‘মন্থন’: ৫ লাখ খামারির চাঁদায় যে সিনেমা তৈরি হয়েছিল
১৯৭০-এর দশকের কথা। একটি সিনেমা বানানো হবে। সিনেমাটি বানাতে ভারতের গুজরাট রাজ্যের পাঁচ লাখ দুগ্ধ খামারি দুই রুপি করে চাঁদা দিয়েছিলেন। কৃষকদের চাঁদায় তৈরি সেই সিনেমা গড়ে নতুন ইতিহাস।
প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা শ্যাম বেনেগাল পরিচালিত 'মন্থন' ভারতের প্রথম ক্রাউড-ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে (আগ্রহীদের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহ) নির্মিত চলচ্চিত্র।
১৯৭৬ সালে নির্মিত ১৩৪ মিনিট দৈর্ঘ্যের সিনেমাটির গল্প আবর্তিত হয়েছে দুগ্ধ সমবায় আন্দোলনের সূচনাকে কেন্দ্র করে। পরবর্তীতে এই সিনেমায় দেখানো দুগ্ধ সমবায় আন্দোলনের পথ ধরেই দুধের ঘাটতিতে থাকা দেশ থেকে শীর্ষস্থানীয় দুধ উৎপাদনকারীতে পরিণত হয় ভারত।
এ সিনেমার কাহিনির অনুপ্রেরণা নেওয়া হয়েছে ভার্গিস কুরিয়েনের জীবন থেকে। দেশের দুধ উৎপাদনে বিপ্লন ঘটিয়ে দেওয়া এই মানুষটি বিখ্যাত 'মিল্কম্যান অভ ইন্ডিয়া' নামে। (ভারত এখন দুধের মোট বৈশ্বিক উৎপাদনের প্রায় এক-চতুর্থাংশ করে থাকে।)
নির্মাণের প্রায় ৫০ বছর পর কান চলচ্চিত্র উৎসবে জাঁ-লুক গদার, আকিরা কুরোসাওয়া ও উইম ওয়েন্ডারসের ক্লাসিক চলচ্চিত্রের সঙ্গে রেড কার্পেট ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হবে 'মন্থন'-এর। সম্প্রতি ছবিটির মূল প্রিন্ট রিস্টোর করা হয়েছ। কানে এই নতুন প্রিন্টই দেখানো হবে।
পুরস্কার বিজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাতা, আর্কাইভিস্ট ও পুনরুদ্ধারকারী শিবেন্দ্র সিং দুঙ্গারপুরের জানান, ছবিটি রিস্টোর করা চ্যালেঞ্জিং কাজ ছিল।
কারণ 'মন্থন'-এর স্রেফ ক্ষতিগ্রস্ত একটি নেগেটিভ ও দুটি বিবর্ণ প্রিন্ট টিকে ছিল। ছত্রাক পড়ে নেগেটিভটি অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে, সবজেটে দাগ পড়ে গেছে অনেক জায়গায়। আর সাউন্ড নেগেটিভ তো পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ফলে বেঁচে যাওয়া একমাত্র প্রিন্টখানার সাউন্ডই ছিল পুনরুদ্ধারকারীদের ভরসা।
পুনরুদ্ধারকারীরা ওই নেগেটিভ আর একটি প্রিন্ট উদ্ধার করেছেন। ওই প্রিন্ট থেকে সাউন্ড নিয়ে সেটি ডিজিটালাইজ করে ফিল্মটি মেরামত করেন তারা। স্ক্যানিং ও ডিজিটাল ক্লিন-আপ করা হয় চেন্নাইয়ের একটি ল্যাবে, ইতালির বোলোনিয়া-ভিত্তিক বিখ্যাত এক ফিল্ম রিস্টোরেশন ল্যাবের তত্ত্বাবধানে। আর পুরো প্রকল্পের তত্ত্বাবধানে ছিলেন শ্যাম বেনেগাল ও তার দীর্ঘ সময়ের সিনেমাটোগ্রাফার গোবিন্দ নিহালানি। বোলোনিয়ার ল্যাবটিতে ফিল্মটির সাউন্ড মেরামর করে আরও উন্নত করা হয়।
প্রায় ১৭ মাস কাজ করার পর আল্ট্রা হাই ডেফিনিশন ফোরকে-তে পুনর্জন্ম হয় 'মন্থন'-এর। ভারতীয় সিনেমার অন্যতম পথিকৃৎ শ্যাম বেনেগাল জানান, এ ছবির স্থান তার হৃদয়ের খুব কাছাকাছি।
৮৯ বছর বয়সি এই চলচ্চিত্র নির্মাতা বলেন, 'চলচ্চিত্রটিকে জীবন্ত হয়ে উঠতে দেখলাম, যেন গতকালই বানানো হয়েছে। এ এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।'
বেনেগাল জানান, কুরিয়েনের থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি অপারেশন ফ্লাড (ভারতের দুধ বিপ্লব) এবং গ্রামীণ বিপণন উদ্যোগের ওপর বেশ কয়েকটি তথ্যচিত্র বানিয়েছিলেন। তিনি যখন আরও বেশিসংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য কুরিয়েনকে একটি পূর্ণাঙ্গ ফিচার ফিল্ম নির্মাণের প্রস্তাব দেন, কুরিয়েন তাতে রাজি হননি। বেনেগালকে কুরিয়েন বলেছিলেন, ছবিটি বানানোর টাকা নেই।
সমবায় মডেলের আওতায় ক্ষুদ্র কৃষকেরা গুজরাটের সংগ্রহকেন্দ্রের নেটওয়ার্কে সকাল ও সন্ধ্যায় দুধ নিয়ে এসে বিক্রি করতেন। সেখান থেকে মাখনসহ অন্যান্য পণ্য তৈরির জন্য ওই দুধ পাঠানো হতো ডেইরিতে।
কুরিয়েন প্রস্তাব দিলেন, সংগ্রহকেন্দ্রগুলো প্রত্যেক কৃষকের কাছ থেকে দুই রুপি করে কেটে নেবে। এতে কৃষকেরাই হয়ে যাবেন এ সিনেমার প্রযোজক। কৃষকদের কাছ থেকে তোলা টাকায় তৈরি হলো 'মন্থন'। বেনেগাল বলেন, 'কৃষকদের আমরা গল্পটা শোনাই, তারপরই তারা চাঁদা দিতে রাজি হয়ে যান।'
'মন্থন'-এর অভিনেতার তালিকাও ছিল দুর্দান্ত। এ ছবির প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন গিরিশ কার্নাড, স্মিতা পাতিল, নাসিরুদ্দিন শাহ, অমরিশ পুরি, কুলভূষণ খারবান্দা ও মোহন আগাশে। কয়েকটি চিত্রনাট্য প্রস্তুত করেন বিশিষ্ট নাট্যকার বিজয় টেন্ডুলকার। এর মধ্য থেকে একটি চিত্রনাট্য বেছে নেন বেনেগাল। আর ছবির সংগীত পরিচালনা করেন প্রখ্যাত সুরকার বনরাজ ভাটিয়া।
ছবিতে দেখা যায়, শহরে বেড়ে ওঠা একজন সরকারি পশুচিকিৎসক ও তার দল দুগ্ধ সমবায় শুরু করার পরিকল্পনা নিয়ে গুজরাটের এক গ্রামে পৌঁছেছেন। কিন্তু গ্রামবাসীর মধ্যে ছিল গভীর বিভক্তি। তাই কাজ শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে অস্থির রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচে পড়ে যান ওই পশুচিকিৎসক। একটি ব্যক্তিগত ডেইরির মালিক, গ্রামপ্রধান ও স্থানীয় এক দুধওয়ালার তার কাজে পদে পদে বাধা দিতে থাকেন।
'ওয়ার্ল্ড ডিরেক্টর সিরিজ: শ্যাম বেনেগেল'-এর লেখক সঙ্গীতা দত্ত লিখেছেন, 'মন্থন হচ্ছে রূপান্তরে ইচ্ছুক রাজনীতির এক ছোট্ট প্রতিচ্ছবি।'
'মন্থন'-এর বাজেট ছিল কম। আর ৪৫ দিনে শুটিং শেষ করা ছিল বড় চালেঞ্জ। গোবিন্দ নিহালানি জানান, সিনেমার ক্রুরা গ্রামে একটি যৌথ পরিবার হিসেবে থাকতেন। গ্রামটির অনেক বাসিন্দাও ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। শুটিংয়ের পুরো সময়ে অভিনেতারা কস্টিউম বদলাননি, যাতে পোশাকগুলোকে বহুল ব্যবহারে জীর্ণ দেখায়।
বেনেগালের সঙ্গে অভিনয়জীবন শুরু করা নাসিরুদ্দিন শাহ পরে ভারতের অন্যতম বিখ্যাত অভিনেতা হয়ে ওঠেন।
'মন্থন' নির্মাণের সময়কার স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে তিনি বলেন, 'আমি একটি কুঁড়েঘরে থাকতাম। গোবরের ঘুঁটে বানানো, গরুর দুধ দোয়ানোও শিখেছিলাম। চরিত্রের শারীরিক ভঙ্গি আয়ত্তে আনার জন্য বালতিতে করে ইউনিটের সবাইকে দুধ পরিবেশন করতাম।' গোটা শুটিং তিনি একটা সুতির শার্ট পরেই কাটিয়ে দিয়েছিলেন।
কুরিয়েন প্রথমে ছবিটি গুজরাটে মুক্তি দেন। সেখানে দারুণ সাড়া পান।
বেনেগাল বলেন, 'ছবিটির প্রযোজকেরাই ছিলেন এর সবচেয়ে বড় দর্শকশ্রেণি। সেজন্যই ছবিটি দারুণ সাফল্য পায়। প্রতিদিনই আমরা দেখতাম, সব জায়গা থেকে ট্রাক ভর্তি করে মানুষ আসছে ছবিটি দেখতে।'
৩৫ মিলিমিটার থেকে ৮ মিলিমিটার, সুপার এইট, পরে ভিডিও ক্যাসেট ফরম্যাটেও 'মন্থন'-এর কপি হয়। ভারতে আর কোনো সিনেমার এতগুলো ফরম্যাটের কপি হয়নি। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদসহ সারা বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় 'মন্থন' দেখানো হয়। আর দেশে ছবিটি জাতীয় পুরস্কার জিতে নেয়।
'মন্থন'-এর সাফল্যে কুরিয়েন নতুন বুদ্ধি পান। দুগ্ধ বিপ্লব ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তিনি এ ছবিকে কাজে লাগান। দেশজুড়ে গ্রামে গ্রামে 'মন্থন'-এর ১৬ মিলিমিটারের প্রিন্ট বিতরণ করেন তিনি। কৃষকদেরকে তাদের নিজস্ব সমবায় প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান। রুপালি পর্দার অনুকরণে বাস্তবেও তিনি কৃষকদের মধ্যে ছবিটি বিতরণ ও প্রদর্শনের জন্য একজন পশুচিকিৎসক, একজন দুধ প্রযুক্তিবিদ ও একজন পশুখাদ্য বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে একটি দল পাঠান।
বেনেগাল বলেন, 'পরিবর্তন আনার জন্য সিনেমা যে কতটা শক্তিশালী' সে কথাই মনে করিয়ে দেয় 'মন্থন'। ছবিটি আজও আশ্চর্যভাবে সমান প্রাসঙ্গিক। কারণ এতে এমন সব ইস্যু উঠে এসেছে যা নিয়ে ভুগছে বর্তমান ভারতও।
যেমন, 'মন্থন'-এর একেবারে শুরুতেই দেখা যায়, ট্রেন এসেছে দেরি করে, যা দেশটিতে রীতিমতো ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। ট্রেন সময়মতো চলে আসা সেখানে একটা ব্যতিক্রমী ঘটনাই বটে। প্রথম দৃশ্যে দেখা যায়, এক নিস্তরঙ্গ গ্রামের স্টেশনে ট্রেন থেকে নামছেন ডাক্তার আর তার সহকারী। স্থানীয়রা খানিকটা দেরি করে হন্তদন্ত হয়ে প্ল্যাটফর্মে আসেন ডাক্তারকে ফুলে মালা দিয়ে বরণ করে নিতে।
হাঁপাতে হাঁপাতে গ্রামের এক বাসিন্দা তাদের দেরি হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন, 'মাফ কি জিয়ে, গাড়ি টাইম পে আ গ্যায়ি (মাফ করবেন, গাড়ি সময়মতো চলে এসেছে)।' ট্রেন বিলম্বে আসার এই সমস্যা আজও রয়ে গেছে দেশটিতে।