‘ক্রলিং পেগ’ চালুর ফলে আমদানিকৃত পণ্যের দাম বাড়ার সুযোগ নেই: ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীবৃন্দ
ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীরা বলেছেন, 'ক্রলিং পেগ' পদ্ধতি চালুর ফলে আনুষ্ঠানিকভাবে ডলারের দাম বাড়লেও এর জেরে আমদানিকৃত পণ্যের দাম বাড়ার সুযোগ নেই। কারণ প্রকৃত বিনিময় হার বর্তমান বাজারদরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়েছে।
তাদের মতে, ডলারের অফিসিয়াল দাম ১১০ টাকা হলেও খোলাখুলিভাবে ১১৮-১২০ টাকা বা তারও বেশি দামে বেচাকেনা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক এই ব্যবধান কমানোর পদক্ষেপ নিয়ে ডলারের গড় দাম ১১৭ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। এরচেয়ে ১ টাকা কম বা বেশি রাখা যাবে ডলারের দাম।
ডাচ-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মো. শিরিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ক্রলিং পেগ চালুর ফলে আমদানি ব্যয় খুব বেশি বাড়বে না। বরং ডলারের দামের এই সমন্বয় বাজার স্থিতিশীল রাখতে ভূমিকা রাখবে।
তিনি বলেন, 'দীর্ঘদিন ধরে ডলারের রেটকে ঘিরে অনিশ্চয়তায় থাকা আমদানিকারকরা এই অনিশ্চয়তা দূর হওয়ায় স্বস্তি পাবেন। এছাড়াও আমদানিকৃত পণ্যের বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা সহজ হবে।'
উল্টো ডলারের ভালো দাম পাওয়ায় রেমিট্যান্স প্রবাহ ও রপ্তানি আয়ের ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মন্তব্য করেন এই অভিজ্ঞ ব্যাংকার।
বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের ভোজ্য তেল, মসুর ডাল ও চিনি-পেঁয়াজের মতো নিত্যপণ্য আমদানি করতে ব্যাংক থেকে ডলার কিনে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে হয়। সাধারণত ডলারের দাম যখন বেড়ে যায়, দেশের বাজারেও পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায়। আবার ডলারের দাম কমে গেল সে অনুযায়ী পণ্যের দাম কমে যায়।
পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক সিদ্দিকুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'এখন অনেকের প্রশ্ন হচ্ছে, যেহেতু ডলারের দাম ৭ টাকা বেড়েছে, পণ্যের দামও সেই অনুযায়ী বাড়বে কি না। আসলে তা নয়, গত দুই বছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে অফিসিয়াল রেট নির্ধারণ করেছে, সেটা প্রকৃত এক্সচেঞ্জ রেট ছিল না। এই রেট ছিল প্রায় ১০ টাকা কিংবা তারচেয়ে বেশি।'
তিনি আরও বলেন, 'এ কারণে অধিকাংশ ব্যাংক বেশি দামে ডলার সংগ্রহ করেছে এবং সে অনুযায়ী গত দুই বছর ধরে আমদানিকারকদের কাছ থেকে বেশি দাম নিয়েছে। আমরা কিছু কিছু ব্যবসায়ীদের মুখে এটাও শুনেছি যে ১২০ টাকায়ও অনেককে আমদানির জন্য ডলার সংগ্রহ করতে হয়েছে। এখন "ক্রলিং পেগ" পদ্ধতিতে ডলারের দাম যে পর্যায়ে রয়েছে তার কারণে ব্যবসায়ীদের আমদানি=জাতীয় পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কোনো সুযোগ দেখছি না।'
ফেডারেশন অভ বাংলাদেশ চেম্বারস অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সহুসভাপতি মো. মনির হোসেন টিবিএসকে বলেন, 'আমদানিকারকদের যদি আমদানিমূল্য বেড়ে যায়, তাহলে পণ্যের দাম বাড়বে—এটাই স্বাভাবিক। এখন কথা হচ্ছে, নতুন এই ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে অফিসিয়ালী ডলারের দাম বেড়েছে ৭ টাকা—এর কারণে ব্যবসায়ীদের পণ্যের দাম বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে কি না? আমি বলব, না।
'এর যৌক্তিকতা হলো, গেল দুই বছরে বাজারে ডলারের প্রকৃত যে রেট ছিল, সেই তুলনায় অফিসিয়াল রেট ছিল ভিন্ন। আমরা যদি সর্বশেষ দেখি, ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালুর আগেও রেমিট্যান্স ও আমদানি বাবদ ডলারমূল্য নির্ধারিত ছিল ১১০ টাকায়। অথচ অধিকাংশ ব্যাংককে রেমিট্যান্স কিনতে হয়েছে ১১৫-১১৬ টাকার বেশি দামে। তার মানে, ব্যাংক আমদানিকারকদের কাছে লোকসানে ডলার বিক্রি করেনি। তারা এরচেয়ে ১-২ টাকা বেশি দরে ডলার বিক্রি করেছে। কোনো কোনো ব্যাংক আমদানি এলসি নিষ্পত্তিতে ১২০ টাকা বেশি ডলারের দর নিয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমি বলব, এখন অফিসিয়ালি ডলারের দর যেটা বেড়েছে, তাতে প্রকৃত অর্থে ব্যবসায়ীদের আমদানি খরচ বৃদ্ধি পায়নি। ব্যবসায়ীদের আগেও এই দরের মধ্যেই ডলার সংগ্রহ করতে হয়েছে।'
ক্রলিং পেগ হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিয়ম হার নির্ধারণের একটি ব্যবস্থা। এ পদ্ধতিতে কোনো মুদ্রার বিনিময় হারকে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ওঠা-নামার করতে দেওয়া হয়। অর্থাৎ এটি বিনিময় হারকে স্থির অবস্থানে রাখে। বাংলাদেশ ব্যাংক যে ১১৭ টাকা মধ্যবর্তী দর নির্ধারণ করেছে, এটি যেকোনো সময় বদলাতে পারবে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর তা নির্ভর করবে।
সাধারণত অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না থাকলে, বিনিময় হার অস্থিতিশীল হওয়ার প্রবণতা থাকলে এবং মূল্যস্ফীতি উচ্চ হারে থাকলে কোনো দেশ ক্রলিং পেগ পদ্ধতি অনুসরণ করে। বাংলাদেশ এখন এই পরিস্থিতির মধ্যেই আছে।
বাংলাদেশে ডলারের সংকট শুরু হয় ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে। তখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিক সংকট তীব্র হলে ডলারের সরবরাহ কমে যায়। ফলে বাড়তে থাকে মুদ্রাটির দর। ডলারের দামের লাফ দেওয়া ঠেকাতে নানা উদ্যোগ নিয়েও লাভ হয়নি। শেষ পর্যন্ত আইএমএফের পরামর্শ মেনেই বিনিময় হারের নতুন পদ্ধতি ঠিক করা হয়েছে।
ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমরানুল হক টিবিএসকে বলেন, সর্বশেষ আমদানিতে ডলারের দাম ছিল ১১০ টাকা। তবে এই রেট শুধু সরকারি আমদানি বাবদ পাওয়া যেত, তার সিংহভাগ ডলার দিত কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তিনি বলেন, 'তবে ব্যবসায়ীদের আমদানির জন্য ডলারের রেট ছিল এর চেয়েও বেশি। কারণ অধিকাংশ ব্যাংককে এরচেয়ে ৫-৬ টাকা বেশি দরে বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো থেকে ডলার সংগ্রহ করতে হয়েছে। যার কারণে ব্যবসায়ীদের থেকেও সেই অনুযায়ী দাম নিতে হয়েছে।'
এমরানুল হক আরও বলেন, 'নতুন ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে ব্যবসায়ীদের পণ্যের দাম বাড়ানোর সুযোগ নেই। কারণ এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে এক্সচেঞ্জ রেট নির্ধারণ করছে, এটাই প্রকৃত মার্কেট রেট। তবে নতুন করে এই রেট বাড়ানো হলে তখন পণ্যমূল্য বাড়ার সম্ভাবনা থাকবে।'
কয়েকটি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান টিবিএসকে বলেন, ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালুর ফলে ব্যবসায়ীদের জন্য সুবিধা হয়েছে। আমদানিকারকরা এখন যেকোনো ব্যাংক থেকে নির্ধারিত দামে ডলার পেতে পারবেন।
তারা বলেন, নতুন ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে ডলারের দাম বাড়েনি। উল্টো গত বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরের তুলনায় দাম কম রয়েছে। ওই সময়ে ব্যবসায়ীদেরকে ১২০-১২২ টাকা দিয়েও ডলার কিনতে হয়েছে।