করোনাকালে ঘুড়ি বিক্রি করে বিকল্প আয়
করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে স্তব্ধ পৃথিবী। বন্ধ হয়ে গেছে অনেকের আয়-রোজগারের পথ। সংসারের লাগাম টানতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন লাখো-কোটি নিম্ন আয়ের মানুষ। করোনা দুর্যোগের এই সময় অনেকেই বাধ্য হয়েছে খুঁজে নিয়েছেন বিকল্প কর্মসংস্থানের পথ।
নেত্রকোনার মদন উপজেলার কুলিয়াটি পশ্চিমপাড়া গ্রামের দিনমজুর মিনু মিয়া (৬৫) তাদেরই একজন। দিনমজুরের কাজ না পেয়ে বাধ্য হয়ে গত তিনমাস ধরে তিনি ঘুড়ি বিক্রি করছেন। তা দিয়েই চলছে তার সংসার।
মিনু মিয়া তার ভাষায় বলেন, ''আগে দিনমজুরির কাম-কাজ কইরা সংসার চালাইতাম। কিন্তু কিছুদিন আগে লকডাউন দেওয়ার পরে বেকার হইয়া পড়ি। তহন দেহি, অনেকেই শখ কইরা ঘুড্ডি উড়াইয়া সময় কাটাইতাছে। তাই আমিও শখ কইরা একটা ঘুড্ডি বানাইয়া কয়েকদিন উড়াই। এইডা দেইখ্যা গ্রামের একজন তার বাইচ্চার লাইগ্যা একটা ঘুড্ডি বানাইয়া দিতে বলে। তারে বানাইয়া দেই। পরে হে খরচের কয়েকটা ট্যাহা (টাকা) দেয়। এইডার পরেই ঘুড্ডির ব্যবসার চিন্তাডা মাথাত আইছে।''
মিনু মিয়া জানান, শৈশবে ঘুড়ি বানানোর কলা-কৌশল রপ্ত করেছিলেন। গত তিনমাসে ছোট-বড় মিলিয়ে অন্তত ৪০০ ঘুড়ি বানিয়ে বিক্রি করেছেন। চার-পাঁচ রকমের ঘুড়ি বানাতে পারেন তিনি।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চলছে তেলেঙ্গা, ডাকঘুড়ি ও বক্স ঘুড়ি। আকার ভেদে একেকটি ঘুড়ির দাম পড়ে আড়াইশ থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়া অনেকে অর্ডার দিয়ে বড় সাইজের ঘুড়িও বানিয়ে নিচ্ছেন। সেগুলোর দাম আরেকটু বেশি।
বর্ষাকাল হওয়ায় ঘুড়ি বানাতে তিনি কাগজ ব্যবহার করেন না। পলিথিন পেপার দিয়ে তৈরি করেন। এতে ঘুড়ি টেকসই হয়। বৃষ্টিতে ভিজে নষ্ট হয় না। বাতাসেও ছিঁড়ে না। পলিথিন ছাড়াও বাঁশ এবং সুতা বাবদ অল্পকিছু খরচ পড়ে। সামান্য এই খরচ বাদে পুরোটাই লাভ হিসেবে থাকে তার।
''লকডাউন উঠে গেলেও করোনার ভয়ে অহন আর দিনমজুরির কামে যাই না। ঘুড়ি বেইচ্যাই সংসারের খরচ চলতাছে'', বললেন মিনু মিয়া।
শুধু মদন উপজেলার বাসিন্দারাই নন, দূর-দুরান্ত থেকেও অনেক সৌখিন লোক এসে তার কাছ থেকে ঘুড়ি সংগ্রহ করে নিয়ে যাচ্ছেন।
মদনের জাহাঙ্গীরপুর গ্রামের বাসিন্দা আবদুল আওয়াল জানান, ''শুধু মিনু মিয়াই না, তার মতো আরও অনেকে ঘুড়ি বানিয়ে বিক্রি করছেন। করোনা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার পর ঘুড়ির ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে।''
করোনা পরিস্থিতিতে লকডাউন ঘোষণার পর মানুষ যখন হঠাৎ গৃহবন্দি হয়ে পড়ে, ঠিক তখন নেত্রকোনার বিভিন্ন শহর ও গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক হাড়ে ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব শুরু হয়। লকডাউন প্রত্যাহারের পরও তা অব্যাহত আছে।
শহর-গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ঘুড়ি বানানো হচ্ছে। শুধু দিনে না, রাতের আকাশেও উড়ছে শত শত রং-বেরংয়ের ঘুড়ি। অনেকে আবার 'সনাতন ঘুড়ি'কে ইলেক্ট্রনিক প্রযুক্তির সহায়তায় 'ডিজিটাল ঘুড়ি'তে রূপান্তরিত করছেন। মোবাইল ফোনের ব্যাটারির সাহায্যে ঘুড়ির ফ্রেমে যুক্ত করছেন রং-বেরংয়ের ইলেক্ট্রনিক বাতি।
এর ফলে রাতের আকাশে একেকটি ঘুড়ি দেখতে উজ্জ্বল তারার মতো মনে হয়। বর্ণিল আলোকরশ্মি ছড়িয়ে জ্বলজ্বল করে। শুধু তরুণরাই নয়, নারী-পুরুষ সবাই যোগ দিচ্ছেন ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসবে। ঘুড়ি উড়িয়ে গৃহবন্দি থাকার একঘেয়েমিকে দূর করছেন তারা। পাড় করছেন অফুরন্ত অলস সময়।