দ্বাবিংশ ঢাকা চলচ্চিত্র উৎসব: প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য
দ্বাবিংশ ঢাকা চলচ্চিত্র উৎসবের পর্দা নামল এই রচনা লেখার সময়। সপ্তাহব্যাপী এই উৎসবে ১০টি বিভাগে ৭৪টি দেশের ২৫০ চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়েছে। তার মধ্যে পূর্ণদৈর্ঘ্য ১২৯টি, এবং স্বল্পদৈর্ঘ্য ও স্বাধীন চলচ্চিত্র ১২৩টি। বাংলাদেশের সব মিলে ৭১টি চলচ্চিত্র ছিল। আয়োজকেরা হয়তো স্বাধীন দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে মিলিয়ে বিষয়টি ভেবেছেন। রেইনবো ফিল্ম সোসাইটি ১৯৯৭ থেকে এই উৎসবের আয়োজন করছে। আর নারী চলচ্চিত্রকারদের কেন্দ্রে রেখে 'দশম আন্তর্জাতিক উইমেন্স ফিল্ম মেকারস কনফারেন্স' ছিল।
'নারী নির্মাতারা তাদের কাজ করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাসমূহ এবং উত্তরণের উপায় নিয়ে বিশ্বের খ্যাতিমান নারী নির্মাতাদের সাথে মতবিনিময় করবেন' — প্রথম দিনের বুলেটিনে এই সংবাদ জেনে বেশ আশা জাগে। যদিও রিপোর্টে শর্মিলা ঠাকুর কনফারেন্স উদ্বোধন করবেন এই তথ্য বাদে দেশি-বিদেশি কোন নির্মাতারা থাকবেন সেসব বলা নেই। দুই দিনের কনফারেন্সে যে ৬টি ধারণাপত্রের আলোচনা হয়েছে — তথ্যটি পার্থ সনজয় দিয়েছেন — প্রথম বুলেটিনের দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় তার শিরোনামগুলো থাকলে ভাবনার খোরাক হতো। নাতিবিখ্যাত অভিনেতা অনন্ত জলিলের 'দিন দা ডে'-এর বিশ্ববিশ্রুত পরিচালক মুর্তজা অতাশ জমজমের চলচ্চিত্র সম্ভবত জয়া আহসানের গ্ল্যামারের কারণেই উৎসবের উদ্বোধনী চলচ্চিত্র। নির্ভরযোগ্য সূত্রে প্রকাশ, চলচ্চিত্রটি নিয়ে যত কম কথা হয় ততই ভালো। অনুবাদক ও চলচ্চিত্রভাবুক আলম খোরশেদ তার লেখায় প্রজেকশনের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আগের অভিজ্ঞতা থেকে। তৃতীয় দিনের বুলেটিনে দেখলাম, শর্মিলা 'আগুনোর পরশমণি' গাইছেন। প্রথম লিডে এমন ছাপার ভুল বেদনার। চতুর্থ দিনের বুলেটিনের খবর অনুযায়ী, শঙ্খ দাশগুপ্ত জরুরী কথা বলেন — 'নারী কেন্দ্রিক', 'নারী নির্ভর' এই কথাগুলো আসলে মার্কেটিং টুল। ফেস্টিভ্যাল বুলেটিনের প্রথম পৃষ্ঠায় আয়োজনসংশ্লিষ্ট একজনের বইয়ের বিজ্ঞাপন, তাও নিজের লেখায়, দৃষ্টিকটু লেগেছে সংগঠনকে নিজের বই প্রচারের কাজে লাগানো।
সার্বিকভাবে বুলেটিনের সংবাদ পরিবেশনের মান সন্তোষজনক নয়। রিপোর্টে আরেকটু বেশি তথ্য পরিবেশিত হলে ভালো হতো। তবে চলচ্চিত্র সাহিত্যিক বিধান রিবেরুর প্রতিদিনকার তথ্যসমৃদ্ধ লেখা বুলেটিনের মান রক্ষা করেছে। আয়োজকদের বোধ করি. বুলেটিনের সার্বিক লেখার মান এবং বিস্তারিত সংবাদ পরিবেশনের দিকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। প্রয়োজনে সারা দেশ থেকে চলচ্চিত্র-আগ্রহী লেখক-চিন্তকদের আমন্ত্রণ জানিয়ে একটা প্যানেল তৈরি করে বছরজুড়ে প্রস্তুতি নিলে আখেরে ভালো ফল আসবে। বন্ধু চলচ্চিত্র বিশ্লেষক আসিফ সৈকতের দেওয়া কয়েকদিনের বুলেটিনে চোখ বুলিয়ে লেখার এই অংশ বলা ভালো পাঠ প্রতিক্রিয়া লিপিবদ্ধ করলাম। জাতীয় জাদুঘরের সামনের প্রাঙ্গণে সারাদেশের নির্বাচিত চলচ্চিত্র পত্রিকাসমূহের স্টল থাকলে আয়োজনটি আরও সমৃদ্ধ হতো।
২
নিজের অভিজ্ঞতায় আসি। স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা, প্রাক্তন ক্রীড়া সাংবাদিক বন্ধু তৌহিদ রিয়াদ আমাদের দুজনের জন্য উৎসবের দিনব্যাপী মাস্টারক্লাসের রেজিস্ট্রেশন করেন। জনপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা যদিও ছাত্রদের জন্য দু'হাজার। শনিবার এই মাস্টারক্লাসে উপস্থিত ছিলেন চীনের সাংহাই ফিল্ম অ্যাসোসিয়েশনের ডেপুটি চেয়ার এবং প্রযোজক ডক্টর শি চুয়ান, ইরানের খ্যাতিমান নির্মাতা মাজিদ মাজিদি এবং পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্রকার অঞ্জন দত্ত। চলচ্চিত্র আগ্রহীদের কাছে এই দুজনের বিষদ পরিচয় লাগে না বলে আমি ধারণা করি। শুক্রবার সকালে চট্টগ্রাম থেকে যাত্রা শুরু করে তিনটা নাগাদ এশিয়ান ফিল্ম কম্পিটিশনের 'গ্রীন প্লাম সিজন' দেখা শুরু করি ইরানি পরিচালক আলি বায়াতের। তিনি নিজেও উপস্থিত ছিলেন। চলচ্চিত্রের মর্মবস্তু সুন্দর, নস্টালজিক করে তোলে। তারপরেই 'চালচিত্র এখন'। গত কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে স্পেশাল জুরি পুরস্কার পাওয়া এই ছবিটি নিয়ে সকলের আগ্রহ ছিল তুঙ্গে। অঞ্জন নিজে উপস্থিত ছিলেন। মৃণাল সেনকে ভালোবাসা জানিয়ে নিজের টাকায় বানানো অঞ্জন দত্তের ছবি দেখতেই মাস্টারক্লাসের আগের দিন রাজধানীতে আসা।
দুঃখের বিষয়, প্রজেকশনের বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া হয়নি। আশপাশের আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হলাম। অঞ্জন দত্তের এই চলচ্চিত্রে মনে হলো তিনি নিজের সর্বস্ব বিনিয়োগ করেছেন। অভিনয়, পরিচালনা, প্রযোজনায় নিজের পুরোনো সকল সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে ফেলেছেন। আমরা দেখি চব্বিশ বছরের অঞ্জনের ব্যক্তিগত সংকট এবং তার মেন্টর মৃণাল সেনের পরম আশ্রয় হয়ে পাশে থাকা। এই লেখাটা লিখতে লিখতে খবর পেলাম কুণাল সেন চরিত্রে অভিনয়ের জন্য অঞ্জন দত্ত শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছেন। আমাদের কৈশোর তারুণ্য যৌবনজুড়ে থাকা মানুষটিকে অভিবাদন।
সরাসরি মাস্টারক্লাসে চলে যাই। লেমিনেটেড আইডি কার্ড ফিতে ঝোলানো, কাগজের ফোল্ডারের ভেতরে একটি পত্রিকা, অতি ক্ষুদ্র নোট খাতা এবং একটি কম দামি কলম — এই হলো উৎসব কর্তৃপক্ষের তরফে নিবন্ধিত অংশগ্রহণকারীদের দেওয়া ম্যাটেরিয়াল। আপত্তি ছিল না, কিন্তু আমাকে বলুন তো, উৎসব পরিচালক সম্পাদিত 'সেলুলয়েড 'সিনেমা পত্রিকার জুলাই '২৩-এর সংখ্যা দিয়ে আমি জানুয়ারি '২৪ -এ কী করব? কনটেন্ট ও যাকে বলে 'আপ টু দ্য মার্ক 'নয়।
প্রথম ক্লাস ছিল শি চুয়ানের সঙ্গে। তিনি চৈনিক সাম্প্রতিক চলচ্চিত্রের বিশিষ্ট লোক, রীতিমতো নেতৃস্থানীয়। কিন্তু উপমহাদেশের কয়েকটি জনপ্রিয় সিনেমা; 'আওয়ারা', 'থ্রি ইডিয়টস', 'স্লামডগ মিলিয়নেয়া'-এর উল্লেখ এবং কয়টি সিনেমা হল আছে তার দেশে এই আলাপ বাদে সাম্প্রতিক চৈনিক চলচ্চিত্র, তার নানা সংকট এসব নিয়ে কোনো কথা শুনলাম না। সরকারি সেন্সরশিপের প্রশ্ন এড়িয়ে গেলেন। বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের যৌথ প্রযোজনার আমোদগেঁড়ে আশাবাদ বাদে এই মাস্টারক্লাস নামের দু'ঘণ্টা থেকে ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউশনের দু-একটা জানা কথা বাদে কিছুই পাইনি।
দ্বিতীয় সেশনে মাজিদ মাজিদি বরং অনেক স্বতঃস্ফূর্ত। তাঁর থিয়েটার সংযোগ থেকে আলাপ শুরু হয়ে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করছিল। সত্যজিৎ রায় ছিলেন সেরা অনুপ্রেরণা। 'চিলড্রেন অভ হেভেন'-এর বেশিরভাগ ঘটনা নিজের জীবনের। মরমী কবিদের নিয়ে আলোচনার সূত্র ধরিয়েছিলেন সঞ্চালক বিধান রিবেরু। আলোচনাটা বেশ জমেছিল। মাজিদি জোর গলায় বলছিলেন, 'অ্যা ফিল্মমেকার অ্যাবাভ পলিটিকাল সিচুয়েশন।' রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখতে চান পরিচালককে। কিন্তু কেমন করে একজন সংবেদনসম্পন্ন মানুষ রাজনীতিরহিত হতে পারেন আমার ভাবনায় আসে না।
বন্ধু তৌহিদ রিয়াদ ইরানের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি যেমন মাশা আমিনি থেকে শুরু করে সতীর্থ পরিচালক হত্যা সম্পর্কে তাঁর মত শুনতে চাইলে তিনি 'আজকের সিনেমা আলোচনার জন্য প্রাসঙ্গিক নয়' বলে এড়িয়ে যান। আমি সম্প্রতি তাঁর ছবি দেখছিলাম ধারাক্রম মেনে। আমি প্রশ্ন করেছিলাম, প্রথম দুই ছবি, 'বাদুক' আর 'পেদার'-এ প্রোটাগনিস্ট দুই ছেলের প্রত্যেকের সঙ্গে একজন প্রায় সমবয়সি বন্ধু থাকে যে নিঃস্বার্থ বন্ধুর পাশে থাকে। এই বয়সে বন্ধুত্ব সম্পর্কে আপনি কী ভাবছেন? এ প্রশ্নের উত্তর পেলাম না। তবে তাঁর নীরবতা মনে করিয়ে দেয়, বন্ধু সম্পর্কে তাঁর এখনকার এবং সব সময়ের ভাবনা। আবার এমনও হতে পারে, এমন এক ইন্টারপ্রেটার ছিলেন যিনি সিনেমার কিছুই বোঝেন না। দূতাবাসের কাজ চালানো গোছের অনুবাদকের অবশ্য কণ্ঠখানি মধুর। সঞ্চালকের কাছ থেকে সে অর্থে নতুন কিছু তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ পাইনি ব্যক্তিগতভাবে। সম্প্রতি গাজার পরিস্থিতিতে মানুষের সাফারিং দেখে তিনি খুব আহত, মুসলিম দেশগুলোর ভূমিকা তার কাছে 'ডিজাপয়েন্টিং'। তবে একটি অদ্ভুত অনৈতিহাসিক কথা বললেন – পশ্চিমে কর্তৃক ইসলামের ভুল পোর্ট্রেয়ালের কারণেও এসব হচ্ছে। এটিই কি একমাত্র কারণ আসলে? মাজিদিকে আমার মনে হয়েছে দারুণ গল্প বলিয়ে। তবে ধর্মের নীতিনিষ্ঠতা পেরিয়ে তিনি কোথাও দর্শনে উন্নীত হতে পারেন না।
অঞ্জন দত্তের কথা আর গান শোনার জন্যই আমরা মূলত ঢাকায়। এইরকম অগোছালো, দায়সারা চলচ্চিত্র উৎসব নিয়ে আমার কোনোকালেই আগ্রহ ছিল না। অঞ্জনের জন্যেই যাওয়া। অঞ্জন দত্তের মাস্টারক্লাস খুব উপভোগ করলাম। বিশেষত প্রায় ছাব্বিশ–সাতাশ বছর অঞ্জন ও মৃণাল সেন চর্চার ফলে খুবই কমিউনিকেটিভ লাগছিল। নিজের পড়ার সঙ্গে কানেক্ট করতে পারছিলাম। সঞ্চালক খুব একটা নতুন প্রশ্ন করতে না পারলেও বৈঠকটা বেশ আন্তরিক ছিল। তৌহিদ ভাই আর আমি অতিমারির সময় অঞ্জন দত্তের প্রায় পৌনে দুই ঘণ্টা লাইভ ইন্টারভিউ করেছিলাম কেবল অভিনয় নিয়ে। উনি আমাদের মতো লোক, যাদের চেনেন না তাদের কথায় কেন এসেছিলেন আমরা জানি না, কিন্তু এসেছিলেন। ফলে তাঁকে সামগ্রিকভাবে জানা আমাদের খানিকটা বেশি। কিন্তু একেবারেই নতুন প্রজন্মের কমবয়সিরা নিশ্চয়ই খুব উপভোগ করেছেন। 'অভিনেতা সংলাপ ছাড়া যা করে তা-ই তা কাজ' — এই বাক্যটি অনেকদিন মনে থাকবে। আমি প্রশ্ন করেছিলাম তাঁর পাঠ-অভ্যাস নিয়ে। ছোট উপন্যাস, নভেলেটের প্রসঙ্গ তুললেন। 'ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি', 'দ্য আউটসাইডার'। ছোট উপন্যাসের ফর্মটা ভালোবাসেন জানালেন।
প্রায় এক ঘণ্টার গানের অনুষ্ঠানে দুটি নতুন গান গাইলেন। সারাদিনের ক্লান্তি, নানা প্রশ্ন ও তর্কের ঝোঁক চোখের জলে ভেসে গেল। মনে পড়ছিল মৃত বন্ধুদের মুখ, যাদের অঞ্জনদার প্রতি ভালোবাসা ছিল, কোনোদিন দেখার সুযোগ পায়নি সামনে বসে। অঞ্জন সিনেমা বানান মাথা দিয়ে আর গান করেন হৃদয়ের ভেতর থেকে। শেষ করার আগে একটাই কথা বলার, আয়োজকদের তরফে মাস্টারক্লাসে নিবন্ধিতদের জন্য এই টানা প্রায় ৮ ঘণ্টার বসে থাকায় এক চুমুক জলের ব্যবস্থাও ছিল না।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।