যে ‘পাজল’ ৯৯ শতাংশ মানুষ সমাধান করতে পারে না, তার নেপথ্য কারিগর কে!
রুবিকস কিউব। সব ভাষা, বয়স, স্থান-কালের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বব্যাপী তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে উজ্জ্বল আইকনিক ডিজাইনের 'রং মেলানো' এই পাজল গেমটি। এই গেম খেলার জন্য লাগে না কোনো নির্দেশনা বা প্রশিক্ষণ। যেকোনো জায়গাতেই এ কিউব পকেটে নিয়ে ঘোরা যায়। অগণিত উপায়ে সমাধান করা যায় এই রুবিকস কিউব। এ সবই রুবিকস কিউবের তুমুল জনপ্রিয়তা এবং এর 'বেস্ট-সেলিং' হওয়ার মূল কারণ। বিবিসি অবলম্বনে।
রং মেলানোর অসাধারণ এই পাজল গেমটি আবিষ্কারের পর এরনো রুবিক ধারণাও করতে পারেনি কী যুগান্তকারী আবিষ্কার করে বসেছেন তিনি।
১৯৮৬ সালে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এরনো রুবিক বলেছিলেন, এই কিউব যে এতটা সফলতা পাবে এবং তাকে জগৎজোড়া খ্যাতি এনে দেবে—তা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি।
রুবিক আসলে এই কিউব খেলনা হিসেবে নয়, বানিয়েছিলেন তার ছাত্র-ছাত্রীদের শেখানোর উপকরণ হিসেবে।
১৯৭৪ সালে তিনি 'বুদাপেস্ট কলেজ অভ অ্যাপ্লাইড আর্টস'-এ স্থাপত্যবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন তার ছাত্র-ছাত্রীরা খেলার ছলে জ্যামিতিক ও স্থানিক সম্পর্কগুলো নিয়ে সৃজনশীলভাবে চিন্তা করতে শিখবে। এই সম্পর্কগুলো শেখানোর সবচেয়ে ভালো উপায় হিসেবে তিনি এই কিউবটি তৈরি করছিলেন।
স্পর্শ করা যায়, এমন গেম বানাতে চেয়েছিলেন রুবিক। একইসাথে তা হতে হবে বহনযোগ্য। সহজ হওয়ার পাশাপাশি এ গেমে থাকতে হবে এমন কোনো সমস্যা যা সমাধানের জন্য শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন গাণিতিক বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে হবে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, জটিল এই গেমটির সমাধান করতে গেলে তাদেরকে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে।
বিবিসিকে রুবিক বলেছিলেন, 'সবার আগে আপনাকে ধৈর্যশীল হতে হবে। এই গুণটি যেকোনো সমস্যার সমাধানে উপকারে আসে। এছাড়া থাকতে হবে স্থানিক ও ত্রিমাত্রিক স্মৃতি। টুকরোগুলোর অবস্থান মনে রাখতে হবে…চোখ বন্ধ করেই যেন মনে করতে পারেন। আর শুধু ছবি হিসেবে মনে রাখলেই চলবে না, ছবির অর্থও বুঝতে হবে ।'
তার বানানো প্রোটোটাইপটি ছিল ছোট ছোট অনেকগুলো কিউবের সমন্বয়ে গঠিত ষড়ভুজাকৃতির কাঠের কিউব। প্রথমে তিনি ছোট কিউবগুলোর মাঝে ছিদ্র করে ওগুলো রাবার ব্যান্ড দিয়ে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু সে চেষ্টা বারবার ব্যর্থ হওয়ার পর একটি গোপন কৌশল ব্যবহার করেন রুবিক। ওই কৌশলে প্রতিটি টুকরোকে আলাদাভাবে বাঁকানো এবং ঘোরানো সম্ভব হয়। কিউবের প্রতি পাশে তিনি একটি নির্দিষ্ট রং ব্যবহার করেন, যাতে ঘোরানোটা সহজে দেখা যায়।
এরপর তিনি পুরো কিউবটিকে ইচ্ছেমতো ঘোরাতে শুরু করেন, যাতে রংগুলো মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। এবার কিউবটিকে তিনি পুরোনো বা আদি অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন, যেখানে একই রঙের সব ছোট কিউব একপাশে থাকবে।
প্রথমবার এই কিউবের সমাধান করতে প্রায় এক মাস লেগে যায় এরনোর। এর মধ্য দিয়ে তিনিই প্রথম ব্যক্তি হিসেবে রুবিকস কিউবের সমাধান করেন। ধারণা করা হয়, মাত্র ১ শতাংশ মানুষ কোনো ধরনের সাহায্য ছাড়া এর সমাধান করতে পারে।
বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এরনো স্বীকার করেন, পরবর্তী জীবনে তার রুবিকস কিউব সমাধানের দক্ষতা কিছুটা কমে আসে। 'আমি খুব একটা দ্রুত নই। নিয়মিত প্র্যাকটিস করলে মিনিটখানেকের মধ্যে কিউব মিলাতে পারি। তবে এখন আর প্র্যাকটিস করি না। বহু বছর আগে আরও দ্রুত মিলাতে পারতাম।'
ঠিক এই জায়গাতেই লুকিয়ে আছে এই কিউবের আকর্ষণ। সাদা চোখে দেখতে সহজ এই গেম মানুষকে নেশাদ্রব্যের মতো টানে, কিন্তু খেলতে বসলে পাজল মিলাতে না পেরে ভয়ানক হতাশায় পেয়ে বসতে পারে।
এরনো তার শিক্ষার্থীদের এই কিউবটির প্রোটোটাইপ ব্যবহার করতে দেন। নিজেদের মতো কিউবের সমাধান করতে দেন তিনি। শিক্ষার্থীরা দারুণ পছন্দ করে এই কিউব। তাদের মধ্য এর জনপ্রিয়তা দেখে এরনো ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে তার 'ম্যাজিক কিউবের' জন্য হাঙ্গেরিয়ান পেটেন্টের আবেদন করেন।
কমিউনিস্ট-শাসিত হাঙ্গেরিতে ওই সময় উৎপাদন খাতকে সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। ফলে তখন বড় পরিসরে কিউব উৎপাদন সম্ভব হয়নি। এ কারণে প্রথম কয়েক বছর এই পাজল গেম বেশি খেলতেন দেশটির ডিজাইনার, স্থপতি ও গণিতবিদরা।
১৯৭৯ সালের নুরেমবার্গ টয় ফেয়ারে প্রথমবারের মতো এ কিউব প্রথম প্রদর্শিত হয়। তখনই আইডিয়াল টয় কর্পোরেশনের নজরে পড়ে এরনোর 'ম্যাজিক কিউব'। তারা এ কিউব কিনে নেয়। এরপরই বাণিজ্যিকভাবে যাত্রা শুরু করে এই পাজল।
পরবর্তীতে ১৯৮০ সালে পাজলটির নাম বদলে 'রুবিকস কিউব' রাখা হয়। ওই বছরই আন্তর্জাতিকভাবে এটি বাজারজাত করা হয়। বাজারে এসেই হুলস্থূল ফেলে দেয় রুবিকস কিউব। সব বয়সের মানুষের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে গেমটি।
বিশ্বব্যাপী পাজল চ্যালেঞ্জ
রুবিকস কিউবের কথা ছড়িয়ে পড়ে বাতাসের গতিতে। লাখ লাখ মানুষ এ কিউবের সমাধান করার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে। মানুষের এই পাজল সমাধান করার উপায় উঠে আসে বিভিন্ন বইয়ে। এভাবেই রুবিকস কিউবের কথা ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। নানা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতে শুরু করে এ পাজলের সমাধানের জন্য। "স্পিডকিউবিং' প্রতিযোগিতা প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করে, যা আজও ব্যাপক জনপ্রিয়।
ধারণা করা হয়, ১৯৮২ সাল নাগাদ রুবিকস কিউবের আদলে তৈরি নানা পাজলসহ মোট প্রায় ১০০ মিলিয়ন রুবিকস কিউব বিক্রি হয় বিশ্বজুড়ে।
১৯৮০-র দশকে এর জনপ্রিয়তা এমন উচ্চতায় পৌঁছে যায় যে প্রায় সবাইকে রুবিকস কিউব সমাধানে মশগুল হতে দেখা যায় কোনো না কোনো সময়। টি-শার্ট, গান এমনকি টেলিভিশনে 'অ্যামেজিং কিউব' নামে কার্টুন অ্যাডভেঞ্চার সিরিজ তৈরি হয় রুবিকস কিউব নিয়ে।
১৯৮২ সালে বিশেষ্য পদ হিসেবে অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে জায়গা করে নেয় রুবিকস কিউব। একইসাথে 'মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট'-এ স্থায়ীভাবে জায়গা করে নেয় প্রদর্শনীর জন্য।
রুবিকস কিউবের সেই পুরোনো জৌলুশ এখন আর নেই। কিন্তু তারপরও বর্তমান সংস্কৃতিতে স্থায়ী প্রভাব রয়েছে এ কিউবের।
'বিং জন মাল্কোভিচ', 'ওয়াল-ই' এবং 'স্পাইডার ম্যান: ইনটু স্পাইডার ভার্স'-এর মতো সিনেমাগুলোতে রুবিকস কিউবের উপস্থিতি দেখা যায়। গুগল ডুডলে ও স্পাইস গার্লস-এর 'ভিভা ফরেভার' মিউজিক ভিডিওতেও রুবিকস কিউব দেখা যায়। 'ফ্যামিলি গাই', 'ল অ্যান্ড অর্ডার', 'বিগ ব্যাং থিওরি'র মতো জনপ্রিয় টেলিভিশন শোতে রুবিকস কিউবের নাম এসেছে বহুবার। বিশ্বের প্রতিযোগিতামূলক কিউবিংয়ের দুই তারকার মাঝে বন্ধুত্ব নিয়ে তৈরি হয়েছে নেটফ্লিক্সের প্রামাণ্যচিত্র 'দ্য স্পিড কিউবারস'।
এখনও নিয়মিত বিক্রি হয় রুবিকস কিউব। প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে রুবিকস কিউব নিয়ে নতুন রেকর্ড। কেউ চোখ বেঁধে, কেউ পানির নিচে, আবার কেউ বা আকাশে 'ডাইভ' করতে করতে এ পাজলের সমাধান করে রেকর্ড গড়ছে।
অনেক নকল পণ্য বাজারে থাকায় এ পর্যন্ত কত সংখ্যক রুবিকস কিউব বিক্রি হয়েছে, তা ধারণা করা কঠিন। তবে ধরে নেওয়া হয়, এখন পর্যন্ত প্রায় ৪০০ মিলিয়ন রুবিকস কিউব বিক্রি হয়েছে বিশ্বজুড়ে। এরনো নিজেই হাঙ্গেরির তরুণ উদ্ভাবকদের সহায়তা করার জন্য একটি ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি তার নিজের স্টুডিওর নকশা করেছেন 'রুবিকস স্নেকের' আদলে। তবে আর আর কোনো আবিষ্কারই রুবিকস কিউবের মতো উন্মাদনা সৃষ্টি করেনি।
তবে এই কিউবের আবিষ্কারই এরনোকে পরবর্তী সব কাজের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে বলে জানান তিনি।
- ইংরেজি থেকে অনুবাদ: জেনিফার এহসান