অধিনায়কদের অধিনায়ক: হাবিবুল বাশারের সেরা স্টিভ ওয়াহ
বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অধিনায়ক বলা হয় তাকে। অধিনায়কত্বের বিশাল দায়িত্ব সামলে ব্যাটও চালিয়েছেন সমানে। দুই ফরম্যাট মিলিয়ে সেঞ্চুরি তিনটি, কিন্তু হাফ সেঞ্চরি ৩৮টি। এ কারণে নাম হয়ে গিয়েছিল মি. ফিফটি। হ্যাঁ, তিনি হাবিবুল বাশার সুমন।
২০০৪ থেকে ২০০৭ সাল; এই চার বছর বাংলাদেশের অধিনায়কত্বের গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন হাবিবুল বাশার। বাংলাদেশের সাবেক এই অধিনায়কের নেতৃত্বেই প্রথম টেস্ট জয়ের গল্প লেখা হয়, ওয়ানডেতে আলোর দিশা খুঁজে পায় বাংলাদেশ। প্রিয় এই ফরম্যাটে মিলতে থাকে জয়ের দেখা।
চার বছরের অধিনায়কত্বকালে অনেক অধিনায়ককেই কাছ থেকে দেখেছেন হাবিবুল বাশার। সবার কাছ থেকেই শিখতে চেয়েছেন তিনি। ভালো অধিনায়ক হতে বইও পড়েছেন ২৯টি ওয়ানডেতে বাংলাদেশকে জয় এনে দেওয়া হাবিবুল বাশার। তবে কারও মতো হতে চাননি তিনি, বদলাতে চাননি নিজেকে।
অধিনায়ক হিসেবে বাংলাদেশের ফারুক আহমেদকে দারুণ মনে হয় হাবিবুল বাশারের। মাঠ ও মাঠের বাইরে, দুই জায়গাতেই ফারুক আহমেদকে এগিয়ে রাখেন তিনি। সব মিলিয়ে হাবিবুল বাশারের সেরা অস্ট্রেলিয়ার সাবেক অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ। সৌরভ গাঙ্গুলিকেও লেটার মার্ক দেন তিনি।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের নিয়মিত আয়োজন 'অধিনায়কদের অধিনায়ক' সিরিজের চতুর্থ পর্বে নিজের সেরা অধিনায়ক ও অধিনায়কত্বের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেছেন হাবিবুল বাশার।
হাবিবুল বাশার: আমি আসলে অনেক অধিনায়কের অধীনেই খেলেছি। একেকজন একেকরকম ছিল। সবারই কোনো না কোনো গুণ ছিল। যেমন ছোট বেলা থেকেই দুর্জয়ের বিষয়ে শুনতাম ও অধিনায়ক হবে। অনেক অধিনায়কের অধীনে খেলেছি। পাইলট খুব উৎসাহী ছিল। আকরাম ভাই, বুলবুল ভাই ছিলেন। সুজন অফ দ্য ফিল্ড খুব ভালো ছিলেন। তবে আমি যত অধিনায়কের অধীনে খেলেছি, এর মধ্যে ফারুক আহমদকে আমার সবচেয়ে ভালো অধিনায়ক মনে হয়।
সুজন ভাই মাঠের বাইরে খুব ভালো ছিলেন। সামলে নিতেন সবকিছু। কিন্তু ফারুক ভাই মাঠের বাইরে তো ভালো ছিলেনই, মাঠেও ভালো ছিলেন। ফারুক ভাইয়ের গেম সেন্স খুবই ভালো ছিল। আমার কাছে মনে হয় এই গেম সেন্সটা একজন অধিনায়কের জন্য একটি শক্তির জায়গা। পাশাপাশি দুর্বলতার জায়গাটা বুঝতে পারাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সতীর্থ খেলোয়াড়দের বুঝতে পারাটাও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
যখন আপনি দলের নেতৃত্ব দেবেন, শক্তি এবং দুর্বলতার জায়গা বুঝতে না পারলে অধিনায়কত্ব করাটা মুশকিল হয়। কারণ আপনার দলে যা আছে, তা নিয়েই তো লড়তে হবে। খেলোয়াড়দের সম্পর্কে ধারণা থাকা উচিত ভালো করে। এটা ফারুক ভাইয়ের খুব ভালো ছিল। এদিক থেকে আমি ফারুক ভাইকে এগিয়ে রাখি। নান্নু ভাইও ভালো ছিলেন। যদিও উনার অধীনে সেভাবে খেলিনি, এক বছর খেলেছি। তবে সব মিলিয়ে ফারুক ভাইয়ের কথা বলব।
দেশের বাইরে গেলে অনেক অধিনায়কের নামই চলে আসে। অনেক ভালো ভালো অধিনায়ক ছিল। আমার মনে হয় স্টিভ ওয়াহ খুবই ভালো একজন অধিনায়ক। অনেকেই বলে স্টিভ ওয়াহ ভালো দল পেয়েছে, এ কারণে অধিনায়কত্ব ভালো হয়েছে। কিন্তু ওরকম একটা স্টার দলকে ম্যানেজ করা ভীষণ কঠিন একটা কাজ, আমি এটা খুব ভালো করে বুঝি।
সাধারণ একটি দলকে মানিয়ে নেওয়া সহজ। কিন্তু তার দলের মতো ক্রিকেটারদের বছরের পর বছর অনুপ্রাণিত করা সহজ কাজ নয়। যে কারণে স্টিভ ওয়াহর ক্রিকেট দর্শন আমার খুব পছন্দ। মাঠের বাইরে খুব বন্ধুসুলভ। কিন্তু মাঠে এক চুলও ছাড় দিতেন না। সেরা বেছে নিতে বলা হলে আমি স্টিভ ওয়াহকেই বেছে নিবো। সৌরভ গাঙ্গুলিও খুব ভালো করেছিল। কিন্তু একজন, অর্থাৎ সেরা বাছতে বললে আমি স্টিভ ওয়াহর কথা বলব।
আমি অধিনায়ক হিসেবে কারো মতো হতে চাইনি। আমার বিশ্বাস এটাই সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। কারণ কারও মতো হতে গেলে আপনি কখনই ভালো করবেন না। আপনাকে আপনার মতো করেই করতে হবে। আমি যখন অধিনায়ক হই, তার আগে তো আমার অধিনায়কত্বের অভিজ্ঞতা ছিল না।
অনেকেই অনেক রকম উপদেশ দিয়েছেন আমাকে, অনেকে বইও পড়তে দিয়েছেন বড় বড় অধিনায়করা কীভাবে অধিনায়কত্ব করেছেন, সেটা জানার জন্য। তারা কীভাবে অধিনায়কত্ব করেছেন, সেসব আমি পড়েছি। সবার কথাই শুনেছি আমি। কিন্তু দিনশেষে আমাকে আমার মতো করেই করতে হয়েছে। যাদের গুণের কথা বললাম, এসবের কিছুটা প্রভাব পড়েছে, কিন্তু আমি আমার মতো করে অধিনায়কত্ব করতে চেয়েছি। আমি আমাকে পরিবর্তন করতে চাইনি।
আমার কাছে মনে হয়েছে, আমি যদি নিজের মতো করে থাকতে পারি, তাহলে বেশি সফল হব। আমি সেটাই চেষ্টা করেছি। ফলে আমাকে আমার মতো করেই সবকিছু করতে হয়েছে সব সময়। আমি সবার কথা শুনেছি, কে কীভাবে করতেন, সেসব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেছি। কিন্তু দিনশেষে আমি আমার মতো করে করেছি অধিনায়কত্ব। যেটা ভালো মনে হয়েছে আমার কাছে, সেটাই করেছি।
কারও মতো হতে চাইনি, তবে কারও নির্দিষ্ট কোনো গুণ ভালো লাগলে সেসব নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করেছি। সবার থেকে কিছু কিছু নেওয়ার চেষ্টা করেছি। স্টিভ ওয়াহর যে জিনিসটা ভালো লাগতো, মাঠে কোনো বন্ধুত্ব নেই, মাঠে কোনো ছাড় নেই। তার ব্যাপারটা এমন ছিল যে, 'আমার খেলোয়াড়দের জন্য আমি সবকিছু করব। আমি তাদের জন্য লড়ব। তাদের বকা দিতে হলে আমি দিবো, কিন্তু সবার সামনে না।' এই যে সাপোর্টিভ হওয়াটা, এটা ভালো লাগতো।
সৌরভ গাঙ্গুলির বেলায় একটা ব্যাপার দেখেছিলাম, ও যখন অধিনায়ক হয়, ওর অনেক কঠিন সময় গেছে। ভারতের মতো দলে অনেক মাথা। বাংলার একটা ছেলে, ওর দলে তখন অনেক কিংবদন্তি ছিল। এদেরকে সামলানো সহজ নয়। সাহস নিয়ে সে সামলেছে। অধিনায়কত্ব করার সময় সবাইকে আন্তরিক পাবেন, এমন তো নয়। তবু হাল ছাড়া যাবে না, এমন মানসিকতার ছিলো গাঙ্গুলির। ওর সঙ্গে খেলা সবাই ওর প্রশংসাই করেছে।
তো আমার কাছে মনে হয়েছে, আমার কাজ যদি আমি সৎভাবে করি, খেলোয়াড়দের বোঝাতে পারি, যেখানে ব্যক্তিগত কিছু নেই, আগে দল; যেটা গাঙ্গুলি করতে পেরেছে। তবে কে কী করেছে, আমি বলতে পারব না। আমার কাছে মনে হয়েছে, খেলোয়াড়দের একটা ম্যাসেজ দেওয়া যে, ব্যক্তিগত কিছু নেই, সবার আগে দল। এটা করলে খেলোয়াড়রা তখন বোঝে, এই লোকটা শত্রুতামূলক কিছু করবে না। পাশাপাশি আন্তরিক হওয়া। এসব কার কাছ থেকে শিখেছি, বলতে পারব না। তবে দেখেছি কে কীভাবে অধিনায়কত্ব পালন করেন।