‘কর ফাঁকি এড়াতে’ ফার্নেস, বেইজ ও লুব তেলের ট্যারিফ মূল্য বাড়াতে যাচ্ছে এনবিআর
আসন্ন বাজেটে ফার্নেস তেল, বেইজ তেল ও লুব্রিকেন্ট তেলের ট্যারিফ মূল্য দ্বিগুণ পর্যন্ত বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর ফলে আমদানিকারকদের মিথ্যা ঘোষণার কারণে বর্তমানে হাতছাড়া হওয়া প্রায় ৯০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব সংগ্রহের আশা করছে কর কর্তৃপক্ষ।
রাজস্ব নীতি প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন সূত্রের ইঙ্গিত, ফার্নেস তেলের ট্যারিফ মূল্য দ্বিগুণ হতে পারে। অন্যদিকে বেইজ তেল ও লুব্রিকেন্ট তেলের ট্যারিফ বিদ্যমান স্তর থেকে ৫০ শতাংশের বেশি বাড়তে পারে।
বর্তমানে ফার্নেস তেলের ট্যারিফ মূল্য প্রতি মেট্রিক টনে ২৬৫ ডলার। বেইজ তেল (লুব্রিকেন্ট তেল তৈরির একটি কাঁচামাল) ও লুব্রিকেন্টে তেলের ট্যারিফ মূল্য যথাক্রমে ৭০০ ও দুই হাজার ডলার। এছাড়া, এ তিন ধরনের তেলের মোট করহার যথাক্রমে ৩৪ শতাংশ, ৩১ শতাংশ ও ৪৯ শতাংশ।
ফার্নেস তেল প্রধানত ভারী জ্বালানি তেলচালিত (এইচএফও) বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রে ব্যবহৃত হয়। শিল্প, পরিবহন ও অন্যান্য খাতে বিভিন্ন ইঞ্জিনে লুব তেল ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশের প্রায় ৬০টি বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র জাতীয় গ্রিডের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে ফার্নেস তেল ব্যবহার করে।
যদিও কর্মকর্তারা দাবি করছেন, এ পদক্ষেপের ফলে এসব পণ্যের দাম বাড়বে না, তবে শিল্পসংশ্লিষ্ট ও বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, তিনটি তেলের ধরনের ভুল মূল্যায়ন শিল্পের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে যা শেষ পর্যন্ত গ্রাহকদের প্রভাবিত করবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, তিন ধরনের তেলের ট্যারিফ মূল্য বা ন্যূনতম মূল্য আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যের তুলনায় অনেক কম।
রাজস্ব বোর্ড আগামী বাজেটে এ ট্যারিফ মূল্যসমূহ সামঞ্জস্য করার বিষয়ে বিবেচনা করছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, এ পদক্ষেপ তেলের দাম বাড়াবে না। 'এর লক্ষ্য হলো মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে কর ফাঁকি রোধ করা এবং আমদানিকারকেরা যেন কর পরিশোধ এড়াতে তাদের পণ্যের মূল্য কম ঘোষণা করতে না পারেন তা নিশ্চিত করা।'
ট্যারিফ মূল্য হলো একটি ন্যূনতম মূল্য যা শুল্ক কর্তৃপক্ষ আমদানিকৃত পণ্যের মূল্যায়নের জন্য প্রজ্ঞাপন [এসআরও] জারির মাধ্যমে নির্ধারণ করে। যদি এ হার কোনো পণ্যে প্রয়োগ করা হয়, তাহলে আমদানিকারক সে পণ্যের কম দাম ঘোষণা করতে পারেন না।
উচ্চমূল্যে পণ্য আমদানি করা হলে আমদানিকারকেরা উচ্চমূল্য ঘোষণা করতে পারেন। এর সঙ্গে ট্যারিফ মূল্য বাড়লে আমদানি করও বেড়ে যায়।
দেশে শতাধিক পণ্যের জন্য ট্যারিফ বা ন্যূনতম হার নির্ধারণ করা আছে। যদিও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এ ব্যবস্থার পক্ষে নয়।
'সঠিক মূল্য নির্ধারণ গুরুত্বপূর্ণ'
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক সদস্য মো. ফরিদ উদ্দিন বলেন, সঠিকভাবে ট্যারিফ মূল্য নির্ধারণ করা জরুরি। প্রকৃত আমদানি ব্যয়ের চেয়ে মূল্য বেশি হলে ভোক্তারা বর্ধিত চাপের সম্মুখীন হতে পারেন।
যেমন, যদি একটি পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য প্রতি মেট্রিক টন এক হাজার ডলার হয় কিন্তু ট্যারিফ মূল্য দেড় হাজার ডলার ঠিক করা হয়, তাহলে ভোক্তাকে আমদানি খরচের চেয়ে বেশি ব্যয় করতে হবে।
এছাড়া ফরিদ উদ্দিন উল্লেখ করেন, পণ্যের মান তার মূল্যকে প্রভাবিত করে। যেমন রিকশা আর বিমানের লুব তেল এক নয়।
'রিকশায় ব্যবহৃত লুব্রিকেন্টের দাম অবশ্যই কম হবে। এ লুব্রিকেন্টের ট্যারিফ মূল্য তার প্রকৃত মূল্যের চেয়ে বেশি হলে তা-তে রিকশাচালকের খরচ বাড়বে,' ব্যাখ্যা করে বলেন তিনি।
তাই তিনি ট্যারিফ ব্যবস্থা ব্যবহার না করে প্রকৃত মূল্যের ওপর ভিত্তি করে কর আরোপের পরামর্শ দেন। 'এনবিআরের উচিত প্রকৃত মূল্য নির্ধারণে নিজস্ব সক্ষমতা তৈরি করা,' বলেন তিনি।
ফার্নেস তেল
বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী দেশ এনার্জির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাভিদুল হক বলেন, সরকার তাদের ফার্নেস অয়েলের খরচ বহন করে। তাই এটির ব্যয় বাড়লে তা সরকারের বোঝা বাড়াবে।
তিনি আরও বলেন, তাদের মোট পরিচালন ব্যয়ের প্রায় ২০ শতাংশ খরচ হয় লুব্রিকেন্ট তেলে, যা তাদের নিজেদেরকে বহন করতে হয়। যদি এ তেলের দাম বেড়ে যায়, তাহলে তাদের পরিচালন খরচ অবশ্যই বেড়ে যাবে।
ইতোমধ্যে বকেয়া পাওনার ফলে সৃষ্ট লোকসানের কথা উল্লেখ করে নাভিদুল হক তেলের ট্যারিফ মূল্য বাড়ানোর এ পদক্ষেপের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, দাম আরও বাড়লে তাদের পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
লুব্রিকেন্ট ও বেইজ তেল
বাংলাদেশ লুব ব্লেন্ডার অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, দেশ লুব্রিকেন্ট অয়েলের বার্ষিক চাহিদা প্রায় এক লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন। বর্তমানে স্থানীয় তেল উৎপাদকেরা এ চাহিদার ৫০ শতাংশেরও বেশি পূরণ করছে।
রাজস্ব কর্মকর্তারা বলছেন, লুব্রিকেন্টের প্রধান সরবরাহকারী এবং আমদানিকারকেরা সাধারণত প্রকৃত আমদানি মূল্যের কাছাকাছি ঘোষণা করেন, যা মোট আমদানির প্রায় ৭০ শতাংশ।
তবে বাকি ৩০ শতাংশ আমদানিকারক নির্ধারিত ট্যারিফ মূূল্যের ক্ষেত্রে আমদানি ব্যয়কে কম করে দেখাতে পারবেন না ভেবে চিন্তিত হতে পারেন।
বেইজ তেলের বিষয়ে বাংলাদেশ লুব ব্লেন্ডার অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব সালেহ অর্পণ বলেন, যদি ট্যারিফ মূল্য আন্তর্জাতিক মূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তবে এটি তাদের জন্য কোনো সমস্যা তৈরি করবে না। কারণ, তারা এ মুহূর্তেই প্রকৃত আমদানি মূল্য ঘোষণা করছেন।
তবে আন্তর্জাতিক হারের চেয়ে দাম বেশি নির্ধারণ করা হলে তা তাদের উৎপাদন খরচ বাড়াতে পারে এবং ভোক্তাদের ওপর অতিরিক্ত চাপ ফেলতে পারে বলে মনে করেন অর্পণ।