অগ্নিকাণ্ডের বছরঘুরে এলেও ঈদে ব্যবসা জমেনি বঙ্গবাজারে
প্রতিবার রমজানের মতো এবারও রাজধানীর বঙ্গবাজারে পোশাক বিক্রির জন্য ক্রেতাদের অপেক্ষায় রয়েছেন সাহাবুদ্দিন। তবে, এ বছর পরিস্থিতিটা ভিন্ন।
বাঁশের তৈরি একটি অস্থায়ী দোকানে পণ্য তুলেছেন তিনি। বাঁশের ওপরে কাপড় টাঙিয়ে নিচে টেবিলের ওপর দোকানের মালামাল সাজিয়েছেন।
বছরখানেক আগে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে দোকানপাট পুড়ে যাওয়ার পর সাহাবুদ্দিনের মতো প্রায় ১,৬০০ ব্যবসায়ী মার্কেট চত্বরে ঠিক একইভাবে ব্যবসা করছেন।
সোমবার (১৮ মার্চ) ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসয়ী সাহবুদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সকাল থেকে ১২ পিস প্যান্ট বিক্রি করেছি। অথচ এই ঈদের সময় প্রতিদিন ৭০-৮০ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি করতাম। ৩৫ লাখ টাকার পণ্য দোকানে আগুনের পুড়ে গেছে। এরপর থেকে ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে ধার করে কিছু পণ্য কিনে চৌকি পেতে ব্যবসায় শুরু করেছি। কিন্তু বিক্রিতো তেমন নেই।"
দোকান পুড়ে যাওয়ার পরে এনেস্কো টাওয়ারে দোকান নিয়ে ব্যবসা করা এক ব্যবসায়ী টিবিএসকে বলেন, "বঙ্গবাজারের মতো বেচাকেনা নেই এই মার্কেটে। জায়গাও পাইনি বেশি। শুনছি নতুন মার্কেট হচ্ছে। মার্কেট নির্মাণ শেষ হলে যদি ভাগ্য খোলে!"
বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের স্থানে ১০তলা বিপণিবিতান নির্মাণ করবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি)। প্রায় ৩৮৬ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রস্তাবিত এই বিপণিবিতানের নির্মাণকাজ আগামী ৪ বছরের মধ্যে শেষ করার সময় ধরা হয়েছে। নির্মাণকাজ শেষে নতুন বিপণিবিতানে উঠতে পারবেন ক্ষতিগ্রস্ত দোকান মালিকরা।
গত বছর ৪ এপ্রিল ভোরে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে। সেদিন ফায়ার সার্ভিসের প্রায় ৫০টি ইউনিটের সাড়ে ৬ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু ততক্ষণে পুড়ে যায় বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের পুরোটাই।
ঈদে ব্যবসা নেই বঙ্গবাজারে
বঙ্গবাজারে সাধারণত রমজান শুরু হওয়ার ১৫ দিন আগে থেকে রমজানের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত পাইকারি বেচাকেনা হয়। কিন্তু ৪ এপ্রিল অগ্নিকাণ্ডে পুরো বঙ্গবাজার পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার পর সেখানকার ব্যবসায়ে ধস নামে।
মিম ফ্যাশনের মালিক সাহবুদ্দিন জানান, "দোকানের সব মাল পুড়ে গেছে। ৩৫ লাখ টাকার মধ্যে ২১ লাখ টাকার পণ্যই ছিল বাকিতে বা ধার করে আনা। এখন যাদের কাছ থেকে বাকিতে পণ্য এনেছি তারা টাকা চাচ্ছে। যা বিক্রি করি সেটা দিয়ে সংসার চলাই কঠিন। ধারের টাকা শোধ করবো কীভাবে?"
"আগে যেভাবে বিক্রি হতো এখন সেটা হয়না। পাইকরি পণ্য কিনতে সারাদেশে থেকে ব্যবসায়ীরা এখানে আসতো, এখন তারা সদরঘাটের কালিগঞ্জসহ অন্য জায়গায় চলে যায়। যেখানে আমরা পাইকারি বিক্রি করতাম, এখন আমরা খুচরাও বিক্রি করি," যোগ করেন তিনি।
আগুনে পোড়ার আগে প্রতিবছর ঈদের এ সময়টাতে ক্রেতাদের ভিড়ে মুখর থাকতো বঙ্গবাজার। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বেচাকেনার এতই চাপ থাকতো যে, দম ফেলানোর সময় পেতেন না ব্যবসায়ীরা। কিন্তু এবার চিত্রটা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
রাজধানীর বঙ্গবাজার ঘুরে দেখা যায়, বেশিরভাগ বিপণি বিতান ফাঁকা। ক্রেতা নেই। নতুন নতুন ঈদের জামা-কাপড়ের পসরা সাজিয়ে মন খারাপ করে বসে আছেন বিক্রেতারা।
গত রমজান মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আগুনে পুড়েছিল বঙ্গবাজার। আগুন লাগার পর ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে প্রথমে চৌকি পেতে ব্যবসা শুরু করে সাহবুদ্দিনের মতো ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা। ঈদের আগে তাই তারা খোলা আকাশের নিচে বসেছিলেন পণ্য নিয়ে। তবে রোদ আর পণ্য সাজিয়ে রাখার জায়গা না থাকায় ভালো বিক্রি হয়নি বলে জানিয়েছিলেন ব্যবসায়ীরা।
রবিন গার্মেন্টসের বিক্রতা মোহম্মদ আলমগীর বলেন, "পাইকারি বিক্রি ৭০ শতাংশ কমে গেছে আমাদের। যারা অন্য জায়গায় থেকে পণ্য কেনা শুরু করেছে, তারা অনেকেই এখানে আর আসছেন না। অনেকে মনে করেন, এখানে আগের মতো অত পোশাক পাওয়া যাবে না। সব মিলিয়ে বিক্রি কম।"
তিনি বলেন, "যারা চাকরিজীবী আছে তারা বেতন পেলে আশা করি কিছুটা বিক্রি বাড়বে আমাদের।"
মার্কেটটা যেন দ্রুত তৈরি হয়– প্রত্যাশা ব্যবসায়ীদের
আগুনে পুড়ে যাওয়া ঢাকার ফুলবাড়িয়ার বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের স্থানে বিপণিবিতান নির্মাণ করবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। জানানো হয়েছে, নির্মাণকাজ শেষে নতুন বিপণিবিতানে উঠতে পারবেন ক্ষতিগ্রস্ত দোকানমালিকেরা। তবে এ মার্কেট যেন দ্রুত নির্মাণ হয় এটাই এখন চাওয়া ব্যবসায়ীদের।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রকৌশল বিভাগ টিবিএসকে জানায়, প্রায় ১৭৬ শতাংশ জমির ওপর একটি বেজমেন্টসহ ১০তলা এই বিপণিবিতানের নির্মাণকাজ ঈদের পরে শুরু হতে পারে। বিপণিবিতানের নির্মাণব্যয়ের পুরো টাকা দোকানমালিকদের কাছ থেকে নেওয়া হবে।
ভবনটির ৪টি ব্লকে সর্বমোট ৩,২১৩টি দোকান তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। এক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের বাইরে ২৪৪টি দোকান থাকবে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি বলছে, ভবনটির প্রতি বর্গফুটের নির্মাণ ব্যায় পরবে ৫,৫০০ টাকা করে। আর দোকানগুলোর প্রতি বর্গফুটের দর ধরা হবে ১৮,০০০ টাকার কম/বেশি।
ভবনটি নির্মাণে নিয়োগকৃত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হলো এনডিই ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, "রোজার মধ্যে নতুন ভবনের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন হওয়ার কথা। আমরা চাই দ্রুত যেন এ ভবন তৈরি হয়।"
ক্ষতিগ্রস্ত দোকান মালিকদের ক্ষতিপূরণের টাকার বিষয়ে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম বলেন, "আমাদের কাছে ৬ কোটি ২৭ লাখ টাকা আছে এবং বাকি ১৫ কোটি টাকা সরকারের কাছে জমা আছে। প্রধানমন্ত্রী ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়দের নিয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বসবেন এবং এ টাকাগুলো হস্তান্তর করবেন।"
তিনি বলেন, সিটি কর্পোরেশনের নিবন্ধন অনুযায়ী বঙ্গবাজার মার্কেটে ২,৯৬১ জন বৈধ ব্যবসায়ীর তালিকা আছে। অনুদানের টাকা প্রাপ্তি ও দোকান বরাদ্দের ক্ষেত্রে তারাই অগ্রাধিকার পাবেন।
এর বাইরে যেসব ব্যবসায়ীরা ছিলেন, তাদের কোনো সুযোগ দেওয়া সম্ভব হবে না বলে জানান তিনি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির চিফ এস্টেট অফিসার কাইজার মোহাম্মদ ফারাবী বলেন, "বঙ্গবাজার নিয়ে সোমবার (১৮ মার্চ) সিটি কর্পোরেশনরে একটি মিটিং হয়েছে, সেখানে নতুন ভবনের ডিজাইনে কিছু পরিবর্তন এসেছে। ঈদের পরেই প্রধানমন্ত্রী কমপ্লেক্সের কাজের ভিত্তি স্থাপন করবেন। এরপরে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে দোকান বরাদ্দের জন্য আহবান করা হবে।"
তিনি বলেন, "এ মার্কেটে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে বঙ্গবাজার অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের। ক্ষতিগ্রস্ত লিস্টেড ব্যবসায়ীদের আবেদনের পরে যে কয়টি দোকান খালি থাকবে, সেগুলোর জন্য ওপেন প্রসেসে আবেদন নেওয়া হবে। আবেদন বেশি পড়লে লটারির ব্যবস্থা করা হবে। তবে এক্ষেত্রে দোকানের জন্য সবাইকেই সালামি ও নির্মাণের ব্যায়ের নির্দিষ্ট টাকা দিতে হবে।"