ছোট কাচাতিভু দ্বীপ শ্রীলঙ্কাকে ‘দায়িত্বহীনভাবে’ দিয়ে দেওয়া হয়েছিল: অভিযোগ মোদির
ভারত ও শ্রীলঙ্কাকে পৃথককারী পক প্রণালীতে অবস্থিত ছোট্ট একটি দ্বীপ কাচাতিভু। জনবসতিহীন এই দ্বীপটি শ্রীলঙ্কার অংশ। ভারতে সাধারণ নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে দ্বীপটি নিয়ে দেশটিতে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। খবর বিবিসির।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্প্রতি বিরোধী দল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে অভিযোগের পর দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। সম্প্রতি মোদি বলেছেন যে, তৎকালীন ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দ্বীপটিকে 'দায়িত্বহীনভাবে' শ্রীলঙ্কাকে দিয়ে দিয়েছিল।
দ্বীপটির আয়তন প্রায় ১.৯ বর্গ কিলোমিটার (০.৭ বর্গ মাইল)। এটি ভারতের তামিল নাড়ু রাজ্যের রামেশ্বরম শহরের উত্তর-পূর্বে এবং শ্রীলঙ্কার জাফনা শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত।
দ্বীপটিতে সুপেয় পানির কোনো উৎস নেই। সেখানে একমাত্র অবকাঠামো বলতে একটি গির্জা, যেখানে বছরে একবার তিন দিনের একটি উৎসব হয়ে থাকে। ভারত ও শ্রীলঙ্কা উভয় দেশের উপাসক বা প্রার্থনাকারীরা এ উৎসবে যোগ দেন।
১৯২১ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ উপনিবেশ ভারত ও শ্রীলঙ্কা (তৎকালীন সিলন) উভয় দেশের শাসকই কাচাতিভু দ্বীপের চারপাশে মাছ ধরার অধিকার দাবি করেছিল। কিন্তু ১৯৭৪ সালে ভারত এ দ্বীপের ওপর সব ধরনের দাবি থেকে সরে আসে। এর দুই বছর পর উভয় দেশের মধ্যে একটি চুক্তি হয়। এ চুক্তির ফলে উভয় দেশের লোকেদের দ্বীপটির চারপাশে মাছ ধরা বন্ধ হয়ে যায়।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বর্তমান বিরোধী দল ও তৎকালীন ক্ষমতাসীন কংগ্রেসের বিরুদ্ধে দ্বীপটিকে 'দায়িত্বহীনভাবে' শ্রীলঙ্কাকে দিয়ে দেওয়ার অভিযোগ তোলার পর কয়েক দশক পুরনো ইস্যুটি নতুন করে আবারও সামনে এসেছে।
মোদির এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে কংগ্রেস। দলটি বলছে, নির্বাচন নিয়ে মোদি এখন 'হতাশা'র মধ্যে রয়েছেন। তাই নির্বাচনের আগে আগে তিনি বিরোধীদের সম্পর্কে এ অভিযোগ তুলেছেন।
দলটির নেতাকর্মীরা এও বলছেন যে কাচাতিভু ইস্যুটি তামিল নাড়ুতে খুবই সংবেদনশীল। মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্যটিতে ভোট পাওয়ার জন্য এটিকে বিতর্কে পরিণত করার চেষ্টা করছে।
উল্লেখ্য, আগামী ১৯ এপ্রিল প্রথম ধাপে তামিল নাড়ুতে সাধারণ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।
গত রবিবার এক্সে (সাবেক টুইটার) এক পোস্টে ভারতীয় গণমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়ার একটি নিবন্ধ শেয়ার করে মোদি উল্লেখ করেন, 'অপ্রত্যাশিত ও অত্যন্ত বিস্ময়কর! নতুন খবর সামনে এসেছে। কংগ্রেস দায়িত্বহীনভাবে কাচাতিভুকে শ্রীলঙ্কাকে দিয়ে দিয়েছিল।'
তার এই পোস্টের পর থেকে এ নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়।
তামিল নাড়ুর বিজেপি প্রধান কে আন্নামালাইয়ের কাছ থেকে পাওয়া বেশ কিছু তথ্যের ওপর ভিত্তি করে মোদি এ পোস্ট করেন।
এসব তথ্য অনুযায়ী, ভারতের সে সময়কার প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন যে তার কাছে 'কাচাতিভু অতোটা গুরুত্বপূর্ণ নয় এবং এর ওপর দাবি ছেড়ে দিতে তার কোনো দ্বিধা নেই।'
এরপর ১৯৭৪ সালে নেহরুর মেয়ে ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ভারত সরকার দ্বীপটি নিয়ে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বিরোধের অবসান ঘটায়।
তখন থেকেই তামিলনাড়ুর রাজনৈতিক দলগুলো নিয়মিত কাচাতিভু ইস্যুটি নিয়ে সোচ্চার ছিল। দলগুলো শ্রীলঙ্কার সঙ্গে হওয়া সেই চুক্তির বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করে একাধিক মামলাও করেছে, যার মধ্যে দুইটি মামলা সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন।
এছাড়াও তামিল নাড়ুর জেলেরা মাছ ধরতে কাচাতিভুর চারপাশে ও শ্রীলঙ্কার জলসীমায় প্রবেশ করলে তাদের আটক করতে থাকে শ্রীলঙ্কার কর্তৃপক্ষ। তাই ইস্যুটি প্রায়ই খবরের শিরোনাম হতো।
মোদির পোস্টের পর আরও অনেক বিজেপি নেতা এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা কংগ্রেসের সমালোচনা করতে শুরু করেন। তারা আরও বলেছেন যে ১৯৭৪ সালে ক্ষমতাসীন ও তামিল নাড়ুর বর্তমান সরকার দ্রাবিড় মুন্নেত্র কাজাগম (ডিএমকে) কাচাতিভুকে ধরে রাখার জন্য যথেষ্ট কাজ করেনি।
তবে ডিএমকে এটি অস্বীকার করে বলেছে যে চুক্তিটি সম্পূর্ণ না হওয়ার আগেই যে দ্বীপের ওপর থেকে দাবি ছেড়ে দিতে হবে, সেই সিদ্ধান্তের কথা তারা জানতেন না।
ডিএমকের মুখপাত্র সারাবানান আন্নাদুরাই বলেছেন, 'কাচাতিভু নিয়ে জেলেদের অধিকারের পক্ষে ডিএমকে গত কয়েক দশকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে বেশ কয়েকটি চিঠি লিখেছে। কিন্তু যখন নির্বাচন ঘনিয়ে এসেছে, ঠিক তখন বিজেপি ইস্যুটি নিয়ে সোচ্চার হয়েছে।'
এমনকি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন যে 'বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে জনসাধারণের দৃষ্টির আড়ালে রাখা হয়েছিল।'
শ্রীলঙ্কার সাথে হওয়া সেই চুক্তিটি পুনর্বিবেচনা করা হতে পারে কি না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বিষয়টি আদালতে রয়েছে।
২০১৩ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে সুপ্রিম কোর্টকে জানানো হয় যে তারা শ্রীলঙ্কার কাছ থেকে কাচাতিভু 'পুনরুদ্ধার' করতে পারবে না, কারণ 'ভারতের অন্তর্গত কোনো অঞ্চল হস্তান্তর করা হয়নি কিংবা সার্বভৌমত্ব ছেড়ে দেওয়া হয়নি।'
পরের বছর মোদি সরকারের আইনজীবী সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মুকুল রোহাতগি আদালতকে বলেছিলেন, কাচাতিভু ফেরত পেতে হলে 'যুদ্ধে নামতে হবে'।
যদিও আন্নামালাই সাংবাদিকদের জানিয়েছেন যে তামিল নাড়ুর জেলেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার কাচাতিভু 'ফেরত আনার' চেষ্টা করছে।
এ বিষয়ে জানতে ভারতে শ্রীলঙ্কার হাই কমিশনে বিবিসির পক্ষ থেকে ই-মেইল পাঠানো হয়। তবে এখনও তাদের সাড়া পাওয়া যায়নি।
শ্রীলঙ্কার একজন মন্ত্রী ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকাকে বলেছেন, কাচাতিভুর নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত বিষয়ে ভারতের কাছ থেকে কোনো 'আনুষ্ঠানিক বার্তা' শ্রীলঙ্কা পায়নি।
অনুবাদ: রেদওয়ানুল হক