নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্তঘেঁষা ৬ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) মধ্যে উত্তেজনা বাড়ায় সীমান্তঘেঁষা ছয়টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
কয়েক দিন ধরে আতঙ্কে সীমান্তঘেঁষা এসব স্কুলে কোনো শিক্ষার্থী না আসলেও বন্ধ ঘোষণা করা হয়নি। শিক্ষকেরা প্রতিদিনই স্কুলে উপস্থিতি ছিলেন। তবে এবার সীমান্ত পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হতে থাকায় সোমবার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
স্কুলগুলো হলো- উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের বাইশফাঁড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভাজাবনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পশ্চিমকুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দক্ষিণ ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ঘুমধুম মিসকাতুন্নবী দাখিল মাদ্রাসা।
এ বিষয়ে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা লামা উপজেলা ইউএনও শান্তনু কুমার দাশ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'একেবারে সীমান্তঘেঁষা হওয়ায় পাঁচটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি মাদ্রাসা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয়ও প্রয়োজনে পরিস্থিতি অনুযায়ী বন্ধ হতে পারে। এ বিষয়ে প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।'
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ত্রিরতন চাকমা বলেন, 'ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্কুলগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত এগুলো বন্ধ থাকবে। এলাকাটি বিজিবি ঘিরে রেখেছে। ওই এলাকায় আপাতত কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না, যানবাহন চলাচলও বন্ধ রয়েছে। কারণ গতকাল মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা তাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ৫০ জনকে একটা স্কুলে রাখা হয়েছে।'
পশ্চিমকুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হেলাল উদ্দিন জানান, গোলাগুলির আতঙ্কে কয়েকদিন ধরে এসব স্কুল শিক্ষার্থীশূন্য ছিল। তবে শিক্ষকেরা নিয়মিত উপস্থিত ছিলেন। এখন দিন দিন পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্টকালের জন্য স্কুলগুলো বন্ধ ঘোষণা করেছে।'
অন্যদিকে স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ঘুমধুম এলাকায় সোমবারও ভোর থেকে কখনও থেমে থেমে, কখনও একটানা প্রচণ্ড গোলাগুলি চলে। দুপুর ৩টা পর্যন্ত ঘুমধুম এলাকার মিয়ানমার সীমান্তের ওপারে ঢেঁকিবনিয়া বিজিপি ক্যাম্পে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। এসময় মিয়ানমার সীমান্তে আকাশে উড্ডয়মান হেলিকপ্টার থেকেও গুলিবর্ষণ করতে দেখা গেছে।
তারা আরও জানান, আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন তারা। অনেকে আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে।
এলাকার পরিস্থিতি সম্পর্কে ঘুমধুম ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. শফিক জানান, তুমব্রু এলাকায় থেমে থেমে গোলাগুলি চললেও সোমবার সকাল থেকে তীব্রতা একটু কমেছে। কিন্তু ঘুমধুম এলাকার দিক থেকে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ আসে। দুপুরের দিকে তুমব্রু হয়ে ঘুমধুম এলাকার দিকে মিয়ানমারের হেলিকপ্টার উড়ে যেতে দেখা গেছে। এর কিছুক্ষণ পর ঘুমধুম এলাকার সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের একটা বিজিপি ক্যাম্পে আগুন জ্বলতেও দেখা যায়।
তিনি বলেন, 'তুমব্রু এলাকার কেউ কেউ নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছে। যাদের ঘরে গবাদিপশু রয়েছে, পরিস্থিতি একটু ভাল হলে তারা ফিরে আসে। সীমান্তের মানুষ এখন ভয় ও আতঙ্ক নিয়ে দিন পার করছে।'
ঘুমধুম সীমান্তের কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তুমব্রু সীমান্তের ওপারে ঢেঁকিবুনিয়ার পাশে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষীর রাইট ক্যাম্প হিসেবে পরিচিত। শনিবার ভোরে আরাকান আর্মি এটি দখল করে নেয়। ওই ক্যাম্পে ৩০০ জনের কাছাকাছি বিজিপি সদস্য ছিল, যার মধ্যে বাংলাদেশে আশ্রয়ে পালিয়ে আসে ৯৫ জন।
ওই ক্যাম্প পুনর্দখল করার জন্য রবিবার বিকাল থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী হেলিকপ্টার থেকে রাইট ক্যাম্প লক্ষ্য করে মুর্হুমুহ গুলি করে। আবার সোমবার ভোরবেলা থেকেও থেমে থেমে হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণ চলে।
রাইট ক্যাম্পের কয়েক কিলোমিটার দূরে ঘুমধুম সীমান্তের আরেকটি মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী লেফট ক্যাম্পটি রয়েছে। যেখানে ১০০ জনের কাছাকাছি বিজিপি সদস্য রয়েছে এখনও। তবে সে ক্যাম্পটি এখনও দখল নিতে পারেনি আরাকান আর্মি।
ওই ক্যাম্প থেকে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের আরাকান আর্মির ওপর পাল্টা গুলি করতে দেখা যায়।
সোমবার দুপুরে সীমান্ত এলাকা পরিদর্শনে আসেন কক্সবাজার র্যাব -১৫ ব্যাটালিয়নের জ্যেষ্ঠ সহকারি পরিচালক ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবু ছালাম চৌধুরী।
পরিদর্শন শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, 'সীমান্ত এলাকায় কয়েক দিন ধরে উত্তেজনা রয়েছে। সেখানে বিজিবি কাজ করছে। তার পাশাপাশি র্যাব-পুলিশও বসে নেই। আমাদের পক্ষ থেকে যে দায়িত্ব পালন করা উচিত সেটা করে যাচ্ছি। তবে এই পরিস্থিতির মধ্যে উৎসুক জনতা এসব ঘটনা দেখার জন্য ঘর ছেড়ে রাস্তায় চলে আসে। এটা তাদের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করি। এর মধ্যে শিশুরাও রয়েছে। অনেক সময় ওপার থেকে ছোড়া গুলি এপারে এসে পড়ে। ইতোমধ্যে পড়েছেও। এজন্য তাদেরকে সতর্ক করা হচ্ছে, যাতে তারা নিরাপদ জায়গায় থাকে।'
স্থানীয়রা ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদের যাওয়ার বিষয়ে র্যাবের এই কর্মকর্তা জানান, উত্তেজনা বিরাজ করায় অনেকে ভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এটি একটা সাময়িক বিষয়। নিরাপত্তার ব্যাপারে স্থানীয় পুলিশ রয়েছে; পাশপাপাশি বিজিবি ও র্যাব আছে। সব পক্ষ তাদের নিরাপত্তা জোরদার করে যাচ্ছে।'