বৈশ্বিক সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে বাংলাদেশের সম্ভাবনা কতটুকু বাস্তবসম্মত?
মাইক্রোচিপকে বলা হয় বিশ্বের নতুন তেল সম্পদ। এটি এমন দুর্লভ ও প্রয়োজনীয় সম্পদ যা আধুনিক বিশ্বের জ্বালানি হিসেবে কাজ করবে। 'চিপ ওয়ার: দ্য ফাইট ফর দ্য ওয়ার্ল্ডস মোস্ট ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি' বইতে এমনটাই বলেছেন লেখক ক্রিস মিলার। ক্ষেপণাস্ত্র থেকে শুরু করে মাইক্রোওয়েভ; স্মার্টফোন থেকে পুঁজিবাজার ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই রয়েছে চিপের দখল।
বাড়িতে থাকা যেকোনো প্রয়োজনীয় বৈদ্যুতিক জিনিসপত্রে (কম্পিউটার, ওয়াশিং মেশিন, বৈদ্যুতিক কেটলি, অটোমোবাইল) সেমিকন্ডাক্টর বা মাইক্রোচিপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর তাই প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধনে ভবিষ্যতে সেমিকন্ডাক্টর মানুষের ব্যবহৃত বেশিরভাগ ডিভাইসের জন্য অপরিহার্য বলে প্রমাণিত হবে।
ম্যাককিন্সির মতে, গ্লোবাল সেমিকন্ডাক্টর বাজার ২১ শতকের সবচেয়ে সম্ভাবনাময়ী শিল্প। ধারণা করা হচ্ছে, এটি ২০৩০ সালের মধ্যে ট্রিলিয়ন ডলারের বাজারে পৌঁছাবে। ইতোমধ্যেই খাতটি ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হারে ২০২১ সালে ৬০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
বাংলাদেশও বিকাশমান সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে যুক্ত হচ্ছে; তবে বর্তমানে তা খুবই ক্ষুদ্র পরিসরে। এক্ষেত্রে উলকাসেমি, নিউরাল সেমিকন্ডাক্টর, প্রাইম সিলিকন ও টোটন ইলেকট্রনিক্সের মতো বেশ কয়েকটি কোম্পানি কাজ করছে। এছাড়াও ওয়ালটন ও এসিআই-এর মতো বড় কোম্পানিও এই বাজারে প্রবেশ করতে চলেছে।
ইন্ডাস্ট্রি ইনসাইডারদের মতে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট (আইসি) ডিজাইন করে বাংলাদেশ বছরে প্রায় ৫ মিলিয়ন ডলার আয় করে। এক্ষেত্রে ভবিষ্যতে দেশে চিপ শিল্প আরও বিকাশমান হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান গত বছর এক অনুষ্ঠানে জানান, আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশের ৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের সেমিকন্ডাক্টর রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে।
এক্ষেত্রে দেশে বিদ্যমান সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানিগুলোর মধ্যে উলকাসেমি সবচেয়ে পুরোনো। ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিটি অত্যাধুনিক চিপ ডিজাইন করে থাকে। একইসাথে টেস্ট প্রোগ্রাম ডেভেলপমেন্ট, চিপ টেস্টিং ও প্যাকেজিং করার মাধ্যমে কোম্পানিটি প্রিফেব্রিকেশন সার্ভিস প্রদান করে থাকে।
কোম্পানিটি পরবর্তী প্রজন্মের ইলেক্ট্রনিক ফ্ল্যাগশিপ প্রোডাক্ট লাইন যেমন মোবাইল ডিভাইস, নেটওয়ার্কিং, কমিউনিকেশন চিপস, কমপ্লেক্স রাউটার/সুইচ, ক্লাউড সার্ভার ও স্টোরেজ, চিকিৎসা সরঞ্জাম, ইমেজিং ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে সর্বাধুনিক নোড ব্যবহার করে কাস্টম আইসি ডিজাইন কাজ করে থাকে।
কোম্পানিটির প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ এনায়েতুর রহমান সম্প্রতি বাংলাদেশে সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের সম্ভাবনা নিয়ে নিজের ভাবনা প্রকাশ করেছেন। মূলত সিলিকন ভ্যালিতে তার বছরব্যাপী অভিজ্ঞতা এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশের চিপ শিল্পে নেতৃত্ব প্রদানের প্রচেষ্টা থেকে তিনি কথাগুলো বলেছেন।
এনায়েতুর রহমান বলেন, "সিলিকন ভ্যালিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে আমি বিশ্বাস করি যে, বাংলাদেশে সেমিকন্ডাক্টরের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রয়েছে। উলকাসেমি ও সমমনা কোম্পানিগুলোর সুযোগ, দক্ষতা এবং তাদের কাজ প্রমাণ করে বাংলাদেশ এই ক্ষেত্রে কাজ করতে প্রস্তুত।"
দ্রুত বর্ধনশীল সেমিকন্ডাক্টর বাজারের শিল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এই ব্যাপারে বেশ ইতিবাচক। তারা মনে করেন শিল্পটিতে বাংলাদেশ মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে।
কিন্তু এটি বাস্তবায়ন করতে বাংলাদেশের উচ্চ-মূল্যের চিপ ডিজাইনের জ্ঞান ও দক্ষতার দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। কারণ এটি বাজারকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করতে এবং নতুন প্রযুক্তি তৈরিতে সাহায্য করতে পারে। এতে করে দেশে শিল্পটি নেতৃত্বস্থানীয় অবস্থানে থেকে লাভবান করতে পারে।
বর্তমানে উদীয়মান শিল্পটির মুখ্য চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে অবকাঠামো, দক্ষ শ্রম এবং বিনিয়োগ। বাংলাদেশে এখনও উন্নত সেমিকন্ডাক্টর ফ্যাব্রিকেশন সুবিধার অভাব রয়েছে। দক্ষ চিপ ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারের সংখ্যা এখনও অপর্যাপ্ত। এছাড়া সেমিকন্ডাক্টর খাতে বিনিয়োগ করতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়।
এনায়েতুর রহমান বলেন, "২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের বিশ্বব্যাপী এক ট্রিলিয়ন ডলার বাজারের ২ থেকে ৪ ভাগ দখলের সম্ভাবনা রয়েছে। তবে তা অর্জনে বেশকিছু পদক্ষেপ নিতে হবে।"
তার মধ্যে সরকারি বিনিয়োগ, দক্ষ জনশক্তি উন্নয়ন, উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা, গবেষণা ও উন্নয়ন, অনুকূল নীতি সহায়তা এবং বৈশ্বিক অংশীদারিত্বের বিষয়টি তিনি তুলে ধরেন।
যদিও বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যেই শিল্পটিতে বিনিয়োগ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছে; টেক পার্ক নির্মাণ যার মধ্যে অন্যতম। তবে খাতটির সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা পরামর্শ দিয়েছেন যে, সরকারি ও বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই বিনিয়োগ বাড়ানো উচিত।
এছাড়া দেশে দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। বাংলাদেশে যদিও বহু প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানী আছে। তবে চিপ ডিজাইন ও প্রিফেব্রিকেশন সেক্টরে দক্ষ কর্মীর অভাব রয়েছে। এক্ষেত্রে কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান চিপ ডিজাইন ও প্রিফেব্রিকেশন কোর্স অফার করছে। কিন্তু এসব কোর্সের সংখ্যা ও মান পর্যাপ্ত নয়।
বাংলাদেশের রপ্তানি বহুমুখীকরণ প্রশ্নে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা হচ্ছে। এক্ষেত্রে মোট তিনটি ধারায় তা হতে পারে। প্রথমে গার্মেন্টস শিল্পের মধ্যে আরও বৈচিত্র্যের সুযোগ রয়েছে। দ্বিতীয়ত, গার্মেন্টস নয় কিন্তু শ্রমঘন শিল্প যেগুলো রয়েছে সেগুলোতেও সুযোগ রয়েছে। যেহেতু আমাদের দেশে এখনও শ্রমের উদ্বৃত্ত রয়েছে। সস্তা শ্রমকে কাজে লাগিয়ে গার্মেন্টস শিল্প যা করেছে তা চামড়া বা নতুন শিল্পের মতো অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী শিল্পেও অনুসরণ করা যেতে পারে। এতে আমাদের সবচেয়ে বড়ও সুবিধা হচ্ছে তৈরি পোশাকের মতো সস্তা শ্রম।
এই বিষয়ে অর্থনীতিবিদ সৈয়দ আখতার মাহমুদ বলেন, "প্রকৃতপক্ষে আমাদের আরও জটিল শিল্পের দিকে যাওয়া উচিত যেখানে আমরা শ্রম ব্যবহারের সাথে সাথে ধীরে ধীরে দক্ষ শ্রমের ব্যবহারেও অগ্রসর হবে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমাদের এমন একটি শিল্পে এগিয়ে যেতে হবে।"
তিনি মনে করেন, তুলনামূলক শ্রম সুবিধার ক্ষেত্রে যে আরএমজি সেক্টর বিশেষ সুবিধা পেয়েছে, দেশে দক্ষ শ্রমের ক্ষেত্রেও সেটি কাজে লাগানো যেতে পারে।
আখতার মাহমুদ বলেন, "দেশে একজন ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগের খরচ ভারত ও ভিয়েতনামের মতো অন্যান্য দেশের তুলনায় কম। সুতরাং, প্রকৌশল খাতে আমাদের তুলনামূলক ব্যয় সুবিধা রয়েছে।"
তিনি আরও বলেন "দেশ হিসেবে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, রপ্তানির জন্য আমরা কতদিন সস্তা শ্রমের উপর নির্ভর করব। কারণ আমাদের যেকোনো ভাবেই দক্ষ বেল্টে যেতে হবে। আমি শ্রমের দৃষ্টিকোণ থেকে কথাগুলো বলছি।"
তিনি আরও বলেন, "আমরা যদি ইলেকট্রনিক্সের মতো অত্যাধুনিক পণ্যগুলির দিকে নজর দেই তবে তবে এখানে অনেক দক্ষতা শেখার বিষয় আছে। আমরা গার্মেন্টসে যেমন শিখেছি তেমনি ইলেকট্রনিক্সেও আরও শিখতে পারি যা আমরা অন্যান্য শিল্পে ব্যবহার করতে পারবো। সুতরাং, এটি সামগ্রিক কৌশল, যা আমাদের সস্তা শ্রম থেকে দক্ষতা-ভিত্তিক শ্রমের দিকে নিয়ে যাবে।"
বর্তমানে চিপ ডিজাইনের মোট ভ্যালু চেইনের মধ্যে ডিজাইন, প্রিফেব্রিকেশন, অ্যাসেম্বলিং-টেস্টিং থেকে ফ্যাব্রিকেশনের পরবর্তী পর্যায় ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি ধাপ রয়েছে। সেক্ষেত্রে ঐ ক্ষেত্রগুলির অনুসন্ধান করতে হবে।
উদাহরণস্বরূপ, প্যাকেজিংয়ের কথা বলা যাক। চিপ তৈরির পর সেগুলো ব্যবহার করার আগে সুরক্ষিত ও সংরক্ষণ করা দরকার। এক্ষেত্রে চিপগুলিকে সার্কিট বোর্ডে রাখা হয় এবং কঠোরভাবে পরীক্ষা করা হয়। যাতে করে সেগুলো এসেম্বল ও টেস্টিং পর্যায়ে সঠিকভাবে কাজ করে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তুলনামূলক সুবিধার কথা চিন্তা করে এই পর্যায়ে বাংলাদেশের ঠিক কোথায় ফোকাস করা উচিত হবে।
শিল্প সংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তি মনে করেন, বিভিন্ন দিক বিবেচনায় বর্তমানে ডিজাইনের দিকে মনোনিবেশ করা বাংলাদেশের জন্য একটি স্মার্ট পদক্ষেপ। ফ্যাব্রিকেশনের (নিজেরা চিপ তৈরি করা) তুলনায় ডিজাইনের জন্য ব্যয়বহুল সরঞ্জাম এবং অবকাঠামোতে খাতে কম অগ্রিম বিনিয়োগ প্রয়োজন। বিশ্বজুড়ে দক্ষ আইসি ডিজাইনারদের চাহিদাও বেশি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী ডিজাইন শিল্প গড়ে তোলার মাধ্যমে এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারে।
এক্ষেত্রে দক্ষ জনশক্তির উপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, "সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে বাংলাদেশের যাত্রা শুধু চিপ তৈরির জন্য নয়। বরং এটি একটি দক্ষ কর্মী বাহিনী এবং শক্তিশালী অর্থনীতি গড়ে তোলার মাধ্যমে সমস্ত নাগরিককে উপকৃত করবে।"
শিল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে আলাপচারিতার ভিত্তিতে সৈয়দ আখতার মাহমুদ বলেন, "বাংলাদেশের উচিত এই মুহূর্তে ডিজাইন খাতের তুলনামূলক সুবিধার দিকে নজর দেওয়া। চিপ ডিজাইনের চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু একইসাথে চাহিদা অনুযায়ী ডিজাইন তৈরিতেও তারা সক্ষমতা দেখাচ্ছে।"
তিনি আরও বলেন, "আমরা যদি অতি আগ্রহী হয়ে যাই এবং ভারতের মতো ফ্যাব্ররিকেশন পর্যায়ে যেতে চাই তাহলে আমাদের আগে ভাবতে হবে যে, এই মুহূর্তে আমরা প্রকৃতপক্ষেই ফ্যাব্রিকেশন পর্যায়ে যাবো কি-না।
আখতার মাহমুদ বলেন, "অনেক দেশ যে ভুলটি করেছে তা হল তারা অতি আগ্রহী হয়ে ধরে নিয়েছিল যে, কাজটি তারা করতে পারবে। তারপর অনেক সময় ও অর্থ ব্যয় করার পর উদ্যোগ সফল হয়নি। এক্ষেত্রে ইন্দোনেশিয়ার বিমান তৈরির প্রকল্প একটি ভালো উদাহরণ; যা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে।"
এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, আমাদের সচেতনভাবে চিন্তা করতে হবে। আমাদের প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা আছে এমন দিকে অগ্রসর হওয়া উচিত। বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের উচিত ব্যবসার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে কথা বলা এবং অতি আগ্রহী না হয়ে এগিয়ে যাওয়া।