৩ মাস পরপর বিদ্যুতের দাম বাড়ালে ক্ষতি হবে শিল্প ও অর্থনীতির: ব্যবসায়ী নেতারা
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে নেওয়া ঋণের শর্তপূরণের অংশ হিসেবে বছরে চারবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর মাধ্যমে ২০২৬ সালের ডিসেম্বর নাগাদ এ খাতে ভর্তুকি বিলুপ্তে সরকারের পরিকল্পনা সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ী নেতারা। তারা মনে করছেন, এটি করা হলে সাধারণ ভোক্তা থেকে শুরু করে শিল্প-বাণিজ্য ও বিনিয়োগসহ সামগ্রিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
আইএমএফ-এর কাছ থেকে ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণচুক্তি করার সময় সরকার ২০২৬ সালের মধ্যে গ্যাস ও বিদ্যুৎখাতের ভর্তুকি পুরোপুরি প্রত্যাহার করার অঙ্গীকার করেছে। এ ঋণের তৃতীয় কিস্তি ছাড়ের শর্ত বাস্তবায়ন পরিস্থিতি যাচাই করতে ঋণদাতা সংস্থাটির একটি প্রতিনিধিদল বর্তমানে বাংলাদেশ সফরে রয়েছে।
বৃহস্পতিবার (২ মে) আইএমএফ-এর প্রতিনিধিদের সঙ্গে পেট্রোবাংলার অফিসে অনুষ্ঠিত সভায় তিনমাস পরপর বিদ্যুতের দাম পর্যায়ক্রমে বাড়ানো এবং ২০২৬ সালের মধ্যে ভর্তুকি পুরোপুরি প্রত্যাহার করার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা।
তারা বলছেন, ২০২৬ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ এলডিসি উত্তরণের পর থেকেই রপ্তানিতে ভর্তুকি বাতিল হবে। বিদ্যুৎ ও গ্যাসে ভর্তুকি পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হলে উৎপাদন খরচ আরও বেড়ে যাবে, যা সম্ভাব্য নতুন বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও রপ্তানি প্রতিযোগিতা-সক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
এছাড়া ভর্তুকি পুরোটা অপসারণের ফলে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যেতে পারে। এতে ভোক্তার চাহিদাও কমে যাবে, যা সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সর্বশেষ গত মার্চ মাসে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছিল। বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা এ বছরের জুন, অক্টোবর ও ডিসেম্বরে বিদ্যুতের দামবৃদ্ধির পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন। আগামী দুই বছরে মার্চ, জুন, অক্টোবর ও ডিসেম্বরে আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
তবে ভোক্তাদের ওপর বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির আকস্মিক প্রভাব কমাতে প্রতিবার অল্প অল্প করে দাম সমন্বয় করা হবে বলে কর্মকর্তারা আইএমএফ দলকে জানিয়েছেন।
বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি সমন্বয়ের সরকারের কৌশল নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ব্যবসায়ী নেতারা। কেন বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ কমানোর চেষ্টার পরিবর্তে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তারা।
তারা বলছেন, সরকার অতিরিক্ত উৎপাদন সক্ষমতা সৃষ্টি করে কেন্দ্রগুলো অলস বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ দিচ্ছে, কিন্তু বিদ্যুতের সিস্টেম লস কমানোর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। বিদ্যুৎ কেনার ক্ষেত্রে সরকার কোনো প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থা সৃষ্টি করছে না। ফলে ভর্তুকি বাড়ছে। এ ভর্তুকির দায় বেশিরভাগ ব্যবসায়ী ও জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যা অনাকাঙ্ক্ষিত।
২০২২–২৩ অর্থবছরে বিদ্যুৎ বিক্রি করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) লোকসান হয়েছে ৪৩ হাজার ৫৩৯ কোটি টাকা। ওই অর্থবছরে ভর্তুকি বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৩৯ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা।
বর্তমানে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় পাইকারি দাম ৭ টাকা ৪ পয়সা। বিদ্যুৎ ভর্তুকি ছাড়া এ দাম ১২ টাকা ছাড়িয়ে যাবে, যার ফলে ভোক্তা-পর্যায়ে গড় দাম হবে প্রতি ইউনিট প্রায় ১৫ টাকা — বর্তমানে যা ৮ টাকা ৯৫ পয়সা।
২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে বিদ্যুতের দাম তিনদফায় বাড়ানো হয়েছিল। গত পনের বছরে পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে ১২ বার, খুচরা পর্যায়ে বাড়ানো হয়েছে ১৪ দফা।
সিস্টেম লস, ক্যাপাসিটি চার্জ কমানোর পক্ষে ব্যবসায়ীরা
ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই)-এর সভাপতি মাহবুবুল আলম টিবিএসকে বলেন, সরকার আগামী তিনবছরে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে, কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারছে না। ফলে কারখানাগুলোর উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
তিনি সরকারের ধারাবাহিক বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দেন।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ)-এর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, 'সরকার ভর্তুকি প্রত্যাহারের নামে দাম বাড়ালেও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহের অভাব রয়েছে, যা শিল্পে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।'
'সরকারের উচিত বিদ্যুৎখাতের চুরি বন্ধ করা, সিস্টেম লস কমানো এবং রেন্টাল, কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলো অলস বসিয়ে রেখে যে হাজার হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিচ্ছে, তা বন্ধ করা। যদি এ সমস্যাগুলো সমাধান করা হয়, তাহলে ভর্তুকি দেওয়ার প্রয়োজন হবে না,' এসবের দায়ভার জনগণ ও শিল্পের বহন করা উচিত নয় উল্লেখ করে বলেন তিনি।
গত ফেব্রুয়ারিতে সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, ৮২টি আইপিপি [বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী] বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে ৭০টিকে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ৭৬ হাজার ২৪২ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। এ সময়ে ৩২টি রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টকে ভাড়া বাবদ ২৮ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে সরকার।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ)-এর প্রথম সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, মহামারীর পর থেকে মজুরি ও গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিসহ অন্যান্য কারণে পোশাক খাতে উৎপাদন খরচ ২৭ শতাংশ বেড়েছে। তবে সে তুলনায় পণ্যের দাম তেমন বাড়েনি।
'এ অবস্থায় বছরে চারবার বিদ্যুতের দাম বাড়লে এ খাতের টিকে থাকা কঠিন হবে,' বলেন তিনি।
নজরুল ইসলাম আইএমএফের শর্তের কারণে বিদ্যুতের দাম বাড়লে সম্ভাব্য ক্ষতিপূরণে বিকল্প সমাধান খোঁজার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। এসব বিকল্পের মধ্যে প্রণোদনা, ব্যাংকের সুদহার হ্রাস বা সরকার দ্বারা উপযুক্ত বলে মনে করা অন্য যেকোনো ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)-এর সহ-সভাপতি মো. সালেউদ জামান খান বলেন, 'বছরে চারবার বিদ্যুতের দাম বাড়লে আগামী বারো মাসের মধ্যে অর্ধেকের বেশি কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।'
'গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ব্যাংকের সুদের হার বেড়েছে, এবং সম্প্রতি, টেক্সটাইল শ্রমিকদের মজুরি ৬০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এসব চ্যালেঞ্জর মধ্যে টেক্সটাইল খাতকে টিকিয়ে রাখা ক্রমশ কঠিন বলে মনে হচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে এটি সমগ্র অর্থনীতির পতনের দিকে নিয়ে যেতে পারে,' তিনি আরও বলেন।
বিজিএমইএ-এর একজন পরিচালক শোভন ইসলাম উদ্বেগ প্রকাশ করেন: 'আমরা চীন ও ভারতের মতো বড় অঙ্কের প্রণোদনা পাওয়া রপ্তানিকারকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছি। যেখানে তারা যথেষ্ট সরকারি সমর্থন পায়, সেখানে আমাদের প্রণোদনা কমানো হচ্ছে। আমরা কীভাবে প্রতিযোগিতা করব?'
'গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো সত্ত্বেও সরবরাহের মান অপর্যাপ্ত রয়েছে। আমরা জীবাশ্ম জ্বালানির জেনারেটরের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হচ্ছি, যার ফলে উৎপাদন খরচ বাড়ছে,' তিনি বলেন।
'এখন সরকার নিয়মিত বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। এ চ্যালেঞ্জিং পটভূমিতে আমরা আটকা পড়েছি বলে মনে হচ্ছে,' বলেন স্প্যারো গ্রুপের এ ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
সরকারের উচিত ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা: অর্থনীতিবিদেরা
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এর নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর টিবিএসকে বলেন, ভর্তুকি পুরোপুরি প্রত্যাহার এবং প্রতি তিনমাসে দাম বাড়ানোর দ্বৈত প্রভাব রয়েছে। এতে সরকার ভর্তুকিচাপ থেকে মুক্তি পেলেও এটি গ্রাহকদের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।
তিনি বলেন, গ্রাহকদের ওপর থেকে বোঝা কমাতে উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থার অদক্ষতা দূর করে ন্যায্যমূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হবে।
তবে আহসান মনসুর এসব সমস্যা মোকাবিলায় সরকারের মনোযোগের ঘাটতির দিকটি তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ হতে হবে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে। সরকার টেন্ডার আহ্বান করতে পারে যে, ৫টি ৫০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র বেসরকারিখাতে অনুমোদন দেওয়া হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য সর্বনিম্ন দরদাতা নির্বাচন করে সরকার সস্তায় বিদ্যুৎ নিশ্চিত করতে পারে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান টিবিএসকে বলেন, রাজস্ব আয় কম হওয়ায় সরকারের ব্যয় করার সক্ষমতা কমে গেছে। বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বাজেটের ওপর বড় চাপ সৃষ্টি করছে।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, সরকার ভর্তুকির অন্তর্নিহিত কারণকে উপেক্ষা করছে। ফলে সরকারের বাড়তি [ওভার] ক্যাপাসিটি তৈরি হচ্ছে।
আইএমএফের সঙ্গে বৈঠকে উপস্থিত সূত্রগুলি জানিয়েছে, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে যে ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয়, তার যৌক্তিকতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আইএমএফ।
২০২২–২৩ অর্থবছরে পিডিবি ২৬ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ করেছে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া পরিশোধে। সিপিডি'র রিপোর্টে বলা হয়েছে, গতবছর বিদ্যুৎকেন্দ্রসমূহের ৪১ শতাংশ সক্ষমতা অলস পড়ে ছিল।
বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা আইএমএফকে জানিয়েছেন, চুক্তির বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী ক্যাপাসিটি চার্জ দিতেই হবে। তবে সরকার 'বিদ্যুৎ নেই, বিলও নেই' নীতি বাস্তবায়ন করেছে। যার ফলে নতুন চুক্তি নবায়নের ক্ষেত্রে ক্যাপাসিটি চার্জ বাদ দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।