আরও বেশি অবৈধ ভারতীয় অভিবাসী ডাঙ্কি রুটে আমেরিকায়
উত্তর ভারতের একটি শহরের সরু গলিগুলো অসংখ্য বিলবোর্ডে সয়লাব। এসব বিলবোর্ডে অন্যরকম ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখার আহ্বান জানানো হয়েছে।
পাঞ্জাবি ভাষায় একটি সাইনবোর্ডে লেখা, 'চলো আমেরিকা যাই।'
বিলবোর্ডের সমুদ্রের মধ্যে দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাওয়া ইমিগ্রেশন এজেন্টরা যেন শহরের দ্রুত বর্ধমান অভিবাসন ব্যবসার মূর্ত প্রতীক।
দীর্ঘদিন অভিবাসন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত একজন পাঞ্জাবি এজেন্ট বলেন, 'বেশিরভাগ এজেন্ট অবৈধ রুট দিয়ে ক্লায়েন্টদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানোর চেষ্টা করেন।'
তিনি জানান, মেক্সিকো বা কানাডায় যাওয়া তার ৬০ জন ক্লায়েন্ট, বিভিন্ন ঘুরপথে গন্তব্যে পৌঁছানোর অংশ হিসেবে মার্কিন সীমান্ত হেঁটে পার হন।
পিউ রিসার্চ সেন্টারের ২০২১ সালের হিসাব অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অভিবাসীদের মধ্যে ভারতীয়দের অবস্থান তৃতীয়। দেশটিতে অবৈধ ভারতীয়ের সংখ্যা আনুমানিক ৭ লাখ ২৫ হাজার।
ল্যাটিন আমেরিকার বাইরে এই তালিকার শীর্ষ পাঁচে থাকা একমাত্র দেশ ভারত।২০১১ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ ভারতীয়দের সংখ্যা ৭০ শতাংশ বেড়েছে।
ইউএস কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশনের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে অবৈধ ভারতীয় অভিবাসীর সংখ্যা সবচেয়ে দ্রুত বেড়েছে।
অভিবাসীরা সাধারণত মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসে। তাদের অধিকাংশই নিজেদের জমি বিক্রি করে এই যাত্রার খরচ বহন করে। মাথাপিছু পরিবারগুলো ৪০ হাজার থেকে ১ লাখ ডলার পর্যন্ত খরচ করে।
তারা আশা করে আমেরিকায় কাজ করলে তারা তিনগুণ বেশি মজুরি পাবে, তাদের সন্তানদের জন্য একটি নিরাপদ ভবিষ্যৎ তৈরি হবে এবং বিয়ের বাজারে তাদের ছেলেদের দাম ও কদর বাড়াবে।
জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের অধ্যাপক দেবেশ কাপুর বলেন, এই অভিবাসীরা 'খুব দরিদ্র নয়' এবং অধিকাংশই ভারতের সবচেয়ে সমৃদ্ধ রাজ্যগুলো থেকে আসে।
কিন্তু আকর্ষণীয় চাকরির অভাব এবং ধুঁকতে থাকা কৃষিক্ষেত্রের মুখোমুখি হয়ে তারা দেখতে পান, ভারতে তাদের যে সম্পদ রয়েছে তা তাদের জীবন পরিবর্তন করার জন্য যথেষ্ট নয় এবং এর ফলে 'অভিবাসন সংস্কৃতি' তৈরি হয়।
পশ্চিম ভারতের তিনটি রাজ্যের এক ডজনেরও বেশি পরিবার এবং তাদের এজেন্টদের থেকে নেওয়া সাক্ষাৎকারে জানা যায়, ভিসা শৈথিল্য সুবিধার জন্য অভিবাসীরা নির্দিষ্ট কয়েকটি দেশের উপর দিয়ে আমেরিকা যায়। প্রতিটি জায়গায়, এজেন্টরা অভিবাসীদের তাদের পরবর্তী বিমানের টিকিট সরবরাহ করে। এভাবেই তারা একের পর এক দেশ পার হয়ে ল্যাটিন আমেরিকা বা কানাডার কাছাকাছি চলে আসে। এরপর এজেন্টকে তাদের দেওয়া টাকার অঙ্কের ওপর নির্ভর করে তারা হেঁটে, নাকি যানবাহনে করে মার্কিন সীমান্ত পার হবেন।
তাদের শিখিয়ে দেওয়া হয়, কেউ প্রশ্ন করলে তারা বলবে ভারতে তারা নিজেদের নিরাপদ বোধ করছে না।
এই পথকে 'ডাঙ্কি রুট' বলা হয়। এই পথে আমেরিকা যেতে এক ডজন দেশ পার হওয়া লাগে এবং এক বছরেরও বেশি সময় লাগতে পারে।
পাঞ্জাবের জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা এল কে যাদব 'ডাঙ্কি কেসেস' (এই পথ দিয়ে অবৈধ অভিবাসন সংক্রান্ত) তদন্তের জন্য একটি দল গঠন করেছিলেন।
তিনি বলেন, 'এই পথের বিপদ মোটেই কম নয়। দেশের যুব সমাজ এই যাত্রা সম্পর্কে 'বিকৃত তথ্য দ্বারা বিভ্রান্ত' হয়েছে।'
২৮ বছর বয়সী গুরসেবক সিং জানান, তিনি গত বছর নয়াদিল্লির একটি হোটেলে ৯ মাস অপেক্ষা করেছেন, তারপরে দুবাইয়ের একটি হোটেলে এক মাস এবং অবশেষে ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরে এক মাস অপেক্ষা করেছেন।
তিনি বলেন, 'আমরা ছিলাম খাঁচায় বন্দি পাখির মতো।'
গুরসেবক জানান, তারপর পাসপোর্টসহ তার ব্যাগটি বিমানবন্দর থেকে চুরি হয়ে যায়।
তিনি জানান, এটি ছিলএকটি বিশাল বড় ধাক্কা। এই যাত্রার খরচ জোগাতে তিনি ৩০ হাজার ডলারে এক একর জমি বিক্রি করেন, আরও দুই একর জমি বন্ধক রাখেন এবং আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে আরও ছয় হাজার ডলার জোগাড় করেন।
সম্প্রতি ভারতের হরিয়ানা রাজ্যে নিজের বাড়িতে ফিরে তিনি ফোনে স্ন্যাপচ্যাট খুলেছেন।
তিনি বলেন, 'ফোনে মেক্সিকো সীমান্ত দিয়ে নাচতে নাচতে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানো বন্ধুদের ছবি আর ছবি। তাদের পরিবার আতশবাজি পোড়াচ্ছে এবং আমেরিকান পতাকার মতো দেখতে একটি কেক কাটছে। আমার মনে হলো, আমাকে ফের যাওয়ার সুযোগ দাও।'
দুবাই ও ইস্তাম্বুল হয়ে গুরসেবকের রুট একটি পরিচিত রুট। (ডিসেম্বরে দুবাই থেকে নিকারাগুয়াগামী ৩০৩ জন ভারতীয়কে বহনকারী একটি চার্টার্ড বিমান মানব পাচারের আশঙ্কায় ফ্রান্সে আটকে দেওয়া হয়। অন্যান্য রুটগুলো হ্যানয় এবং কায়রো হয়ে গেছে।
ওই পাঞ্জাবি এজেন্ট বলেন, 'এটা বিমানের টিকিটের খেলা।'
তিনি বলেন, 'বেলারুশ সীমান্ত শক্ত, তবে সার্বিয়া থেকে হাঙ্গেরি থেকে অস্ট্রিয়া যাওয়ার রুটটি তুলনামূলক ভাল।'
অভিবাসন নিয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কঠোর বাগাড়ম্বর এবং তা দমনের প্রতিশ্রুতি কিছু ভারতীয় দমে গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই পাঞ্জাবি এজেন্ট বলেন, 'মানুষ এখন বলছে ট্রাম্প ফিরে আসার আগে দ্রুত আমেরিকা থেকে বেরিয়ে আসুন।'
ছাঁটা দাড়ি ও ভুরু কুঁচকে যাওয়া ওই ব্যক্তি অভিবাসন ব্যবসার কেন্দ্র জলন্ধরে এজেন্টের কাজ করেন।
তিনি বলেন, প্রায় দুই দশক আগে তিনি ভুয়ো ব্রিটিশ কলেজে পড়াশোনার জন্য আবেদন করে ভারতীয়দের ব্রিটেনে স্টুডেন্ট ভিসা পাওয়ার কাজ শুরু করেছিলেন। এরপর তিনি ভুয়া বিয়ের জন্য ভিসা জোগাড় করার কাজ করেন এবং এত বেশি আয় করেন করেন যে পরবর্তীতে তিনি বিয়ের পোশাকে বিনিয়োগ করেন।
আঙুল নাড়তে নাড়তে তিনি বলেন, 'প্রিন্টারে কাগজ ছাপানোর মতো দ্রুত ভিসা হয়ে যাচ্ছিল।'
তিনি প্রথমে তার ক্লায়েন্টদের ডাঙ্কি রুটে সাইপ্রাস হয়ে তুরস্কে পাঠানো শুরু করেন এবং তারপরে তিন বছর আগে তাদের আমেরিকায় পাঠানো শুরু করেন।
তিনি বলেন, ৫৫ হাজার ডলারের বিনিময়ে তিনি এখন বিমানযোগে ইতালি, তারপর মেক্সিকো এবং সবশেষে বাসে করে যুক্তরাষ্ট্র সীমান্তে অভিবাসীদের পাঠান।
নিজের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে তিনি তার এক বন্ধুর সঙ্গে গল্প করছিলেন। তার ওই বন্ধু জার্মানিতে যাওয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু বেলারুশ ও পোল্যান্ডের সীমান্তে আরও সাতজনের সঙ্গে তাকে আটক করে পুলিশ।
ওই বন্ধু জানান, তাদের বেধড়ক মারধর করা হয়, তারপর একটি গাড়ির ডিকিতে আটকে রাখা হয়। অভিবাসনপ্রত্যাশীদের একজন মারধরের শিকার হয়ে মারা যান এবং আরেকজন আত্মহত্যা করেন।
ওই এজেন্ট জানান, তিনি এই কাজ ছাড়তে প্রস্তুত। তিনি এখন ভাবছেন, তিনিই তার নিজের শেষ আমেরিকাগামী ক্লায়েন্ট হবেন কিনা।
তিনি বলেন, 'হয়ত ওখানে আমি নতুন করে শুরু করতে পারব। এরপর আমার পরিবার আমার জন্যও আতশবাজি ফোটাবে।'
হরিয়ানার বাসিন্দা ১৮ বছরের জসনপ্রীত সিং জানিয়েছেন, গত বছর আমেরিকায় যাওয়ার জন্য দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষা মিস করেন তিনি। তিনি তিনবার উজবেকিস্তান, থাইল্যান্ড ও লাওসের মধ্য দিয়ে যাওয়া রুট ব্যবহার করে আমেরিকা যাওয়ার চেষ্টা করেছেন।
তিনি বলেন, তৃতীয় প্রচেষ্টায় তিনি দুবাই বিমানবন্দরে সার্বিয়ার জাল ভিসা নিয়ে ধরা পড়েন, নির্যাতনের শিকার হন এবং এক মাস জেল খাটেন। এরপর হরিয়ানায় ফিরে আসেন।
তিনি বলেন, তার গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়ি থেকেই কাউকে না কাউকে বিদেশে পাঠিয়েছে।
তার বাবা সুরিন্দর সিং বলেছেন, 'সরকার যদি আমাদের বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে, তাদের বেতনের কথা চিন্তা করে, তাহলে কেন একটি শিশু বাইরে যাওয়ার কথা ভাববে? সবচেয়ে বড় দোষ সরকারের।'
তিনি জানান, তার ছেলের বিদেশ যাত্রার জন্য তিনি তার পরিবারের সব জমি ও গয়না বিক্রি করে দিয়েছিলেন।
সুরিন্দর জানান, এখন তার পরিবার ইমিগ্রেশন এজেন্টের কাছ থেকে টাকা ফেরত চাইছে।
সুরিন্দর তার ছেলের ব্যাপারে বলেন, 'আমরা ওকে আবার পাঠানোর চেষ্টা করতে পারি। আমরা ওকে এখানে (ভারতে) রাখব না।'
গুজরাট রাজ্যের ২৫ বছর বয়সী এক নারী জানান, তার পরিবার তাকে ডাঙ্কি রুটে আমেরিকা যাওয়া এক অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিল।
তিনি স্মরণ করেন, ২০১৭ সালে তার স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে তিনি অন্য এক গুজরাটি নারীর সঙ্গে কানাডার এক হিমশীতল জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আট ঘণ্টা ধরে ট্রেকিং করেছিলেন, সেসময় একজন এজেন্ট ফোনে তাকে দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই নারী ওয়াশিংটন রাজ্যে পৌঁছানোর আগে পুলিশ কুকুরের পাশ দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে এবং বৈদ্যুতিক বেড়ার ধাক্কায় চমকে যাওয়ার বর্ণনা দিয়েছেন।
ওই নারী বলেন, 'ওই সময় ঠান্ডায় মারা যাওয়ার চেয়ে ধরা পড়া ভালো ছিল।'
তিনি জানান, ট্রেনে করে শিকাগো পৌঁছানোর পরে, তিনি জানতে পারেন তার স্বামীর আরেক নারীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে। তবুও তারা তাদের সম্পর্কটি জোড়া লাগানোর চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটি অসহ্য হয়ে ওঠে এবং তিনি পালিয়ে আসেন।
তিনি এখন পরিচিত সব সম্ভাব্য অভিবাসীদের বৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার অনুরোধ জানান, যাতে তাদের প্রতারকদের উপর নির্ভর না করতে হয়।
পাঞ্জাবি ওই এজেন্ট বলেন, যতদিন না মার্কিন ভিসা আরও সহজলভ্য হচ্ছে, ততদিন মা ও বাবার মতো 'চাহিদা ও সরবরাহ শৃঙ্খল থাকবে'। যারা যেতে চান, তারা যে কোনো উপায়ে পৌঁছে যাবেই। আপনি তাদের কোন পথে নিচ্ছেন তা কোনো বিষয় নয়।'
ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি