ইসরায়েলি বোমা হামলা ও নিষেধাজ্ঞার মধ্যে গাজার ক্যান্সার রোগীরা যেভাবে টিকে আছে
ক্যান্সার নির্ণয় এবং এর দীর্ঘ চিকিৎসা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যাওয়া স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেই একটি ভীতিকর ব্যাপার। আর যদি পরিস্থিতি হয় যুদ্ধের, যেখানে অবিরত বোমা বর্ষণ চলছেই, যেখানে নিজ ঘরে পর্যন্ত কেউ নিরাপদ নন, সেখানে একজন ক্যান্সার রোগীর কাছে হয়ত এটি অগ্নিপরীক্ষার মতোই কোনো ব্যাপার হবে।
প্রায় চার মাস ধরে চলা ইসরায়েলের নির্বিচার বোমা হামলায় গাজার প্রায় ২০ লাখ বাসিন্দা বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। এই সময়ে গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছানোয় কঠোর বিধি-নিষেধের কারণে বাস্তুচ্যুত এসব মানুষ সামান্য মৌলিক অধিকারটুকুও পাচ্ছেন না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) মতে, গাজার ৩৬টি হাসপাতালের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ হাসপাতালেই যুদ্ধের কারণে চিকিৎসা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। আংশিকভাবে চালু রয়েছে মাত্র ১৩টি হাসপাতাল। এসব হাসপাতালে এখন রোগীর সংখ্যা ধারণক্ষমতার চেয়েও কয়েক গুণ বেশি।
এই পরিস্থিতি ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোর ধ্বংস, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ ও থেরাপি ব্যবস্থার অভাব এখন ক্যান্সার রোগীদের মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
দ্য কিউরিয়াস জার্নাল অব মেডিক্যাল সায়েন্সে প্রকাশিত এক নিবন্ধে ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনের পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে এই অঞ্চলে ক্যান্সারে আক্রান্তের হার প্রতি এক লাখে ৯১.৩ জন।
মেডকেয়ার হাসপাতালের শারজাহর ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ সোহা আবদেলবাকি আরব নিউজকে বলেন, 'সংঘাত যখন দীর্ঘায়িত হয়, তখন পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়'।
তিনি বলেন, 'পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা গেছে, সংঘাতরত এলাকার ক্যান্সার রোগীদের ক্যান্সার শনাক্ত হয় এমন পর্যায়ে যখন সেই রোগীকে আর ভাল চিকিৎসা দেওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না। ক্যান্সার রোগীদের ক্ষেত্রে একটি দিনও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, রোগটি দ্রুত গতিতে ছড়ায়।'
দক্ষিণ ইসরায়েলে গত বছরের ৭ অক্টোবর হামলা চালায় ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। এতে এক হাজার ২০০ জন নিহত ও ২৪০ জন জিম্মি হয়। জবাবে ইসরায়েল গাজায় সামরিক অভিযান শুরু করে। যা এখনও চলছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, এ হামলায় ২৬ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি মারা গেছেন।
ইসরায়েল সরকার বলেছে, হামাস হার মেনে না নেওয়া হওয়া পর্যন্ত তারা অভিযান চালিয়ে যাবে।
ইউরো-মেড মনিটরের তথ্যমতে, দুই হাজারেরও বেশি ক্যান্সার রোগী ও আরও এক হাজারেরও বেশি রোগীর বেঁচে থাকার জন্য ডায়ালাইসিস জরুরি। এছাড়াও ৫০ হাজার কার্ডিওভাসকুলার রোগী এবং প্রায় ৬০ হাজার ডায়াবেটিস রোগীর জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন।
এমনকি হামলা শুরুর আগেও ১৬ বছর ধরে ইসরায়েলি বিধি-নিষেধের কারণে উপত্যকাটিতে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত বাসিন্দাদের স্বাস্থ্যসেবা পেতেও নানা হয়রানির শিকার হতে হয়েছে।
গত বছরের নভেম্বরে ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানায়, গাজায় ক্যান্সারের চিকিৎসা প্রদানকারী একমাত্র হাসপাতাল তুর্কি-ফিলিস্তিনি ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর থেকে চিকিৎসা পরিষেবা বন্ধ করে দিয়েছে।
এর কয়েকদিন পর জ্বালানি সংকটের কারণে হাসপাতালের চারজন রোগী মারা যান। হাসপাতালটিতে চিকিৎসাধীন ৭০ জন ক্যান্সার রোগীকে দক্ষিণ গাজার যুদ্ধ-বিধ্বস্ত খান ইউনিসের দার আল-সালাম হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
গাজায় একসময় প্রায় ২৫ হাজার ডাক্তার, নার্স এবং বিশেষজ্ঞসহ উন্নত স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু কয়েক মাসের যুদ্ধে উপত্যকাটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে।
এর ফলে যাদের ক্যান্সারের উপসর্গ রয়েছে কিংবা এ রোগে আক্রান্ত যারা দীর্ঘ চিকিৎসা ব্যবস্থার মড্য দিয়ে যাচ্ছেন, যাদের জটিল রোগ রয়েছে, তাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনাও অনেক কমে গেছে।
সাইকিয়াট্রি অ্যান্ড সাইকোসোমেটিক মেডিসিনের সহকারী অধ্যাপক এবং আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব বৈরুতের সাইকো-অনকোলজির পরিচালক মায়া বিজরি আরব নিউজকে বলেন, 'প্রাথমিক পর্যায়ে মানব দেহে ক্যান্সারের উপস্থিতি শনাক্ত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।'
স্বাস্থ্যবিষয়ক জার্নাল ক্যান্সার মেডিসিনের ২০২০ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর অস্ত্রোপচারে তিন মাস দেরি হওয়ার কারণে মৃত্যুর ঝুঁকি ২৬ শতাংশ বেড়ে যায়।
২০২২ সালের জেসিও গ্লোবাল অনকোলজির আরেকটি গবেষণায় ধারণা পাওয়া গেছে, পাঁচটি সাধারণ ধরনের ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় মাত্র চার মাস দেরির কারণে অতিরিক্ত তিন হাজার ৬০০ মানুষ মারা যেতে পারে।
ডা. মায়া বিজরি বলেন, 'চার সপ্তাহ মাত্র ৩০ দিন। গাজা যুদ্ধ এখন ১০০ দিনেরও বেশি সময় ধরে চলছে। তাই ক্যান্সার চিকিৎসা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। এটি করা না গেলে যুদ্ধের অস্ত্রের মতোই ক্যান্সারও মৃত্যুর একটি অস্ত্রে পরিণত হবে।'
ইসরায়েল গাজার স্বাস্থ্য পরিষেবাগুলোতে ইচ্ছাকৃতভাবে হামলার বিষয়টি অস্বীকার করেছে। তার দাবি, গাজার হাসপাতালের নিচে হামাসের টানেল নেটওয়ার্ক রয়েছে। হামাসের সদস্যরা আশ্রয়ের জন্য এসব হাসপাতাল ব্যবহার করছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০২২ সালে গাজার ১২২টি শিশু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিল। গাজায় তারা যৎসামান্য চিকিৎসা পেয়েছিল। কাউকে পূর্ব জেরুজালেম, মিশর, ইসরায়েল ও জর্ডানসহ পশ্চিম তীরের হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার জন্য স্থানান্তর করা হয়েছিল।
উপত্যকাটি থেকে বাইরে যেতে প্রয়োজনীয় অনুমতি পাওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট বেগ পেতে হয় এর বাসিন্দাদের। ক্যান্সার রোগীদের উন্নত চিকিৎসা পাওয়ার ক্ষেত্রে এটিও একটি বাধা।
যুদ্ধ শুরুর আগে উন্নত চিকিৎসার জন্য গাজার বাইরে যেতে ইসরায়েলের কাছে বছরে ২০ হাজারটি আবেদন জমা পড়ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০২২ সালে ইসরায়েল মাত্র ৬৩ শতাংশ আবেদনের অনুমোদন দিয়েছিল।
যুদ্ধ-বিদ্ধস্ত গাজায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে চিকিৎসা সেবা। সীমিত সংখ্যক চিকিৎসক ও নার্সরা রোগীর ঢেউ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। এ অবস্থায় গাজায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা জোরদারে দক্ষ চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো জরুরি।
যুদ্ধের সময় চিকিৎসায় দেরি হওয়ার কারণে ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে পারেন।
ডা. আবদেলবাকির মতে, সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে ক্যান্সারের চিকিৎসা নিচ্ছেন এমন ব্যক্তিরাও উচ্চ মাত্রায় ভয়, উদ্বেগ ও যন্ত্রণা অনুভব করেন। এটি রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা ইত্যাদির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।এমনকি চলমান যুদ্ধ শেষ হলেও ক্যান্সার রোগীদের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি শীঘ্রই উন্নতি হবে বলেও আশা করা যাচ্ছে না।
যুদ্ধবিরতি না হলে এবং সহায়তা প্রদানকারী সংস্থাগুলোকে গাজায় পর্যাপ্ত প্রবেশাধিকার না দেওয়া হলে, ক্যান্সারের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত রোগীদের জন্য কোনো সুখবর নেই বললেই চলে।