পচনের গন্ধ ভাসে
আমার নানাবাড়ি রায়ের বাজার পুলপাড়। হাজারিবাগের কাছেই। ছোটবেলায় নানাবাড়ি যখন যেতাম, ট্যানারির গন্ধ নাকে লাগত আমার। কাজিনদের কাছে ওটাকে গন্ধ মনে হতো না। কারণ, এটাতে ওরা অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
ওরা ওই গন্ধটাকে আর গন্ধই ভাবছে না। ওই গন্ধে থাকতে থাকতে, গন্ধটা ওরা আর অনুভব করতে পারছে না। আমাদের সমাজের বর্তমান পরিস্থিতিও এ রকমই। আমরা এখন নানা অসঙ্গতির ভেতর, অমানবিকতার ভেতর থাকতে থাকতে, এটা যে 'অসঙ্গতি'- সেটা আর বুঝতে পারছি না।
আমরা নষ্ট সমাজে থাকতে থাকতে, সমাজটা যে পচে গেছে, আমাদের যে ব্যথা হওয়া উচিত, আমাদের যে গন্ধটা পাওয়া উচিত, সেটা পাচ্ছি না।
প্রতিটা দিন নিউজফিডে, কিংবা গণমাধ্যমে চোখ পড়লেই যত ভয়ংকর খবর তাড়া করে আমাকে। এই করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতেও থামেনি নারী নিপীড়ন; ধর্ষণের শিকার হচ্ছে শিশুরা। আসলে মানবাধিকার যেন একদম হারিয়ে গেছে।
একটা মেয়ে, সে ছয় মাসের শিশু কিংবা বৃদ্ধা হোক না কেন, আমরা প্রতিদিনই গণমাধ্যমে দেখতে পাই, তারাও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। বয়স বা কোনোকিছুই মানা হচ্ছে না। এই যে নোংরা চোখগুলো, এই যে নোংরা মানসিকতাগুলো, এটার জন্য আমাদের সামাজিক ও পারিবারিক শিক্ষা এবং মূল্যবোধের অবক্ষয়ই দায়ী।
তিন বছর আগে আমাকে যে নোংরা অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে, তাতে আমি হাড়ে হাড়ে বুঝি, এ সমাজে নারীর মর্যাদা কতটা অবহেলিত। বিবাহ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগে আমিও চেষ্টা করেছি, 'আরেকটু দেখা'র। সন্তানের কথা ভেবে, সংসারের কথা ভেবে, মুখ বুঝে সহ্য করেছি অনেক লাঞ্ছনা। কেননা, এ সমাজ আমাকে ছোটবেলা থেকেই শিখিয়েছে, মেয়েদের 'এসব' মেনে নিতে হয়।
যখন এক পর্যায়ে মনে হলো, 'আর নয়', তখন দেখেছি চারপাশের অনেকের চেহারা কেমন বদলে গেছে। আদালতে প্রথম প্রথম বোরকা পরে যেতাম। এক পর্যায়ে মনে হলো, আমি কেন মুখ লুকাব; আমি তো কোনো দোষ করিনি। সেখানে মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখেছি, কী রকম ঘৃণা, নিষ্ঠুরতা খেলা করে। যেন আমি চিড়িয়াখানার পশু, এভাবে একেক জোড়া চোখ যখন আমার দিকে বিশ্রীভাবে তাকিয়ে থাকত, তখনই আমার নাকে এসে পচনের গন্ধটা লাগত।
মাঝে মধ্যে মনে হয়েছে, বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করি, কেন আমাকে ছোটবেলা থেকে দেওয়া হয়নি সমাজে নারীর এই নিষ্ঠুর বাস্তবতার পাঠ? কেন বলা হয়নি, নারীর জন্য পৃথিবী অনেক নির্মম। কেন আমাকে সেভাবে বড় করে তোলা হয়নি? কেন তারা আমাকে পুতুলের মতো আগলে রেখেছেন; লড়তে শেখাননি? যদি তা-ই হতো, নিজের সঙ্গে কোনো অন্যায় হতে দিতাম না কিছুতেই।
''বাবা-মা তো শেখাননি, সমাজও এ ব্যাপার নিয়ে কোনো কথা বলে না। আমাদের যে সামাজিক শিক্ষা ব্যবস্থা, সেটির মান নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই প্রশ্নবিদ্ধ। একটা পুরুষকে কেন পুরুষ হয়ে উঠতেই শেখাতে হবে, একটা নারীকে কেন নারী হয়ে উঠতেই শেখাতে হবে? কেন আমরা আমাদের সন্তানদের মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিতে পারব না- এটাই আমার মূল প্রশ্ন। কারণ, মানুষ হওয়ার শিক্ষাটা দুজনেরই দরকার। একজন নারীকে যেমন মানুষ হতে পারতে হবে, তেমনই একজন পুরুষকেও। তখনই কিন্তু অন্য মানুষকে সে সম্মান করবে এবং অন্যের অধিকার, অন্যের স্বাধীনতা সম্পর্কে সে সচেতন হবে।
সেক্ষেত্রে অবশ্যই বাবা-মায়ের একটা বড় ভূমিকা আছে। কারণ, পরিবার হচ্ছে, সমাজের সবচেয়ে ছোট ইউনিট, যেখানে এই শিক্ষাটা শুরু হতে হবে। সেখানে অবশ্যই বাবা-মা সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করবে। সমাজও এটা নিয়ে কথা বলতে শুরু করবে। সমাজ ও রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব আমাদের এ ধরনের নোংরা, জঞ্জাল, অশিক্ষা, কুসংস্কার থেকে বের করে নিয়ে আসা। আসলে এটা নিয়ে আমরা সবাই মিলে কথা বলার সময় এসে গেছে।
এখন আমি অবসরের পুরোটা সময় মেয়েকে দিই। আমি যেভাবে বড় হয়ে উঠেছি অন্যদের ছায়া ও সুরক্ষায়, সেভাবে নয়; ওকে যথাসাধ্য বাস্তবতার পাঠ দিই। ওই বয়সের উপযোগী করে ওকে বোঝাই, এই সমাজে প্রকৃত মর্যাদা নিয়ে টিকে থাকতে হলে লড়তে জানতে হবে। ওকে সেভাবেই প্রস্তুত করে তুলেছি।
আমি আমার সন্তানকে অবশ্যই একজন মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠাতে চাই। ওর অধিকার সম্পর্কে সচেতন রাখতে চাই। ও স্বাধীন; ও কারও অধীনে নয়- এটা ওকে এখন থেকেই শেখাব। আমরা আসলে কেউ কারও অধীনে না, কোনো মানুষই নয়। আমাদের শিক্ষা, আমাদের মনন- এগুলো দিয়ে নিজেদেরকে ভালো করে গড়ে তুলতে হবে।
মেয়েকে আমি বলি, 'এ দেশে, এ সমাজে তুমি জন্মেছ, এ সমাজের জঞ্জাল সরানোর দায়িত্ব তোমার-আমার-সবার।'
বিদেশে যারা যান, তাদের বেশিরভাগই নিরাপত্তার কথা ভেবে এ দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। এটা তাদের ব্যর্থতা নয়। এটা আমাদের সমাজের ব্যর্থতা। কারণ ওই নিরাপত্তার নিশ্চয়তা আমরা এখানে কাউকে দিতে পারি না; বরং নিরাপত্তাহীনতায় ভুগি প্রতিনিয়ত, প্রতিদিন। এজন্যই সমাজটাকে ঠিক করার দায়িত্ব সবাইকে মিলে নিতে হবে।
- লেখক: অভিনেত্রী ও দন্ত চিকিৎসক