বইমেলায় সাড়া ফেলেছে অডিওবুক আর ই-বুক
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। চলছে অমর একুশে বইমেলা। বাহারি সাজে সেজেছে মেলাপ্রাঙ্গন। স্টলগুলো যেন নেমেছে নান্দনিকতার প্রতিযোগিতায়! অভিনব সব স্টলে ঘুরতে ঘুরতে একটির সামনে এসে হঠাৎ থমকে দাঁড়াতে হয়। এ কী! বইমেলায় স্টল, অথচ নেই কোনো বই। দোকানটির কাছে যেতেই অবশ্য পরিষ্কার হলো সব। 'কাহিনীক' নামক এই স্টলটি আসলে একটি অডিওবই স্টল। একই নামে তাদের রয়েছে অ্যাপ্লিকেশন। তাতে রয়েছে জনপ্রিয় সব বইয়ের অডিও রেকর্ডিং শোনার ব্যবস্থা।
শুধু 'কাহিনীক' নয়, বেশ কয়েকটি অডিওবুক আর ই-বুক স্টল দারুণ সাড়া ফেলেছে এবারের বইমেলায়। মেলায় আগত পাঠক-পাঠিকারাও সাগ্রহে ভিড় করছেন এসব স্টলে। কাগজের বইয়ের পাশাপাশি তুমুল বিক্রি হচ্ছে এসব ডিজিটাল বই।
অনেকের কাছে এখনও বই মানেই কাগজে ছাপা অক্ষর, হাতে নিয়ে স্পর্শ করে পড়ার জিনিস। যদিও কাগজের বই অনেক আগেই ঢুকে পড়েছে ডিজিটাল মাধ্যমে। অল্পদিনে অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তাও পেয়েছে মাধ্যমটি। এ জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে এবারের বইমেলার বাংলা একাডেমি অংশে স্টল দিয়েছে বেশ কয়কটি অ্যাপভিত্তিক বইয়ের দোকান। কোনোটি ই-বুক, কোনোটি অডিওবুক, কোনটিতে রয়েছে দুই ধরনেরই পণ্য।
'শুনবই' যেমন শুধুই অডিও বইয়ের স্টল। একই নামে অ্যাপ রয়েছে তাদের। অ্যাপটি সমৃদ্ধ এক হাজারের বেশি বাংলা ও ইংরেজি বইয়ের অনুবাদ গ্রন্থে। এই প্লাটফর্মটির প্রতিষ্ঠাতা শাহরিয়ার হৃদয়। তার হাত ধরে ২০২১ সালের মার্চে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে 'শুনবই'। প্রতিষ্ঠানটির ব্রান্ড প্রমোটার জান্নাতুল ফেরদৌস জানালেন, গতবছর প্রথমবারের মতো মেলায় অংশগ্রহণ করেছিলেন তারা। এবার তাদের স্টল পড়েছে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে। সরকার অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান হওয়ায় বাংলা একাডেমির মেলায় অংশগ্রহণ করতে কোনো সমস্যা পোহাতে হয়নি তাদের।
'শুনবই' অ্যাপটিতে অডিওবই শুনতে সাবস্ক্রাইব করতে হয় শ্রোতাদের। রয়েছে মাসিক ও বার্ষিক প্ল্যান। প্রতি মাসে ৯৯ এবং বছরে ১২০০ টাকা দিয়ে বই শোনার সুযোগ পান শ্রোতারা। তবে বই মেলা উপলক্ষে শুনবই স্টলে একমাসের সাবস্ক্রিপশন পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ১০ টাকায়। আর বার্ষিক ফি পড়বে ৬০০ টাকা।
মেলায় ইতোমধ্যে বেশ সাড়া পাচ্ছেন বলে জানালেন জান্নাতুল। বললেন, 'সবাই অনেক অ্যাপ্রিশিয়েট [প্রশংসা] করতেছে। স্টলে এসে ইনস্টল করে নিয়ে গেছে, সাবস্ক্রিপশন করে নিয়ে গেছে। এই যুগে এসে অনেকে বই পড়ার সময় পাচ্ছে না। সবাই বেশ আগ্রহ দেখাচ্ছে।' ডিজিটাল মাধ্যমে বইয়ের এই আধুনিক রূপের নানা সুবিধার কথাও জানালেন তিনি। 'বাড়িতে কাজ করার সময়, কিংবা ট্রাভেল করার সময় যখন বই পড়া হয় না, তখন এই বইগুলো পড়া যাচ্ছে। এখন তো সবাই টেকনলোজিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। সেক্ষেত্রে ডিজিটাল বই আমাদের ফিউচার। আমাদের অ্যাপে দশ থেকে নব্বই বছর বয়সি, সবার উপযোগী কন্টেন্ট রয়েছে। অনেকে আছেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, তাদের জন্য তো বেশি ইউজফুল [উপকারী] হবে।'
মেলায় ঘুরতে এসে 'কাহিনীক' স্টলে এসেছেন আফরিনা ও তার বন্ধুরা। অফার শুনে নিজেদের ফোনে ইনস্টল করে নিলেন তারা। আফরিনা জানালেন, আগে থেকেই তিনি ইউটিউবে বইয়ের অডিও ভার্সন শুনে আসছেন। কলকাতার রেডিওভিত্তিক অনুষ্ঠান সানডে সাসপেন্সের নিয়মিত শ্রোতা তিনি। তবে সেখানে চাহিদামতো বাংলাদেশি বই না থাকার অভাব এতদিন বোধ করেছেন তিনি। এবার আশা করছেন নিজের পছন্দমতো বই পাবেন।'
'কাহিনীক' যাত্রা শুরু করেছে মাত্র দু'মাস আগে। এর স্লোগান: 'বই বাজুক আপনার কানে'। প্রথমবার বইমেলাতে এসেই অভূতপূর্ব সাড়া ফেলেছে স্টলটি। এর প্রতিষ্ঠা পরিচালক ইমরাদ জুলকারনাইন জানালেন, মাত্র দু'মাস আগে অ্যাপ চালু হলেও তার চিন্তার বয়স দুই বছরের অধিক। মাত্র ১০০টি অডিও বই নিয়ে শুরু করেছেন, তবে খুব দ্রুতই আরও ৫০০ বই যুক্ত হবে বলে আশা করছেন তিনি।
কাহিনীক অ্যাপে এককালীন কোনো সাবস্ক্রিপশন ফি নেই। প্রতিটি বই কিনতে হয় আলাদাভাবে, অনেকটা বাঁধাই করা বই কেনার মতো। একবার কেনার পর আজীবন সেটি ব্যবহার করা যাবে, বলছেন ইমরাদ। তার এমন ব্যতিক্রম উদ্যোগের কারণ জানতে চাইলে বললেন, 'সাবস্ক্রিপশন মডেলে একজন লেখক একবার মাত্র টাকা পাচ্ছেন। আর আমাদের এই প্লাটফর্মে একজন নবীন লেখকও আজীবন টাকা পাবেন, যতবার তার বই কেনা হবে কিংবা মানুষ শুনবে। তার উত্তরাধিকারেরাও অর্থটা পাবেন।'
মেলায় 'কাহিনীক' অ্যাপে রেজিস্ট্রেশন করলেই উপহার হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে দু'শো টাকার গিফট কুপন যা দিয়ে অ্যাপটিতে বই কিনতে পারবেন শ্রোতারা। এই বিষয়টিকে দারুণ সুযোগ হিসেবে দেখছেন সালমা বেগম। তিনি একজন গৃহিণী। মেয়ের সাথে মেলায় এসেছেন। ইসলামি বই খুঁজেছেন কিছুক্ষণ। বিক্রয়কর্মীদের কাছে কাহিনীক এর সুবিধার কথা শুনে রেজিস্ট্রেশন করলেন তিনি। বললেন, 'পড়ার সময় হয় না। কাজের ফাঁকে শুনবো।'
মেলার বাংলা একাডেমি অংশে 'শুনবই'-এর পাশেই আরেকটি স্টলে দর্শনার্থীদের বেশ ভিড়। আকর্ষনীয় গ্রাফিক্সে সাজানো দোকানটির নাম 'বইঘর'। 'বইঘর' অ্যাপে বই শোনার পাশাপাশি রয়েছে ই-বুক পড়ার সুযোগ। তাই এর স্লোগান 'পড়ুন ই-বুক, শুনুন অডিওবুক'। বইঘর-এর সেলস রিপ্রেজেনটেটিভ জান্নাত জানালেন, তাদের আড়াই হাজার ই-বুক এবং দু'শো প্লাস অডিওবই রয়েছে। "আমাদের অ্যাপটিতে সাপ্তাহিক, মাসিক ও বার্ষিক সাবস্ক্রিপশন নেওয়া যায়। পাশাপাশি আলাদা ভাবে বইও কেনা যাবে। আমরা সেই ২০১৬ থেকে বইমেলায় অংশগ্রহণ করে আসছি। সবকিছু যেহেতু প্রযুক্তিভিত্তিক হয়ে যাচ্ছে, সে কথা মাথায় রেখেই অ্যাপটি ডেভেলপ করা হয়েছিল।'
তার মুখেও শোনা গেলো ডিজিটাল ডিভাইসভিত্তিক বইয়ের ভালো দিকগুলো। বললেন, 'মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও তো বলেছেন পেপারলেস সোসাইটি, স্মার্ট বাংলাদেশের কথা৷ সেক্ষেত্রে ই-বুক কিন্তু বেশ সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। আপনি একসাথে আড়াই হাজার বই একটি ডিভাইসে ক্যারি করতে পারছেন, যেটা কি না হার্ড কপির ক্ষেত্রে সম্ভব না। ঢাকার জ্যামে আটকে থেকে এসব অডিও বুক পড়ে বা শুনে সময় কাটানো সম্ভব।"
অনলাইনে বই বিক্রয় কেন্দ্র হিসেবে রকমারির সব মহলে সমাদৃত। তবে প্রতিষ্ঠানটির যে একটি সমৃদ্ধ ই-বুক স্টোর রয়েছে, তা হয়তো অনেকেরই অজানা। বাংলা একডেমিতে রকমারি ই-বুক স্টলের বিক্রয়কর্মী মোহাম্মাদ শিমুল মোল্ল্যা বললেন, রকমারি বই পড়াকে আধুনিক ডিভাইসে নিয়ে এসেছে। অ্যাপস ও ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বই পড়া যায়। বইগুলোর দামও অনেক কম। প্রায় সাত হাজারের মতো বই রয়েছে তাদের। চাইলে পড়ার ফাঁকে কাঙ্ক্ষিত বইটি অর্ডার করারও সুযোগ রয়েছে। বললেন, তাদের পাঠক-পাঠিকা শুধু নতুন প্রজন্ম নয়। 'কিছু কিছু পাঠকের মুখে শুনি বই পড়ার ক্ষেত্রে ছাপানো বইটাই বেস্ট। অনেকে আবার, বিশেষ করে যারা বর্তমান প্রজন্মের, কিংবা বয়স্ক, তারা ঘরে বসে সহজেই পড়ার জন্য ইবুক নিচ্ছেন। বয়স্ক-তরুণ সবার কাছ থেকেই সাড়া পাচ্ছি।'
তবে অডিও কিংবা ই-বুককে বাঁধাই করা কাগজের বইয়ের পরিপূরক মানতে নারাজ শিক্ষক মাসুদ হাসান। তিনি মনে করেন, সত্যিকারের পড়ুয়া কখনোই অডিও বই শুনে কিংবা ই-বুক পড়ে তৃপ্তি পেতে পারে না। "নতুন প্রজন্মের হাতে বই তুলে দিতে হবে। মোবাইলে অন্য দশটা কাজ হতে পারে, বই পড়া হয় না আসলে। বই একটি চর্চার বিষয়। হুটহাট শুনে ফেলে সাহিত্য তো উপভোগ করা যায়ই না, শিক্ষাও কিছু পাওয়া যায় বলে মনে হয় না।" মাসুদ হাসানের সঙ্গে কণ্ঠ মেলালেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সবুজ। তার মতে, বাঁধাই করা বইয়ের বিকল্প হিসেবে অডিওবুক ব্যবহার খুব বেশি ইতিবাচক কিছু নয়। এই ধরনের উদ্যোগ নিয়েও তার সংশয় রয়েছে। 'মানুষ তো বিনামূল্যে ইউটিউবে অসংখ্য বই পেয়ে যাচ্ছে। আলাদা করে সাবস্ক্রিপশন নিয়ে কেউ সিরিয়াসলি বই শুনবে বলে মনে হয় না।'
তবে এসব বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করলেন 'কাব্যিক'-এর ব্রান্ড প্রমোটর ফিরোজ আহমেদ রিয়াদ। নানা ধরনের আয়োজন ও অফার নিয়ে এবারের বইমেলায় কাব্যিক বেশ আলোচিত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে মেলা প্রাঙ্গন, সর্বত্রই বেশ সরব স্টলটি। সম্প্রতি স্টলেই দর্শনার্থীদের মধ্যে লাইভ অডিশন নিয়ে সাড়া ফেলেছে তারা। রিয়াদ জানালেন, মেলায় ইতোমধ্যে দর্শকদের আগ্রহ দেখে বেশ আশাবাদী তিনি।
কাহিনীক-এর পরিচালক ইমরাদ জুলকারনাইনও ব্যক্ত করলেন আশাবাদ। বললেন, বইয়ের ভবিষ্যত ডিজিটাল মাধ্যম, এটা তিনি বিশ্বাস করেন না। দুটি মাধ্যমই হাত ধরাধরি করে চলবে বলে তিনি মনে করেন। "যে সব দেশে মানুষ বই পড়ে, একই বই একসাথে মিলিয়ন কপি বিক্রি হয় ফিজিক্যাল বই, আবার অডিও বুকও মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়। মাধ্যম দুটি আলাদা, একটি আরেকটি প্রতিদ্বন্দ্বী না। কেউ 'পথের পাঁচালি' বই পড়তে আগ্রহী হবে, কেউ বা সিনেমা দেখতে।"
ছবি: জুনায়েত রাসেল