করোনার প্রভাবে পানের বাজারে ধস
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে পানের দাম কমে যাওয়ায় রাজশাহীতে লোকসানে পড়েছেন পানচাষীরা। কয়েকগুণ লোকসান গুণে তাদেরকে পান বিক্রি করতে হচ্ছে। এতে মূলধন তুলতেই হিমশিম খাচ্ছেন তারা।
চাষিরা বলছেন, আগে যে দামে পান বিক্রি হতো তার থেকে কয়েকগুণ কম দামে এখন বিক্রি করতে হচ্ছে। এ ছাড়া বরজ থেকে পান ভাঙতে যে শ্রমিক খরচ হয় পান বিক্রি করে সেই টাকা তোলাই কঠিন হয়ে পড়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে মানুষ পান খাওয়া অনেক কমিয়ে দিয়েছে। এতে চাহিদার তুলনায় বাজারে সরবরাহ বেশি থাকছে। এ ছাড়া বিদেশে পান রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। সামগ্রিক কারণে বাজারে পান বেশি থাকায় দাম কম।
চাষিরা জানান, উৎপাদন ভালো হলেও বড় যে পান করোনার প্রকোপের আগে বিক্রি হয়েছে ৭০ টাকা বিড়া সেই পান এখন বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ১৫ টাকায়। এ ছাড়া ছোট যে পান বিক্রি হয়েছে ৫০ টাকায় এখন তা বিক্রি হচ্ছে দুই থেকে তিন টাকা বিড়া। এক বিড়াতে পান থাকে ৬৪টি। অথচ রাজশাহীতে চৈত্র, বৈশাখ মাসে ২৫০ টাকায় এক বিড়া পান বিক্রির রেকর্ড রয়েছে। সারা বছরই রাজশাহীতে পান উৎপাদন হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, চলতি বছর রাজশাহীতে চার হাজার ৩১১ হেক্টর জমিতে পান উৎপাদন হয়েছে ৬৮ হাজার ৯৭৬ টন। গড়ে ৪০ টাকা বিড়া ধরে এক টন পানের দাম দাঁড়ায় এক লাখ ৬০ হাজার টাকা। রাজশাহীতে বছরে এক হাজার ১০৩ কোটি ৬১ লাখ টাকার পান বেচাকেনা হয়। যা আমের চেয়েও বড় বাজার।
সংস্থাটি আরও জানায়, পান চাষের সঙ্গে জড়িত আছেন রাজশাহীর ৬৯ হাজার ২২৮ জন কৃষক। প্রধানত রাজশাহীর মোহনপুর, দুর্গাপুর ও বাগমারা উপজেলায় পান চাষ হলেও মোহনপুর উপজেলাতে উৎপাদন হয় সবচেয়ে বেশি।
মোহনপুরের ধুরইল গ্রামের পানচাষী রফিকুল ইসলাম বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে এ বছর বিদেশে পান রপ্তানি করা যায়নি। এ কারণে পানের দাম খুবই কম।
''এক বিড়া পান গতবছর এই সময়ে বিক্রি হয়েছে ৬০ টাকা থেকে ৭০ টাকা দরে। সেই পান এখন বিক্রি হচ্ছে বিড়াপ্রতি ১০ টাকা থেকে ১৫ টাকায়। আর ছোট যে ৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে সেই পান এখন বিক্রি হচ্ছে বিড়া প্রতি দুই টাকা দরে। পান বিক্রি করে লেবারের খরচটাই উঠছে না'', বললেন রফিকুল ইসলাম।
মোহনপুরের হলিদাগাছী গ্রামের কৃষক আবুল কালাম জানান, ভোর থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত পান ভাঙতে খাওয়া দাওয়াসহ একজন শ্রমিককে খরচ দিতে হয় ৫০০ টাকা। এখন অবস্থা এমন, পান ভেঙে বিক্রি করে তাতে শ্রমিকের পয়সা হয়না।
তিনি জানান, এক পোয়াতে ৩২ বিড়া পান থাকে। এক পোয়া পানের দাম ১০০ থেকে ৫০০ টাকা। অর্থাৎ বিড়া প্রতি পানের দাম পড়ে দুই টাকা থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত। লকডাউনের পর থেকে পানের দাম কমে গেছে।
দাম কমার বিষয়ে মোহনপুরের আমরাইল গ্রামের সুমন আলী নামে এক কৃষক জানান, করোনার কারণে দূরদুরান্ত থেকে পাইকাররা আসতে পারছেন না। অনেকে যেখানে দিনে ৫০টি পান খেতেন এখন সেখানে সর্বোচ্চ পাঁচ/ছয়টি পান খাচ্ছেন।
''আবার অতিবৃষ্টিতে মোহনপুরের নিমাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় অনেকে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি পান ভেঙে হাটে বিক্রি করছেন। ফলে পানের দাম কম হচ্ছে। আবার হাট ঠিকমত না বসার কারণেও পান কম দামে বিক্রি হচ্ছে'', যোগ করেন তিনি।
ধুরইল গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম নামে আরেক কৃষক জানান, এক বিঘা জমিতে বছরে পান উৎপাদন, রক্ষণাবেক্ষণ ও শ্রমিকের খরচ পড়ে এক লাখ ৩০ হাজার টাকা। সেখানে সর্বনিম্ন তিন লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। এ বছর খরচের টাকা তোলাই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শামসুল হক বলেন, রাজশাহীতে আমের বাজারের চেয়েও পানের বাজার বড়। আম তো বেচাকেনা হয় দেড় থেকে দুই মাস ধরে। আর পান সারাবছরই পাওয়া যায়।
''করোনাকালীন দুর্যোগের কারণে অনেকেই পান খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। ছোট ছোট ভাসমান পানের দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। বড় অনেক দোকানও বন্ধ রয়েছে। এ সব কারণে পানের দাম এখন কিছুটা কম। এ ছাড়া রাজশাহীর পান মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, কুয়েত, আবুধাবিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হত। এখন তো বিমান চলাচল বন্ধ, তাই রপ্তানিও বন্ধ'', যোগ করেন শামসুল হক।