সুনামগঞ্জে আবারও বন্যা, নেত্রকোনার শতাধিক গ্রাম প্লাবিত
দশদিনের ব্যবধানে সুনামগঞ্জে আবারও বন্যা দেখা দিয়েছে। বন্যায় জেলা শহরের বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ছাতক, দোয়ারাবাজার ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। রোববার সুরমা নদীর পানি কিছুটা কমলেও বৃদ্ধি পেয়েছে হাওরাঞ্চলে।
এদিকে, নেত্রকোনার কলমাকান্দা এবং হাওরদ্বীপ খালিয়াজুরী উপজেলায় বন্যা দেখা দিয়েছে। কলমাকান্দা উপজেলা সদরসহ আটটি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রাম দ্বিতীয় দফায় প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া খালিয়াজুরী উপজেলাতেও তিনটি ইউনিয়নের অন্তত ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। কলমাকান্দা পয়েন্টে পাহাড়ী নদী সোমেশ্বরীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
অন্যদিকে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তিস্তার পানি হুহু করে বাড়ছে। কুড়িগ্রামের ধরলা, তিস্তা, দুধকুমার ও ব্রহ্মপুত্রসহ সবকটি নদ-নদীর পানি আবারো বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে দ্বিতীয়দফা বন্যার কবলে পড়ছে এ জনপদের মানুষ। প্রতিনিধি ও সংবাদদাতার পাঠানো রিপোর্ট-
সুনামগঞ্জে দ্বিতীয় দফায় বন্যা
গত ৯ জুলাই থেকে পাহাড়ি ঢল ও বর্ষণের ফলে সুনামগঞ্জে বন্যার সৃষ্টি হয়। পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকায় সুনামগঞ্জের প্রধান নদী সুরমাসহ সীমান্ত নদী যাদুকাটা ও চলতির পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে। সুনামগঞ্জ পয়েন্টে সুরমার পানি রোববার সকাল ৯টায় বিপৎসীমার ৪২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ ঘন্টায় বৃষ্টিপাত হয়েছে ১৫০ মিলিমিটার।
পাহাড়ি ঢল ও বর্ষণে জেলা শহরের নবীনগর, কাজির পয়েন্ট, ষোলঘর, উকিলপাড়া, হাজিপাড়া, বড়পাড়া, সাববাড়ি, তেঘরিয়া, মল্লিকপুরসহ বিভিন্ন এলাকার বাসাবাড়ি দোকানপাট প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়াও পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নিম্নাঞ্চলের উপজেলাগুলোতে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
গত ২৫ জুন থেকে ২৯ জুন পর্যন্ত পাহাড়ি ঢল ও বর্ষণে সুনামগঞ্জে প্রথম দফা বন্যা দেখা দেয়। এতেও চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় জেলাবাসীকে। রাস্তাঘাট, মাছ ও ফসলেরও ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে প্রথম দফা বন্যায়। এখন দ্বিতীয় দফা বন্যায়ও আরো কয়েকগুণ বেশি ক্ষতি হবে বলে জানিয়েছে সরকারের বিভিন্ন দফতর।
শনিবার বিকেলে বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় জেলা প্রশাসন জরুরি সভা করেছে। বন্যার খোঁজ খবর নিতে প্রশাসন প্রতিটি উপজেলায় তথ্য কেন্দ্র খুলেছে। বন্যা কবলিত তিন উপজেলা দোয়ারাবাজার, ছাতক ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় ৫৫০টি পরিবার আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শনিবার বিভিন্ন এলাকায় বন্যার্ত এক হাজার ৫০০ পরিবারের মধ্যে শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, চেরাপুঞ্জিতে গত ২৪ ঘণ্টায় ৫২৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। ভারী বর্ষণের ফলে পাহাড়ি ঢল হয়ে এই পানি নিম্নাঞ্চলের জেলা সুনামগঞ্জের বিভিন্ন সীমান্ত নদী ও হাওর হয়ে জেলার বিভিন্ন উপজেলা প্লাবিত করেছে।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সবিবুর রহমান বলেন, সুনামগঞ্জের পাদদেশে অবস্থিত চেরাপুঞ্জিতে গত ২৪ ঘণ্টায় ৫২৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতে ঢলের পানি সুনামগঞ্জে চাপ সৃষ্টি করেছে। এতে সুনামগঞ্জে বন্যা দেখা দিয়েছে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবদুল আহাদ বলেন, আমরা বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে জরুরি সভা করেছি। বন্যার্ত এলাকাগুলোতে কিছু আশ্রয় কেন্দ্র খুলেছি। এ সব আশ্রয় কেন্দ্রে প্রায় সাড়ে পাঁচ শতাধিক পরিবার উঠেছে। প্রতিটি উপজেলায় তথ্য কেন্দ্র খুলে আমরা নিয়মিত খোঁজ খবর রাখছি।
নেত্রকোনায় শতাধিক গ্রাম প্লাবিত
গত তিনদিনের ভারি বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলের কারণে জেলার কলমাকান্দা উপজেলার সদর, বড়খাপন, রংছাতি, খারনৈ, নাজিরপুর, কৈলাটি, পোগলা ও লেঙ্গুরা ইউনিয়নের শতাধিক গ্রাম আবারও পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।
কলমাকান্দা-নেত্রকোনা সড়ক এবং পাবই-নেত্রকোনা সড়কের বেশ কয়েকটি জায়গা ডুবে যাওয়ায় জেলা সদরের সঙ্গে কলমাকান্দা উপজেলার যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এ ছাড়াও কলমাকান্দা-বড়খাপন, কলমাকান্দা-পাঁচগাঁও, কলমাকান্দা-খারনৈ, কলমাকান্দা-বিশরপাশাসহ বেশিরভাগ আঞ্চলিক সড়ক বন্যার পানিতে ডুবে গেছে।
কলমাকান্দা উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্স এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসারের বাসভবনসহ ছাড়াও উপজেলা সদরের থানা রোড, শিবমন্দির, বাসাউড়া, মন্তলা, চানপুর রোড, চত্রংপুর, নয়াপাড়া ও পূর্ববাজারের অসংখ্য বাসাবাড়িতে বন্যার পানি ঢুকেছে। এতে করে অনেক পরিবারে রান্নাবান্না এবং বিশুদ্ধ খাবার পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। অভাব দেখা দিয়েছে গো-খাদ্যের।
উপজেলা সদরের বিভিন্ন এলাকার বেশকিছু পরিবার কলমাকান্দা পাইলট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছে। বড়খাপন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাদিছুজ্জামান তালুকদার জানান, ওই ইউনিয়নের ৩৭টি গ্রাম বন্যা প্লাবিত হয়েছে। সব রাস্তা ডুবে গেছে। অধিকাংশ পুকুরের মাছ ভেসে গেছে।
কলমাকান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোহেল রানা বলেছেন, উপজেলার আটটি ইউনিয়নই কমবেশি প্লাবিত হয়েছে। বন্যার্তদের আশ্রয়ের জন্য বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হলে বন্যার্তদের আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেয়া হবে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
হুহু করে বাড়ছে তিস্তার পানি
প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকায় পানি ঢুকতে শুরু করায় দুর্ভোগে পড়ছে কুড়িগ্রামের মানুষ। তিস্তার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তা ব্যারাজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে ৪৪টি গেট খুলে দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। আবার ভারতের গজলডোবা ব্যারাজের সবকটি গেট খুলে দেওয়ায় কারণেও বাড়ছে তিস্তার পানি।
অন্যদিকে তিস্তা তীরবর্তী লালমনিরহাটের নিম্নাঞ্চল আদিতমারী, কালীগঞ্জ, হাতীবান্ধা ও সদর উপজেলার মানুষ পানি বন্দি হয়ে পড়ছেন। তবে ধরলার পানি এখনও বইছে বিপৎসীমার নিচ দিয়ে।
তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম জানান, পানিবৃদ্ধি অব্যাহত আছে। বর্তমানে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ১২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম জানান, আরও দুটি ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এতে বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মেহেদী হাসান জানান, পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে; যা আগামী দুই দিনের মধ্যে আরও বাড়তে পারে।