ইসরায়েলি ট্যাংক সাংবাদিকদের ওপর গোলাবর্ষণের পর গুলিও ছুড়েছে: তদন্ত প্রতিবেদন
লেবাননে গত অক্টোবরে একটি ইসরায়েলি ট্যাংকের ক্রুরা একদল সাংবাদিকের ওপর দুটি গোলাবর্ষণ করে এবং এরপর ভারী মেশিনগান দিয়ে গুলি চালায়। ভয়াবহ এ হামলায় রয়টার্সের এক সাংবাদিক নিহত হয়েছেন।
নেদারল্যান্ডস অর্গানাইজেশন ফর অ্যাপ্লাইড সায়েন্টিফিক রিসার্চ (টিএনও) ১৩ অক্টোবরের হামলার প্রমাণ বিশ্লেষণের জন্য রয়টার্সের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়।
সংস্থাটির তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, নিহত সাংবাদিক ইসাম আবদাল্লাহ ও তার সঙ্গে থাকা সাংবাদিকেরা ইসরায়েলের একটি ট্যাংক থেকে ১.৩৪ কিলোমিটার দূরে ছিলেন। সেখান থেকে তাদের ওপর দুটি ১২০ মিলিমিটার রাউন্ড গোলাবর্ষণ করে ট্যাংকটি।
প্রথম গোলার আঘাতে ৩৭ বছর বয়সী আবদাল্লাহ নিহত হন এবং এএফপির ফটোগ্রাফার ক্রিস্টিনা আসসি (২৮) গুরুতর আহত হন।
গত ডিসেম্বরে টিএনও'র প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানানো হয়, পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, ইসরায়েলের ওই ট্যাংকটি সাংবাদিকদের ওপর গোলাবর্ষণের পর গুলিও চালিয়েছে।
বৃহস্পতিবার ইনস্টিটিউটের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘটনাস্থল থেকে আল জাজিরার একটি ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিওতে দেখা গেছে, ইসরায়েলের মারকাভা ট্যাংকে ব্যবহার করা যায় এমন ব্রাউনিং মেশিনগানের ০.৫০ ক্যালিবারের রাউন্ড গুলি দিয়ে সাংবাদিকদের ওপর গুলি চালানো হয়।
টিএনওর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'এর ভিত্তিতে ধারণা করা হচ্ছে, সাংবাদিকদের ওপর মারকাভা ট্যাংক থেকে দুটি গোলাবর্ষণের পরে মেশিনগান দিয়ে গুলিও চালিয়েছিল। তবে, (মেশিনগান) গুলির দিক এবং সঠিক দূরত্ব নির্ণয় করতে না পারায় গুলির লক্ষ্যবস্তু কি ছিল তা নিশ্চিত বলা যাচ্ছেনা।'
তারা সাংবাদিকদের উপর গুলি চালাচ্ছে এ বিষয়টি ইসরায়েলি ট্যাংকের ক্রুরা জানত কিনা রয়টার্স তা স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারেনি।
রয়টার্সের জীবিত দুই সাংবাদিক বা ঘটনাস্থলে উপস্থিত এএফপির আরেক সাংবাদিকের কারোরই মেশিনগানের গুলির কথা মনে নেই।
তারা সবাই জানিয়েছেন, ওই সময় (গোলাবর্ষণের পর) তারা বিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন।
এদিকে, সাংবাদিকদের ওপর হামলার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)।
ডিসেম্বরে টিএনওর প্রাথমিক অনুসন্ধানের বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে আইডিএফ বলে, 'আমরা কখনো সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে হামলা চালাই না।'
রয়টার্সের তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের একদিন পর তারা জানায়, একটি উত্তপ্ত যুদ্ধক্ষেত্রে ঘটনাটি ঘটেছিল।
আন্তর্জাতিক মানবিক আইন অনুযায়ী, সাংবাদিকদের উপর হামলা নিষিদ্ধ। কারণ সংবাদ মাধ্যমের বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার সম্পূর্ণ অধিকার আছে এবং তাদের লক্ষ্য করে সামরিক অভিযান চালানো যাবে না।
রয়টার্সের এডিটর-ইন-চিফ আলেসান্দ্রা গ্যালোনি বলেন, 'আমরা প্রকাশ্যে দিবালোকে দায়িত্বরত সাংবাদিকদের ওপর হামলার তীব্র নিন্দা জানাই। এই হামলায় আমাদের সহকর্মী ইসাম আব্দাল্লাহ নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন।'
তিনি বলেন, আমরা ইসরায়েলের প্রতি আবারও আহ্বান জানাচ্ছি, তারা যেন ব্যাখ্যা দেন, 'কীভাবে এই ঘটনা ঘটেছে এবং দোষীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে কিনা।'
স্পষ্টভাবে সংবাদকর্মী হিসেবে চিহ্নিত ছিলেন
এএফপির গ্লোবাল নিউজের পরিচালক ফিল চেটউইন্ড ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর প্রতি পূর্ণাঙ্গ ও স্বচ্ছ তদন্তের আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
তিনি বলেন, 'যদি সাংবাদিকদের ওপর মেশিনগান দিয়ে গুলি ছোঁড়ার একাধিক খবর পাওয়া যায়, তবে এই অভিযোগটি জোরদার হবে যে ইসরায়েলি ট্যাংক আসলেই সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে হামলা করেছিল এবং এই হামলা ছিল ইচ্ছাকৃত।'
আল জাজিরার আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ব্যবস্থাপক ইহতিশাম হিবাতুল্লাহ ইসরায়েলি সরকারের পক্ষ থেকে তদন্ত করে তার ফলাফল জনসম্মখে প্রকাশ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, 'এর ফলে বোঝা গেল, তারা (ইসরায়েলি বাহিনী) ইচ্ছাকৃতভাবে সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করছে। টিএনওসহ অন্যান্যদের করা তদন্তে এ তথ্যের সত্যতা পাওয়া গেছে।'
তবে, লেবাননের তথ্যমন্ত্রী এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।
৭০ পৃষ্ঠার টিএনও রিপোর্টে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, কীভাবে হেগের স্বাধীন গবেষণা ইনস্টিটিউটটি ট্যাংকের ফায়ারিং পয়েন্ট নির্ণয় করেছে এবং মেশিনগানের গুলির অডিও বিশ্লেষণ করেছে।
টিএনও উল্লেখ করেছে, হামলার শিকার ৭জন সাংবাদিক নীল ফ্লাক জ্যাকেট ও হেলমেট পরেছিলেন। তাদের বেশিরভাগের গায়ে সাদা অক্ষরে 'প্রেস' লেখা ছিল। হামলার আগে তারা লেবাননের আলমা আল-চাব গ্রামের কাছে একটি পাহাড়ের খোলা জায়গা থেকে দূরের গোলাগুলির ভিডিও ধারণ করছিলেন।
হামলার পরের ভিডিও ফুটেজে রয়টার্সের একটি কালো রঙের গাড়ির হুড ও ছাদে টেপ দিয়ে বড় বড় হলুদ অক্ষরে 'টিভি' লেখা দেখা গেছে।
ট্যাংক দুটির সাহায্যে ঠিক কোন জায়গা থেকে গোলাবর্ষণ করা হয়েছে, ইনস্টিটিউট তা নির্ণয় করতে সক্ষম হয়েছে।
টিএনও জানায়, যেখান থেকে গোলা ছোঁড়া হয়েছে, সেখান থেকে ঘটনাস্থল (সাংবাদিকরা যেখানে ছিল) স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল।
কারণ তাদের কাছে ঘটনাস্থলে রেকর্ড করা অডিও ফাইলগুলো ছাড়াও দ্বিতীয় রাউন্ডের বিস্ফোরণ ও ফ্লাইটের ভিডিও ছিল।
হামলায় রয়টার্সের ফটোগ্রাফার থাইয়ের আল-সুদানি (৪৭), ক্যামেরাম্যান মাহের নাজেহ (৫৩), আল জাজিরার দুই সাংবাদিক ও এএফপির আরেক সাংবাদিক আহত হয়েছেন।
পূর্ণাঙ্গ তদন্ত
রয়টার্সের অনুরোধে টিএনওর প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করা বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ, ট্যাংক ক্রুরা ইচ্ছাকৃতভাবে সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করেছে কিনা তা নিয়ে ভিন্ন মতামত প্রকাশ করেছেন।
ইউট্রেখট বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক মানবিক আইন বিশেষজ্ঞ জেসিকা ডরসি বলেন, 'টিএনওর প্রতিবেদনে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া গেছে যে, দুটি ট্যাংক থেকে গোলাবর্ষণ করা ছাড়াও, একই স্থান থেকে মেশিনগানের গুলিও ছোঁড়া হয়েছিল। এটি সুস্পষ্ট, ইচ্ছাকৃতভাবে তারা সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে গোলাবর্ষণ করেছিল ও গুলি ছুঁড়েছিল।'
তিনি বলেন, 'আমি মনে করি, যদি এই বিষয়টি কখনও আদালতে গড়ায়, তবে আরও স্পষ্ট হয়ে যাবে যে এটি প্রকৃতপক্ষে একটি যুদ্ধাপরাধ।'
অন্যদিকে, আইডিএফ মিলিটারি অ্যাডভোকেট জেনারেলের কর্পসে দায়িত্ব পালনকারী এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে হাই-প্রোফাইল ক্লায়েন্টদের পক্ষে লড়া ব্রিটিশ-ইসরায়েলি আইনজীবী নিক কাউফম্যান বলেন, ট্যাংকটি কেন সাংবাদিকদের ওপর গুলি চালিয়েছিল তা এখনও স্পষ্ট নয়।
তিনি বলেন, 'তবে শুধু টিএনও'র প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব নয় যে, বৈধ সামরিক উদ্দেশ্য হাসিলের বদলে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সাংবাদিকদের ওপর হামলা করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, 'একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করতে হবে এবং দুটি গোলা বর্ষণের পেছনে থাকা সামরিক গোয়েন্দা তথ্য বুঝতে হবে।'
হামলার পরদিন ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানায়, তাদের কাছে ঘটনাটির একটি ভিডিও আছে এবং বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
তবে এখন পর্যন্ত তাদের তদন্তের কোনো ফলাফল জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি।
ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি