বঙ্গোপসাগরে জেলি ফিশের আগ্রাসন, মৎস্য আহরণ কমে অর্ধেক
বহু সংগ্রাম করে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরেন বাংলাদেশের জেলেরা, কিন্তু তাঁদের জালে ধরা পড়ছে অনাকাঙ্ক্ষিত – জেলি ফিশ। বিষাক্ত এই সামুদ্রিক প্রাণী বঙ্গোপসারের মাছ ধরার এলাকাগুলো যেন ছেয়ে ফেলেছে, ফলে জালে মাছের চেয়ে জেলি ফিশই বেশি ধরা পড়ছে।
গত বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে মাছ ধরার নৌযানগুলো ( ফিশিং ভেসেল) যে পরিমাণ মাছ ধরেছে– এবছরের একই সময়ে তা ৫০ শতাংশ কমে গেছে। জেলেদের মতে, হঠাৎ করে জেলি ফিশের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে– তাঁদের জালে মাছ কম ধরা পড়ছে।
ফলস্বরূপ; ক্রমাগত লোকসানে পড়ে জাহাজগুলো গভীর সাগর থেকে একে একে ফেরত আসছে। কর্ণফুলী নদীর তীরে এখন অলস বসে আছে শতাধিক বাণিজ্যিক ফিশিং ভেসেল। বেকার বসে আসে জাহাজের নাবিক ও ক্রুরা।
সমুদ্র বিশেষজ্ঞদের মতে, সাধারণত জেলি ফিশ সাগরের উপকূলে এবং তলদেশে বিচরণ করে থাকে। সাগরের তলদেশে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাওয়া, পানির লবণাক্তর পরিমাণ এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা সাগরের মধ্যস্তরে চলে এসেছে।
তাঁরা বলছেন, সাগরের জেলিফিশ প্রজাতির প্রাণীগুলো অত্যন্ত বিষাক্ত। এসব জেলিফিশ সামুদ্রিক মাছের জন্য মারাত্মক হুমকি। এরমধ্যে 'বক্স জেলিফিশ' মাছের জন্য সবচেয়ে বেশি ভয়ংকর। জেলি ফিশের ঝাঁক অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীকে তাদের প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থান থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
তবে ভারী বৃষ্টি হয়ে লবণাক্ততার পরিমাণ কমলেহয়তো জেলি ফিশের আধিক্যও কমবে– তখন মাছের সংখ্যা বাড়তে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএফএ) প্রেসিডেন্ট নুরুল কাইয়ুম খান টিবিএসকে বলেন, মাছ না পাওয়ায় সকল মাছ আহরণে নিযুক্ত ফিশিং জাহাজগুলো কর্ণফুলী নদীর তীরে ঘাটে অবস্থান করছে। "কয়েকটি জাহাজ মাছ আহরণে নিযুক্ত থাকলেও তাদের জাহাজে শুধু জেলি ফিশ উঠে আসছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে এ শিল্পটি ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হবে। জাহাজ পরিচালনা দুষ্কর হয়ে পড়বে। ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে জটিলতা দেখা দিবে।"
বিষয়টি স্বীকার করে সামুদ্রিক মৎস্য দপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. শওকত কবির চেীধুরী টিবিএসকে বলেন, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় মাছ আহরণ নেমে এসেছে তিন ভাগের এক ভাগে। মৎস্য আহরণকারীরা তাঁদের উদ্বেগের কথা আমাদের জানিয়েছে। সামুদ্রিক মৎস্য দপ্তর এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে। উচ্চ পর্যায়ে এই বিষয়ে জানানো হচ্ছে।
বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার বর্গকিলোমিটার অর্থনৈতিক অঞ্চল রয়েছে। এরমধ্যে বাংলাদেশ প্রায় ২৪ হাজার বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত তিনটি অঞ্চল থেকে মৎস্য সম্পদ আহরণ করে। উপকূল থেকে এসব অঞ্চলের দূরত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটার।
মাছ ধরার শিল্পে দুর্গতি
মাছ আহরণের পিক সিজন হচ্ছে অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এই সময়ে সমুদ্র শান্ত থাকে। ফলে প্রচুর পরিমাণে মৎস্য আহরণ হয়।
কিন্তু, বুধবার (২০ মার্চ) চট্টগ্রামের সদরঘাট এলাকায় দেখা যায় কর্ণফুলী নদীর দুই তীরে শতাধিক ফিশিং ভেসেল নোঙ্গর করে আছে।
নোঙ্গরে থাকা নৌযানের নাবিকরা বলছেন, সাধারণত প্রতি ট্রিপে তারা প্রায় ১০০ টনের মতো মাছ পান। তবে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকেই এর পরিমাণ ব্যাপকভাবে কমে গেছে।
যেমন ফিশিং ভেসেল 'এফবি চিংড়ি' বঙ্গোপসাগর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ করেছে ৮১ দশমিক ৮৫ মেট্রিক টন। অথচ ২০২৩ সালের একই সময়ে করেছিল ১৬১.৬৭ মেট্রিক টন।
ফিশারিজ অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, ফিশিং ভেসেলগুলো গভীর সমুদ্র থেকে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ১৯ হাজার ১০৫ মেট্রিক টন এবং ফেব্রুয়ারিতে ১৭ হাজার ৫৪৯ মেট্রিক টন মাছ আহরণ করে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাসের মাছ আহরণের তথ্য এখনও বিন্যস্ত না করা হলেও– তা আগের বছরের চেয়ে অর্ধেকেরও কম হবে বলে ধারণা করছে সংগঠনটি।
সংগঠনের কর্মকর্তারা বলছেন, ডিজেলের দাম বাড়ায় মাছ ধরার খরচও অনেক বেড়ে গেছে। প্রতি ট্রিপে (২০ থেকে ২২ দিনব্যাপী) শুধু জ্বালানি ব্যয় ৬৫ লাখ টাকা থেকে বেড়ে ১ কোটি ১০ লাখ টাকা হয়েছে।
বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মশিউর রহমান চৌধুরী বলেন, "বর্তমানে সাগরে ভালো মানের মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। যেসব মাছ পাচ্ছে যাচ্ছে তাতে নৌযানের পরিচালন ব্যয়ও উঠে আসছে না। প্রতি মাসে প্রায় ১০ হাজার মেট্রিক টন মাছ কম আহরণ হচ্ছে। প্রতি মেট্রিক টন মাছের দাম গড়ে ৮০ হাজার টাকা। সেই হিসাবে, প্রতি মাসে ফিসিং ভেসেলগুলো ৮০ কোটি টাকা টাকার মাছ আহরণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।"
সামুদ্রিক মৎস্য দপ্তরের তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে সামুদ্রিক মাছ ধরা হয়েছে ৭ লাখ ১৯ হাজার ৬১৯ টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা ছিল ৭ লাখ ৩৪ হাজার ৫৯৪ টন।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্স এর অধ্যাপক সায়েদুর রহমান চৌধুরী বলেন, জেলি ফিশের আধিক্য মানেই সমুদ্র দূষিত হয়েছে। দেশে অতিরিক্ত রাসায়নিক সারের ব্যবহার, এবং কারখানার বর্জ্য অনিয়ন্ত্রিত এবং অপরিশোধিতভাবে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়– সেগুলোও সমুদ্রে গিয়ে সমুদ্রকে দূষিত করেছে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সমুদ্রের পানিতে অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড দ্রবীভূত হয়ে সমুদ্রের অম্লতা বেড়েছে। এই পরিস্থিতি আমাদের প্রচলিত ও বাণিজ্যিক মৎস্য আহরণ উভয় খাতের জন্যই মারাত্মক হুমকি।
"তবে ভারী বৃষ্টিপাত হলে সমুদ্রে ফ্রেশ ওয়াটার যাওয়ার পরে দূষিত অবস্থা সাময়িকভাবে কমতে পারে। কিন্তু, প্রতিবছরই যদি এই সময়ে জেলি ফিশের পরিমাণ বেড়ে যায় তাহলে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি আমদের খুব সিরিয়াসলি ভাবতে হবে। এজন্য সমুদ্র দূষণ কমাতে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমনে দীর্ঘমেয়াদে আমাদের কঠোরভাবে মনোযোগ দিতে হবে"- যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট এর মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. তৌহিদা রশীদ টিবিএসকে বলেন, জেলি ফিশ বাড়ার বিষয়ে আমাদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে সমুদ্রে দুষণ বেড়ে যাওয়া। খাল ও নদী হয়ে পলিথিন, বর্জ্য, ক্যামিকেলসহ মাছ ও পানির জন্য ক্ষতিকর উপাদানগুলো প্রতিনিয়ত সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে। সৈকতের দূষণ কমাতে আমরা কাজও করছি।
"কিন্তু বিশাল সমুদ্রে দূষণ কমিয়ে আনা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। সমুদ্রের দূষণ কমাতে ব্যক্তি, পরিবার থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে," তিনি যোগ করেন।