বয়োবৃদ্ধ বাইডেনের জন্য এবার নির্বাচনি বৈতরণি পার হওয়া কেন কঠিন হবে!
আমেরিকার ক্ষমতাসীন ডেমোক্রেট দলের জন্য ঘরোয়া রাজনীতি সুহালে নেই। দেশি-বিদেশি নানান বিষয়ে ভোটারদের মনোভাব পাল্টাচ্ছে। এনিয়ে একের পর এক উদ্বেগ ধেয়ে আসছে। যার কেন্দ্রে রয়েছে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের প্রতি নাগরিক সমর্থন হ্রাসের ঘটনা।
গত সপ্তাহান্তে তেমনই এক খবর সামনে আসে। যেখানে দেখা যাচ্ছে, নভেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে অগ্নিপরীক্ষার মুখোমখি হতে পারেন বাইডেন।
সাম্প্রতিকতম এই সতর্কবার্তার দূত হচ্ছে, দেশটির প্রভাবশালী দৈনিক দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস ও জরিপ সংস্থা– সিয়েনা কলেজ পোল। তাঁদের পরিচালিত সমীক্ষায় দেখা গেছে, ডেমোক্রেট দলের প্রার্থী নির্বাচন প্রক্রিয়া বা প্রাইমারির সমর্থক ভোটারদের মাত্র ২৩ শতাংশ বাইডেনের প্রেসিডেন্ট প্রার্থিতা নিয়ে উৎসাহী।
অন্যদিকে, ৪৫ শতাংশই মনে করছেন দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়া উচিত নয় বাইডেনের। একইসময়, ডেমোক্রেট প্রার্থীর তুলনায় রিপাবলিকান প্রাইমারিতে সমর্থনের হিসাবে পাঁচ পয়েন্ট এগিয়ে রয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
অর্থাৎ, ভোটারদের বেশিরভাগই মনে করেন আরেকদফা নির্বাচিত হওয়ার পক্ষে বাইডেন অনেক বেশি বয়োবৃদ্ধ। বয়স হলেও, অনেকেরই থাকে শারীরিক সামর্থ্য ও চাঞ্চল্য। বাইডেন সে দলে পড়েন না। তাঁকে দেখতেও লাগে একজন অতিবৃদ্ধের মতো, তিনি চলাফেরাও করেন তেমনিভাবে। আর সেটা নতুন বিষয়ও নয়।
বাইডেনের বয়স নিয়ে সমালোচনার এই দিকটি বারবার চ্যালেঞ্জ করে বিবৃতি দিয়েছে হোয়াইট হাউস। কিন্তু, তাতে ভবী ভোলবার ছিল না। অনুষ্ঠানে সরাসরি উপস্থিত থেকে বা টেলিভিশনের পর্দাতে– আমেরিকানরা তাঁদের প্রেসিডেন্টের বয়সজনিত যেসব ভুলত্রুটি স্বচক্ষে দেখছে, তা-ই বিশ্বাস করছে।
বাইডেনের বয়স ছাড়া আরো অন্যান্য বিষয়েও তাঁকে নিয়ে ভোটারদের মধ্যে তিক্ততা, বিরক্তি হয়েছে। এই নিবন্ধের মূল লেখক এনিয়ে ডেমোক্রেট সমর্থকদের সাথে কথাও বলেছেন। তাঁদের অধিকাংশের কন্ঠেই তিনি এমন বিরক্তির স্পষ্ট আভাস পেয়েছেন– যা মনে হয়েছে তাঁরা শুধু বাইডেনের পদত্যাগই যেন চান না। বরং ক্ষোভটা আরো গভীরে।
আমেরিকায় বয়স্ক নাগরিক হলেই কেউ অপছন্দের পাত্র হয়ে ওঠেন, এমন কিন্তু নয়। খোদ বাইডেনের বেলাতেই তা বলা যায়। বর্তমানে তাঁর বয়স ৮১, কিন্তু বয়সের ৭০ এর দশকটাতেও কিন্তু ভোটারদের পছন্দের পাত্র ছিলেন। এমনকি যেসব ভোটাররা তাঁকে ভোট দেওয়ার ইচ্ছেপোষণ করেননি, তাঁদের কাছেও বাইডেন একজন যোগ্য প্রার্থীই ছিলেন। আগের নির্বাচনগুলোয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেশিরভাগ ডেমোক্রেট হয়তো বারাক ওবামা বা বার্নি স্যান্ডার্সকে নিয়ে মাতামাতি করেছেন, কিন্তু বাইডেন পছন্দের খাতাতেই ছিলেন সবসময়।
২০২০ সালে বাইডেন যে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হয়েছিলেন এবং ট্রাম্পকে হোয়াইট হাউস থেকে হটাতে পেরেছিলেন– তা নিয়ে ডেমোক্রেটরা কিন্তু খুবই উচ্ছসিত ছিলেন। বাইডেনের প্রতি তাঁদের ছিল অকুন্ঠ কৃতজ্ঞতা। বাইডেন না থাকলে– সে জায়গায় বার্নি স্যান্ডার্স, এলিজাবেথ ওয়ারেন বা পিট বুটিগিগের মতো সিনিয়র ডেমোক্রেটরা কতদূর সফল হতে পারতেন ট্রাম্পের বিরুদ্ধে– তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
তাই তো ট্রাম্পের গোলযোগপূর্ণ শাসনের ইতিটানা, এবং তারপর দেশশাসনে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনার জন্য বাইডেনের অবদানকে সম্ভ্রমের চোখেই দেখেন অনেক ভোটার। এরই প্রভাব পড়েছিলে জনসমর্থনের হারে। বাইডেন ক্ষমতায় থাকার প্রথম ছয় মাসে দেখা যায়– ব্যাপক সংখ্যায় আমেরিকানরা তাঁর রাষ্ট্রপতির দায়িত্বপালনকে অনুমোদন করছেন।
কিন্তু, অনুমোদনের সেই হার তারপর অনেকটা কমে গেছে। ২০২১ সালে যেটি ৫০ শতাংশের মতো উচ্চ থাকলেও– ২০২২ ও ২০২৩ সালের অধিকাংশ সময়েই থেকেছে ৪০ শতাংশের ঘরে। নিউ ইয়র্ক টাইমস ও সিয়েনা কলেজ এর সবশেষ জরিপে তা নেমে এসেছে ৩৬ শতাংশে।
সমর্থনের এই দ্রুত পতন নিয়ে রীতিমতো হতবাক বাইডেনের টিম। কারণ, তাঁর সময়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি। ২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করাকে অনেক জরিপকারী বাইডেনের জনপ্রিয়তা হ্রাসের একটি কারণ বলে মনে করেন; কিন্তু খুব সম্ভবত তা নয়। বরং প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি এরও পরে যা যা করেছেন, তাঁরই প্রভাব পড়েছে সমর্থন হারে।
জীবন সায়াহ্নে পৌঁছানো রাজনীতিকরা যখন ক্ষমতায় টেকার চেষ্টা করেন, তখন মার্কিন ভোটাররা তা পছন্দ করেন না– এটি একটি সাধারণ বিষয়। ২০১৩ সালে যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ ছাড়েন হিলারি ক্লিনটন তখন তিনিই ছিলেন ভোটারদের কাছে বহুল পছন্দের। কিন্তু, ২০১৫ সালে যখন তিনি প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার চেষ্টা শুরু করেন, তখনই ভাটা পড়ে জনপ্রিয়তায়। বাইডেনের ক্ষেত্রেও হয়তো একই বিষয় কাজ করেছে। তাঁর প্রেসিডেন্সিকে এখন বিদায় জানাতেই ভোটাররা আগ্রহী– ক্ষমতায় আরেকবার থিতু হওয়ার চেষ্টা তাই হালে পানি পাচ্ছে না।
বাইডেনের পক্ষে যুক্তিতর্ককারীদের মধ্যে যারা সবচেয়ে ঘোরতর, এমনকি তাঁরাও ব্যক্তিগতভাবে বলছেন, বাইডেন এবার প্রার্থিতা করুক– সেটা তারা চান না। বাইডেনের কথাতেও উঠে এসেছে এর ইঙ্গিত, তিনি বলেন, "দেখুন নিজেকে আমি একটি সংযোগকারী হিসেবে দেখছি, অন্যকিছু হিসেবে কিন্তু নয়।" ২০২০ সালে ডেট্রোয়েটে আয়োজিত ওই সমাবেশে বাইডেন নিজেকে একজন অন্তর্বর্তী প্রার্থী হিসেবে অভিহিত করেন।
যুক্তরাষ্ট্রে রিপাবলিকান দলের ট্রাম্প বিরোধী সংবাদ ও মতামত প্রকাশনার ওয়েবসাইট বুলওয়ার্ক। এ গণমাধ্যমের সম্পাদক হলেন সারাহ লংঅয়েল। যিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল এবং তাঁদের নানান ধরনের সমর্থক গোষ্ঠীগুলোকে নিয়ে ফোকাস গ্রুপ আলোচনা করেছেন। তিনি দ্য আটলান্টিকে এ নিবন্ধের লেখককে বলেন, "একটা বিষয় খুবই স্পষ্ট, দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি (বাইডেন) প্রেসিডেন্ট হোক, সেটা কেউ চাইছে না।"
বাইডেনের সমর্থকদের সাথেও কথা বলে লেখক জেনেছেন, তাঁদের কাছে বাইডেন 'জরুরী মুহূর্তে ত্রাতা' এবং 'অন্তর্বর্তী প্রার্থী' হিসেবেই গ্রহণযোগ্য, এর বেশি ভোটাররা তাঁর সম্পর্কে ভাবতেও চান না। ট্রাম্প শাসনের অবসান চেয়ে তাঁরা বাইডেনকে তাৎক্ষনিক সমর্থনও দেন। কিন্তু মনে করছেন, এবার সে প্রয়োজন ফুরিয়েছে।
রাজনীতিবিদরা ক্ষমতা ধরে রাখার পথ খোলা রাখতে চান একথা সর্বজনীন। কিন্তু, বাইডেন ক্ষমতায় টিকতে চাইলে– ভোটাররা কেন নিজেদের প্রতারিত মনে করবেন নিশ্চয় তা এবার বুঝতে পারছেন।
একজন বৃদ্ধ তাঁর ভালোবাসার জিনিসকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চান। সেখানে অনুকম্পা বা সহানুভূতি জাগতেই পারে। কিন্তু, বাইডেনের ক্ষেত্রে তাঁর ঝুঁকি হবে মারাত্মক। কারণ, নিজের অশীতপর বয়স, পড়তি জনসমর্থন নিয়ে যদি তিনি আবারো ট্রাম্পের সাথে ভোটযুদ্ধে নামেন– তাহলে তিনি সবচেয়ে স্বার্থপর ও অন্ধ আত্মবিশ্বাসী ও আত্মঘাতী বলেই প্রমাণ করবেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের যেকোন প্রেসিডেন্টের চেয়ে বেশি স্বার্থপর বলে প্রমাণিতও হবেন। এবং যদি নির্বাচনে হেরে যান, তাহলে এ পরাজয় হবে আমেরিকার গণতন্ত্রের, ট্রাম্পের কট্টরপন্থার বিজয় পতাকাই তখন ঢেকে দেবে স্টারস অ্যান্ড স্ট্রাইপসের ঝান্ডা।