পশ্চিমের সাথে চীনের বাণিজ্য যুদ্ধ বাংলাদেশের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করছে: ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ
পশ্চিমা দেশ ও চীনের মধ্যে চলমান বাণিজ্য যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশ চীন থেকে সস্তায় কাঁচামাল সংগ্রহ করে রপ্তানি পণ্য তৈরি করে রপ্তানি বাড়াতে পারে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
রবিবার (৫ মে) রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ ও দৈনিক বণিক বার্তার যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত 'পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে উন্নয়নের পথ অনুসন্ধান' শিরোনামে দুই দিন ব্যাপী আন্তর্জাতিক সেমিনারে তিনি এ কথা বলেছেন।
তিনি বলেন, "এ সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মূল চ্যালেঞ্জ হবে চায়না ব্লক, রাশিয়া ও শিল্পোন্নত পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক রক্ষা করা।"
ড. ওয়াহিদউদ্দিন আরো বলেছেন, "চীনের সাথে ট্রেড পার্টনারশিপ হলে সেখান থেকে কম মূল্যে ম্যানুফ্যাকচারিং পণ্য আনা যাবে, বড় আকারের ঋণ সুবিধা পাওয়া যাবে। তবে এক্সপোর্ট বাড়াতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে পার্টনারশিপ করতে হবে।"
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন লন্ডনের সোয়াস বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোশতাক খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল, জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসেকা আয়েশা খান প্রমুখ।
রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি (জেনারেলাইজড স্কিম অফ প্রেফারেন্সেস) সুবিধা প্রত্যাহার করার পর বাংলাদেশ তা ফিরে পেতে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি উল্লেখ করে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, তখন গার্মেন্ট জিএসপি পাচ্ছিলো না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ৮০-৯০টি উন্নয়নশীল দেশসহ প্রায় ১৫০টি দেশকে এই সুবিধা দিলেও তার থেকে বাংলাদেশ বাদ পরে।
তিনি বলেন, "জিএসপির আওতায় আরও অনেক পণ্য ছিল যেগুলো যুক্তরাষ্ট্রে কম রপ্তানি হতো। জিএসপি সুবিধা ধরে রাখতে পারলে ওইসব পণ্য রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ হতো। তাই জিএসপি হারানোর মাধ্যমে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এক্সপোর্ট ডাইভারসিফিকেশনের সুযোগ হাতছাড়া করেছি।"
শ্রমিকদের নিম্ন মজুরি এবং কম খরচে পণ্য রপ্তানি নিয়ে বাংলাদেশের সন্তুষ্টি থাকা উচিত নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, নিম্ন মজুরি দারিদ্র দূর করতে পারবে না।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, "এলডিসি গ্রাজুয়েশনের পর যদি আমরা ইইউতে জিএসপি প্লাস সুবিধা পেতে চাই, তাহলে অনেক গ্লোবাল কনভেনশন আমাদের মানতে হবে। পাকিস্তান সম্প্রতি জিএসপি প্লাস সুবিধা পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে। সেজন্য পাকিস্তানকে অনেকগুলো ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশনে অনুমোদন পেতে হয়েছে।"
তার মতে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মতো বৈশ্বিক সংকটের সময় বাংলাদেশকে রিজার্ভ ও এক্সচেঞ্জ রেট নিয়ে আগে থেকেই সতর্ক থাকা উচিত ছিল। যুদ্ধে ইউক্রেনের পতন হলে বিশ্ব বাণিজ্য পরিস্থিতি আরও পাল্টে যেতে পারে। তাতে যেসব সুযোগ আসবে তা কাজে লাগাতে বাংলাদেশকে প্রস্তুতি নিতে হবে বলে তিনি মনে করেন।
তিনি বলেন, "অনেক পশ্চিমা কোম্পানি চীন ছেড়ে যাচ্ছে। তাদের বড় অংশই ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়ায় স্থানান্তর হচ্ছে। আমরা ঐ সুবিধা নিতে পারিনি।"
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন বলেছেন, সরকারের যদি জনগণের চোখে বৈধতা থাকে, আত্মবিশ্বাসী হয় এবং সরকারের নীতির প্রতি যদি জনসমর্থন থাকে তাহলে দেশের বৈদেশিক অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করা অনেক সহজ হয়। দেশের ভেতরের রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের জন্য দেশের স্বার্থের বিষয়ে কোন আপস করতে হয় না।
তিনি বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় জবাবদিহিতার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক এই অর্থ উপদেষ্টা আরও বলেন, যদি কোন সরকার নিজের জনগণকে হাস্যকরভাবে গুরুত্বহীন ভাবে তখন সেদেশ অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আপস করতে পারে।
বিশ্ব বাণিজ্য সুবিধা আদায়ের ক্ষেত্রে ভিয়েতনামকে সফল দেশ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আসিয়ান মেম্বার হওয়া সত্ত্বেও জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশের সাথে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করেছে।
তিনি বলেন, "ভিয়েতনামের সরকারের প্রতি জনগণের সমর্থন রয়েছে। দেশটি জনসাধারণের সাথে আলোচনার মাধ্যমে নীতিগুলো যাচাই করে এবং সেখানে সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় না।"
বর্তমান বিশ্বের কর্তৃত্বপরায়ণ রাষ্ট্রগুলো সংকটের মধ্যে রয়েছে উল্লেখ করে সোয়াস ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন এর অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোস্তাক খান বলেন, বিশ্বের কর্তৃত্বপরায়ণ রাষ্ট্রগুলো সুশাসনের অভাবে সংকটের মধ্যে পড়েছে। গত বিশ বছর ধরে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ, তার বিপরীতে ইচ্ছেমতো ব্যয়, অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে কর্তৃত্বপরায়ণ উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলো অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে রয়েছে।
তিনি বলেন, "আমাদের এখন সুশাসনের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। সবচেয়ে কম দামে কীভাবে সবচেয়ে মানসম্পন্ন অবকাঠামো তৈরি করতে পারি, তা নির্ধারণ করতে হবে। অনেক উন্নয়নশীল দেশ মনে করে বৈদেশিক ঋণ নিয়ে তারা এ অর্থ সঠিকভাবে ব্যয় করতে এবং পরিশোধ করবে। প্রকৃতপক্ষে এটি খুবই সমস্যাপূর্ণ এবং সাধারণ বোঝাপড়া। অধিকাংশ কর্তৃত্বপরায়ণ রাষ্ট্র এসব সংকটের জন্য কষ্ট করছে।"
ড. মোস্তাক আরো বলেন, "শ্রীলঙ্কার রাজাপাকশে আমাদের সামনে বড় উদাহরণ। একবার পতন শুরু হলে তা থামানো খুবই কঠিন হয়ে উঠবে।"
স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, মূল্যস্ফীতি, ব্যাংক দেউলিয়া হওয়া, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, দারিদ্র্যসহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা যাচ্ছে বিশ্বের অনেক দেশেই। কিন্তু বাংলাদেশকে এই ধরনের জটিল পরিস্থিতি এড়াতে পেড়েছে।
তিনি বলেন, "এখনকার বিশ্বে অনেক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে আমরা এখন এসব সমস্যার মোকাবেলা করছি।"
অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসেকা আয়েশা খান বলেন, "বৈশ্বিক অনিশ্চিত সময়ের মধ্যেও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নতি করেছে। অনেক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। অনেক এশিয়ান দেশের তুলনায় আমরা এগিয়ে রয়েছি। গ্রামীণ স্বাস্থ্য, শিক্ষায় আমাদের বড় বিনিয়োগ রয়েছে। সেই বিনিয়োগের ফলও আমরা পাচ্ছি।"