পাখি সর্বোচ্চ কত উঁচুতে উড়তে পারে?
পাখি প্রকৃতির অপার বিস্ময়। কোনো পাখি উড়তে পারে, কোনোটি পাড়ে না। কোনোটি লোকালয়ে উড়ে বেড়ায়, কোনোটি আবার সব ছাড়িয়ে আকাশের বহু উঁচুতে উড়ে বেড়ায়।
কেউ কেউ ডানা না ঝাপটিয়ে মাইলের পর মাইল উড়ে যায়, কেউ কেউ অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে বেঁচে আছে, কেউ সাঁতার কাটে, কেউ কেবল হাঁটে বা দৌড়ায়, কেউ বর্বর মাংসাশী, কেউবা আবার কোমল তৃণভোজী।
কিন্তু আপনি কি জানেন কোন পাখি সবচেয়ে উঁচুতে উড়তে পারে?
সর্বোচ্চ উঁচুতে ওড়ার রেকর্ড রয়েছে রুপেল-এর শকুন (জিপস রুয়েপেলি)-এর দখলে।
১৯৭৩ সালে পশ্চিম আফ্রিকার আইভরি কোস্টে ১১ হাজার ৩০০ মিটার (৩৭ হাজার ফুট) উঁচু দিয়ে ওড়া একটি বাণিজ্যিক বিমানের সঙ্গে ধাক্কা লাগে রুপেল-এর একটি শকুনের। এতে একটি ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বিমানটি সফলভাবে অবতরণ করতে সক্ষম হয়। দুর্ভাগ্যবশত পাখিটি মারা যায়।
রুপেল-এর শকুন অত্যন্ত সামাজিক ও দাঁড়িয়াল পাখি। এরা বাসা বাঁধা এবং খাওয়ার জন্য অনেক পাখি এক জায়গায় জড়ো হয়।
সাহারা ও সুদানীয় সাভানার মধ্যবর্তী সাহেল নামক আফ্রিকার বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে এদের বিচরণ। এছাড়া জিম্বাবুয়ে, সেনেগাল ও ইথিওপিয়াসহ একাধিক দেশে এই পাখি দেখা যায়। কখনো কখনো এরা ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে স্পেনেও পাড়ি জমায়।
এই প্রজাতির শকুনেরা সাধারণত একগামী, এরা সারাজীবন একটি সঙ্গী নিয়েই জীবন পার করে। সঙ্গী নির্বাচনের পরে এই দম্পতি একসঙ্গে লাঠি, ঘাস ও পাতা সংগ্রহ করে। সাধারণত অন্য পাখির বাসা থেকে তারা এসব সংগ্রহ বা চুরি করে আনে।
বাসা নির্মাণের পর বাবা-মা উভয়েই ৫৫ দিনব্যাপী ধারাবাহিকভাবে ডিমে তা দেয়। ডিম ফুটে ছানা বের হওয়ার পরে, বাবা-মা উভয়ই প্রায় ১৫০ দিন পর্যন্ত ছানাদের খাওয়া-দাওয়া করায় ও যত্ন নেয়।
বিবিসি ওয়াইল্ডলাইফ এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত উঁচুতে ওড়ার প্রশ্নে রুপেল-এর শকুনের রেকর্ডের ধারেকাছেও নেই কোনো পাখি।
আফ্রিকান অনেক পাখির মতো, আবাসস্থল হ্রাস, শিকার ও খাদ্য প্রাপ্যতা হ্রাস প্রভৃতির কারণে এই শকুনের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন।
আরেকটি বড় সমস্যা হলো বিষক্রিয়া, বিশেষ করে পূর্ব আফ্রিকায়। মূলত কার্বোফুরান নামক একটি কীটনাশকের কারণে এই বিষক্রিয়া ঘটে।
এছাড়া দাতব্য সংস্থা বার্ডলাইফ ইন্টারন্যাশনাল ড্রাগ ডাইক্লোফেনাকের ভূমিকাও তুলে ধরেছে। এই অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি ওষুধটি ভেটেরিনারি চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। এই ওষুধ গ্রহণ করা প্রাণীর মৃতদেহ খেলে তা রুপেল-এর শকুনদের দেহে মারাত্মক বিষক্রিয়া ঘটায়।
আপনি যদি কখনও রুপেল-এর শকুনকে মাংস খেতে দেখেন, তবে দৃশ্যটি সহজে ভুলবেন না। কারণ এই রাজকীয় পাখিগুলো উচ্চতায় প্রায় এক মিটার (৩৩-৩৮ ইঞ্চি) এবং এর মাথায় কোনো পালক থাকে না।
অ্যানিমেলিয়া জানিয়েছে, এই অভিযোজনের ফলে খাওয়ার সময় তারা শিকারের ভিতরে তাদের পুরো মাথা ঢুকিয়ে দিতে পারে।
দুর্ভাগ্যক্রমে, রুপেল-এর শকুনকে আইইউসিএন 'মহাবিপন্ন' প্রাণী হিসেবে তালিকাবদ্ধ করেছে।
অনেক উচ্চতায় ওড়া আরেকটি পাখি হলো কমন ক্রেন (গ্রাস গ্রাস) বা সারস পাখি। উত্তর আমেরিকা, পূর্ব গোলার্ধ ও অস্ট্রেলিয়ার বাসিন্দা এই আকর্ষণীয় পাখিরা। সারস প্রায় ৬০ সেমি থেকে ১৫০ সেমি (২ থেকে ৫ ফুট) পর্যন্ত হয়ে থাকে।
সাধারণত সারসের মাথার একাংশ পালকহীন, ঠোঁট ভারি, পালক ঘন এবং পিছনের আঙুল উঁচানো। ওড়ার সময় লম্বা গলা সামনে প্রসারিত থাকে, পিছনে থাকে সম্প্রসারিত লম্বা পা।
সারস একগামি পাখি এবং বাবা-মা উভয়ে ছানাদের যত্ন নেয়। উত্তর মহাদেশের সারসেরা প্রজননক্ষেত্র ও শীতকাল কাটানোর জায়গার সন্ধানে হাজার হাজার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে।
হিমালয় পর্বতমালার উপর দিয়ে সারসের দল ১০ হাজার মিটার (৩১ হাজার ৮০০ ফুট) অবধি ওঠার রেকর্ড রয়েছে।
জলাভূমি ও তৃণভূমির আবাস ধ্বংস, উত্তর গোলার্ধে ব্যাপক শিকার এবং অতি সম্প্রতি আফ্রিকায় বিষ প্রয়োগে নিধনের কারণে এই পাখিদের সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে।
আইইউসিএন সারসের বেশিরভাগ প্রজাতিকে 'বিপদগ্রস্ত' হিসেবে তালিকাবদ্ধ করেছে।
এরপরেই আছে বার-হেডেড গুজ (এন্সার ইন্ডিকাস) বা দাগি রাজহাঁস বা মরাল। এইগুলোকে রীতিমতো দক্ষ অ্যাথলেট বলা যায়।
এই হাঁস 'এনাটিডি' পরিবারভুক্ত। লাতিন ভাষায় 'এন্সার' কথার অর্থ বড় আকারের পরিযায়ী। 'ইন্ডিকাস' মানে ভারতীয়। অর্থাৎ পুরো বাংলায় হল – বড় আকারের পরিযায়ী রাজহাঁস।
প্রায় ২০ লাখ ২০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে এদের বিচরণক্ষেত্র। শীতের সময় এই পাখিগুলো মধ্য এশিয়া থেকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পরিযায়ী হয়ে আসে। বসন্তকালে আবার মধ্য এশিয়ায় চলে যায়। সেখানকার পার্বত্যাঞ্চলে ও জলাশয়ে বিচরণ ও প্রজনন করে। এ জন্য তাদের হিমালয় অতিক্রম করতে হয়৷
এই পাখিকে সর্বোচ্চ ৭ হাজার ৩০০ মিটার (২৪ হাজার ফুট) উচ্চতায় দেখা গেছে। আট ঘণ্টায় বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বত হিমালয় পার হতে পারে তারা অনায়াসে।
এত উঁচুতে বাতাসও বেশ পাতলা। প্রয়োজনের অর্ধেক অক্সিজেনে বাঁচতে পারে এরা।
আইইউসিএন- এই প্রজাতিকে সম্প্রতি 'ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত' বলে ঘোষণা করেছে।
ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি