দেশকে টুকরো টুকরো করে দেওয়ার প্রথম পদক্ষেপ।’
রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ (আরএসএস) নেতা ও মুখপাত্র রাম মাধব এক টুইট করেন, ‘৩৭০ ধারা থাকুক বা না থাকুক – জম্মু ও কাশ্মীর ভারতেরই থাকবে।কিন্তু জম্মু ও কাশ্মীর যে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ তা নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই’।
ইতিহাসবিদ কিংশুক চ্যাটার্জি কিন্তু মনে করেন, ‘৩৭০ ধারার ভিত্তি নিহিত আছে ভারতের সঙ্গে কাশ্মীরের সংযুক্তিকরণের ইতিহাসে, ফলে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার চেষ্টা মোটেই সহজ নয়। ইনস্ট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেসন বা ভারত-ভুক্তিতে সই করেছিল কাশ্মীর ও ভারতের সরকার, দুটো স্বাধীন স্বতন্ত্র সত্তা – তার মাধ্যমেই কাশ্মীর ভারতে সংযুক্ত হয়েছিল। যে শর্তের ভিত্তিতে সেই চুক্তি সই হয়েছিল, ভারত সরকার একতরফাভাবে বলতে পারে না যে পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়েছে, তাই সেই শর্তগুলো আবার নতুন করে বিবেচনা করা উচিৎ’।
দিল্লি ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক উজ্জ্বল কুমার সিং বিদেশি গণমাধ্যমের সাথে এক সাক্ষাতকারে বলেন, ‘সাংবিধানিক দৃষ্টিকোণে পার্লামেন্টে সাধারণ গরিষ্ঠতা থাকলেই কিন্তু সরকার একটা রাজ্যকে ভেঙে দুই বা তিন টুকরো করতে পারে। কিন্তু কাশ্মীরের ক্ষেত্রে বিষয়টা তো আইনি সিদ্ধান্ত নয়, একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত’।
কাশ্মীর ইউনিভার্সিটির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মুদাসসর নাজির গণমাধ্যমকে বলেন, ‘দেশভাগের আগে কাশ্মীর স্বতন্ত্র ও স্বাধীন মুলুক ছিল । ১৯৪৭ এর পর সেই দেশকেই ভারত আর পাকিস্তান আধাআধি ভাগ করে নিল। আর ভারত যে শর্তে কাশ্মীরকে নিয়েছিল তারই ভিত্তি ছিল এই ৩৭০ ধারা। তবে কি সেই আমলের ভারতীয় নেতারা দেশদ্রোহী ছিলেন?’
সরকারের কাশ্মীরবিষয়ক উপদেষ্টা এবং ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক প্রধান এ এস দৌলত বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আকস্মিকভাবে ক্ষমতা ব্যবহার করে যদি নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করেন, তবে দীর্ঘ মেয়াদে সহিংসতা ঠেকানো কঠিন হবে। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে এবং এর মধ্য দিয়ে সহিংসতা বাড়বে’।
সংযত থাকার আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের
কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত ও পাকিস্তানকে শান্তি বজায় রাখতে ও সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে কাশ্মীরের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে না বলে জানিয়েছে দেশটি।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র মরগ্যান ওরটেগাস বলেন, ‘এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি হচ্ছে, কাশ্মীর ভারত ও পাকিস্তানের দ্বিপক্ষীয় ইস্যু। এ ইস্যুতে শান্তি রক্ষা এবং আলোচনার সুযোগ তৈরিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টি নির্ভর করছে দুই দেশের ওপর। তবে যুক্তরাষ্ট্র চায় কাশ্মীর ইস্যুতে দুই দেশ আলোচনায় বসুক।’
জাতিসংঘ মহাসচিবের পরামর্শ
কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত ও পাকিস্তানকে ‘সর্বোচ্চ সংযম’ দেখানোর আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। একই সঙ্গে এই ইস্যুতে তৃতীয় পক্ষের নাক গলানোর বিষয়ে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ব্যাপারে ১৯৭২ সালের শিমলা চুক্তি সমুন্নত রাখতে বলেছেন। ওই চুক্তিতে জম্মু ও কাশ্মীরের চূড়ান্ত অবস্থা শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের কথা বলা আছে।
ভারতের ‘বেআইনি সিদ্ধান্তে’ ইমরান খানের বক্তব্য
৩৭০ ধারা বাতিলে ভারতের এমন সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেন, ‘ভারতের এই বেআইনি সিদ্ধান্তের ফলে আঞ্চলিক শান্তি, সম্প্রীতি ও নিরাপত্তা নষ্ট হবে।’
১৪ আগস্ট এক টুইটারে ইমরান লিখেছেন, ‘কারফিউ, কঠোর বিধিনিষেধ, এবং ভারত-অধিকৃত কাশ্মীরে আসন্ন গণহত্যা আরএসএস-এর (রাষ্ট্রীয় স্বয়ং-সেবক সংঘ) আদর্শ, যে আদর্শ নাৎসিদের আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত। জাতিগত শুদ্ধির মাধ্যমে কাশ্মীরের জনসংখ্যার অনুপাত বদলের চেষ্টা চলছে’।
ইতোমধ্যে পাকিস্তান ভারতের রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করেছে এবং ভারত থেকে তাদের রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
১৬ আগস্ট ২০১৯ চীনের উদ্যোগে আর পাকিস্তানের আহ্বানে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়।
বৈঠক শেষে চীন বলেছে, কাশ্মীর বিষয়ে ভারত বা পাকিস্তানের একতরফাভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত হবে না। বৈঠকের পর চীন ছাড়া আর কোনো দেশ এ বিষয়ে কোনো কথা বলেনি। ওদিকে, রাশিয়া বৈঠকে যোগ দেওয়ার আগে বলেছে, কাশ্মীর ইস্যু ভারত-পাকিস্তানের দ্বিপক্ষীয় বিষয়।
ফলে কাশ্মীর ইস্যুতে এই বৈঠক এখনও পর্যন্ত কোন ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনতে পারেনি।
এর আগে ভারত, ১৯৭২ সালের ‘শিমলা চুক্তি’ ও ১৯৯৯ সালে নওয়াজ শরীফ ও অটল বিহারি বাজপেয়ী কর্তৃক স্বাক্ষরিত ‘লাহোর ডিক্লারেশন’ এর মাধ্যমে কাশ্মীর ইস্যুটাকে দ্বিপাক্ষিক ইস্যু বলেই চিহ্নিত করেছে। তাই এটা নিয়ে আন্তর্জাতিক ফোরামে আলোচনার কোন অবকাশ নেই বলে বিবৃতি দেয় দেশটি।
কিন্তু এখন এই দ্বিপাক্ষিক সমঝোতারও কতটুকু অবকাশ আছে, তাতে সন্দেহ আছে। ইতোমধ্যে জম্মু-কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনার বিষয়টি নাকচ করে দিয়েছে ভারত। গতকাল রবিবার (১৮ আগস্ট) ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেন, জম্মু-কাশ্মীর নিয়ে নয়, আজাদ কাশ্মীর নিয়ে আলোচনা হলে ভারত সেখানে অংশ নেবে।
অন্যদিকে মুসলিম বিশ্বও এ নিয়ে প্রায় নিশ্চুপ। তাই আপাতত বাস্তবতা হলো, কাশ্মীর ইস্যু আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বেগ তৈরি করতে পারছে না। আর এই উদ্বেগ তৈরি না হওয়াটাও দুঃখজনক বলেই অনেকে মনে করছেন। যদিও মোদী সরকারের ৩৭০ ধারা বাতিলের মত পদক্ষেপ ভারতের অখন্ডতা ও নিরাপত্তার জন্য ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে পারে।
কাশ্মীরিদের ভাষ্য
"ভারত ফিরে যাও, কাশ্মীর আমাদের" এমন শ্লোগান ধ্বনিত হচ্ছে কাশ্মীরের রাস্তায় রাস্তায়।
গোটা অঞ্চল থেকেই প্রথম যে কথা ভেসে আসছে তা হলো- ৩৭০ ধারা বাতিলের মধ্য দিয়ে ভারত তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে ও তাদের মনে অবিশ্বাসের বীজ বুনেছে। কেননা কাশ্মীরের মানুষকে তাদের বিশেষ অধিকার হারানোর বিষয়ে আগে থেকে জানানোই হয়নি।
কাশ্মীরের অনেকেই বিশ্বাস করেন হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপি কাশ্মীরের বাইরের মানুষদের সেখানে জমি কেনার অধিকার দিয়ে সেখানকার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যার বৈশিষ্ট্যকেই পাল্টে দিতে চায়।
কাশ্মীরে বারবার মৃত্যুর মিছিল
১৯৯০ এর ৫ জুলাই কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য কুখ্যাত আইন “আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট (এএফএসপি)”কার্যকর ঘোষণা করা হয়।এই আইনের বলে সেখানে ‘স্পেশাল অপারেশন গ্রুপ’ এর মত বিশেষ বাহিনীও আমদানী করা হয়। এসমস্ত আইনের বলে এই বাহিনীগুলো সেখানে খুন, ধর্ষণ, গুম হত্যা আর অত্যাচারের মতো কার্যক্রম চালায়। আর এ কারণে কাশ্মীর এখন বিশ্বে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অন্যতম প্রধান জায়গায় পরিণত হয়েছে।
কাশ্মীরের রাজনীতিবিদদের দাবি, ১৯৮৯ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত প্রায় লক্ষাধিক ব্যক্তি কাশ্মীরে সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বলি হয়েছে।
‘এসোসিয়েশন অব পারেন্টস অব ডিসএপিয়ার্ড পার্সন’ নামের সংগঠনের দাবি, ১৯৮৯ থেকে ২০০৬ সালের মাঝে ৮-১০ হাজার কাশ্মীরি নিখোঁজ।
সংবাদমাধ্যমগুলোর ভাষ্য অনুযায়ী, পুরো কাশ্মীর জুড়ে প্রায় ৭ হাজার কবর রয়েছে যেগুলোতে যারা শুয়ে আছে তাদের পরিচয় আজও শনাক্ত করা যায়নি।
সাউথ এশিয়া টেররিজম পোর্টাল (এসএটিপি)-র ২০১৭ সালের একটি পরিসংখ্যান বলছে, নরেন্দ্র মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত তিন বছরে জম্মু-কাশ্মীরে জঙ্গি হামলায় নিরাপত্তাকর্মীর মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে ৭২শতাংশ, নিরীহ মানুষের মৃত্যু বেড়েছে ৩৭ শতাংশ এবং জঙ্গি খতমের সংখ্যা বেড়েছে ৩২ শতাংশ।
সর্বশেষ চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারিতে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পুলওয়ামায় এক আত্মঘাতী হামলায় ভারতের আধা সামরিক বাহিনীর ৪০ জনের বেশি সদস্য নিহত হয়। এতে প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক তলানিতে এসে ঠেকে।
গত বৃহস্পতিবার (১৫ আগস্ট) জম্মু-কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখায় পাকিস্তান ও ভারতের নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে গোলাগুলিতে হতাহতের ঘটনাও ঘটে গেছে। ফলে দুই দেশের মধ্যে নতুন করে যুদ্ধ উত্তেজনা চলছে।
এসব ঘটনা থেকে বোঝাই যাচ্ছে হিমালয়ের এই ভূস্বর্গ ঘিরে কত দ্বন্দ সংঘাতের ইতিহাসই না লেখা হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষের রক্তে বারবার রঞ্জিত হয়েছে এই উপত্যকা। যা এখনও বিদ্যমান। তারা এখনও তাদের আজাদির লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
কেননা আজ নিজেদের শেষ অধিকারটুকু হারিয়ে ও গুলির মুখে দাঁড়িয়েও কাশ্মীরিরা দৃঢ়তার সাথে এই বার্তাই দিতে চায়, তারা নিজের রুটি ভাগ করে নিতে পারে, কিন্তু নিজের জমি, নিজের মা-কে অন্যের সঙ্গে ভাগ করতে পারবে না।
তার মানে হলো, যদি ভারতের একশো কোটি মানুষও বলে কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, আর কাশ্মীরের মানুষ সে কথা না মানে, তাহলে কিন্তু আইনি পথে বা গণতান্ত্রিক পন্থায় ভারত সরকারের দাবি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
তথ্যসূত্রঃ
উইকিপিডিয়া, বিবিসি, এশিয়া টাইমস, দি টাইমস অব ইন্ডিয়া, প্রথম আলো
‘কাশ্মীর বিতর্ক’, মৃণালকান্তি দাস
‘কাশ্মীর ও আজাদির লড়াই’, আলতাফ পারভেজ
‘Kashmir: Roots of conflicts, paths to peace’ by Sumantra Bose