বাংলাদেশের প্রথম নারী চা নিলামকারী যিনি
বাবার অফিসে সর্বপ্রথম চায়ের স্বাদ যাচাইয়ের জগতের সাথে মাইশা রহমানের পরিচয়।
নিজের অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করতে গিয়ে তিনি বলেন "বাবা চায়ের স্বাদ যাচাইয়ের জন্য ব্যবহৃত চামচটি আমার হাতে দিয়ে বললেন, 'পার্থিব জগৎ থেকে নিজেকে আলাদা করে স্বাদের দিকে পুরোপুরি মনোযোগ দাও। তুমি যা অনুভব করছো সেটি পুরোপুরি বোঝার চেষ্টা করো।"
আহমেদুর রহমান সেলিম চায়ের জগতে দেশের অন্যতম সিনিয়র স্বাদ যাচাইকারী। তিনি এই পানীয়টির নানা প্রকারকে স্বাদে ভালো, খারাপ ও মাঝারি হিসেবে যাচাই করেন। সেক্ষেত্রে তিনি নিজ কন্যাকে বুঝিয়েছেন কেন চা রকমভেদে ভালো, খারাপ কিংবা অতি উন্নতমানের হয়ে থাকে।
এক্ষেত্রে মাইশা বলেন, "চায়ের স্বাদ যাচাইয়ের জন্য বইভিত্তিক জ্ঞানের প্রয়োজন হয় না। এটা মূলত পুরোটাই প্র্যাকটিসের ব্যাপার।"
তাহলে এক চা অন্যটির চেয়ে 'ভালো' হয় কী করে?
মাইশা বলেন, "বিষয়টি শুধু স্বাদের নয়। বরং দেখতে কেমন, ঘ্রাণ, রঙ ইত্যাদিও গুরুত্বপূর্ণ। চায়ের বডি, উজ্জ্বলতা (শব্দগুলো স্বাদ যাচাইয়ের জন্য ব্যবহৃত) ইত্যাদিও থাকা দরকার। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ক্যাটাগরি রয়েছে। কখনও কখনও অল্পস্বল্প ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও তা পানের জন্য উপযুক্ত হয়।"
চায়ের স্বাদ যাচাইয়ের প্রসেসের মধ্যে রয়েছে কাপে চায়ের লিকুইডের স্বাদ নেওয়া এবং গাছ থেকে ছেড়া পাতা সাজিয়ে রাখা। প্রথমে, স্বাদ যাচাইকারী একটি বড় হা করে এক চামচ চা মুখে নেয় এবং এটি তার মুখের চারপাশে ঘোরায়। তখন তিনি স্বাদের নোটসহ নানাবিধ জিনিস শনাক্ত করার চেষ্টা করে। তারপর সে মুখ থেকে লিকুইডটি বের করে নেন।
পরবর্তী পর্যায়ে চা সম্পর্কে আরও বিশদভাবে বোঝার জন্য পাতাগুলোকে পর্যবেক্ষণ করা হয়। মাইশা বলেন, "আমরা পাতায় দুধ মিশিয়েও দেখি এটি চা হিসেবে কেমন কাজ করে।"
এরপর নানারকম চা মান অনুযায়ী ক্যাটালগ ও মূল্য সংযোজন করা হয়। পরবর্তীতে ঐ ক্যাটালগগুলো ক্রেতাদের নিকট পাঠানো হয়।
দেশের প্রথম নারী চা নিলামকারী মাইশা দুই বছর ধরে চায়ের স্বাদ যাচাইকারী হিসেবে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। তিনি বলেন, "এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এটি এমন কিছু নয় যা একজন দ্রুত শিখে ফেলতে পারে। আমি আরও ভালো করে শিখতে চাই এবং আমার বাবার মতো একজন বিশেষজ্ঞ হতে চাই।"
'চা' পরিবারের মেয়ে
সিলেটের শ্রীমঙ্গলের সবুজ চা বাগানে মাইশার জন্ম। যদিও তিনি চট্টগ্রামে পড়াশোনা করেছেন এবং বর্তমানে সেখানেই তার পরিবারের সাথে থাকেন। এখন চা তার জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।
মাইশা বলেন, "আমি একজন চা পরিবারের মেয়ে।"
ছোটবেলায় তিনি তার দাদাকে চা বাগানে কাজ করতে দেখেছেন। এটি তাকে বেশ মুগ্ধ করেছিল। কেননা বাগানের ছোট ছোট পাতাগুলি অবশেষে একটি সুগন্ধযুক্ত পানীয়তে পরিণত হয়।
শৈশবে মাইশা চা বাগানে নিজের ছুটির একটা দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন। তার দাদাকে শ্রমিকদের সাথে বনিবনা করতে দেখেছেন। তার দাদা মুখলেসুর রহমান ১৯৫৬ সালে শ্রীমঙ্গলের নন্দরানী চা বাগানের ম্যানেজার ছিলেন।
মাইশা বলেন, "ব্রিটিশ শাসনামলে তার দাদা ছিলেন সবচেয়ে সুপরিচিত বাঙালি ম্যানেজারদের একজন। তিনি বেশ রাগী ছিলেন। তবে বাড়িতে এসে পরিবারের সাথে সময় কাটানোর সময় আর অতো মেজাজ থাকতো না।"
যদিও মাইশার বাবা ও চাচা দুজনেই চায়ের ব্যবসার সাথে জড়িত। তবে তাদের সাথে যুক্ত হতে পরিবারের এই মেয়েকে কোন চাপের সম্মুখীন হতে হয়নি। বরং এটি মাইশার অনেকটা আবেগ ছিল। যা তাকে প্রথমে একজন চায়ের স্বাদ যাচাইকারী এবং পরবর্তীতে প্রোডিউস ব্রোকার্স লিমিটেডের নিলামকারী হিসেবে গড়ে তুলেছে।
মাইশা বলেন, "আমি আমার বাবাকে চা বাগানে কাজ করতে দেখেছি। একইসাথে তারপর আমি দেখতে চেয়েছিলাম যে, তিনি কীভাবে চূড়ান্ত পণ্য আকারে সেটিকে বিক্রি করেন। তখন তিনি আমাকে তার অফিসে ডাকলেন।"
মাইশা ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। চা নিলামের সেশনসহ প্রায় সর্বত্র তিনি তার বাবার সাথে থাকতেন।
একদিন ২০২২ সালে নিলামের সময় মাইশার বাবা কন্যার দিকে ফিরে বললেন, "তুমি কি এটি (নিলাম পরিচালনা) একবার চেষ্টা করতে চাও?"
এভাবেই চা নিলামকারী হিসেবে মাইশার যাত্রা শুরু হয়। সেদিন যা ঘটেছিল সেগুলো তার সবই মনে আছে।
মাইশা বলেন, "নিলামে হাতুড়ি বাড়ি দেওয়া থেকে পুরো অভিজ্ঞতা পর্যন্ত আমার মনে আছে। ইস্পাহানি, আবুল খায়ের, মেঘনা, এইচআরসি, ফিনলে ইত্যাদি সকল দেশীয় ক্রেতারা সবাই আমাকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানিয়েছে। আমার জীবনের প্রথম লট ইস্পাহানি মির্জাপুর চা বাগানে (নিলাম করা হয়েছিল) এবং এটি বেশ ভালো একটা অনুভূতি ছিল।"
চা নিলামের দুনিয়ায়
মাইশা বলেন, "যখন আমি প্রথম প্রত্যক্ষভাবে একটি নিলাম দেখেছিলাম, তখন আমার সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি বেশ ভালো লেগেছিল। চোখের পলকে কয়েক কেজি চা বিক্রি হয়ে যায়।"
বর্তমানে প্রতি সোমবার মাইশা চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে শত শত ক্রেতার সামনে নিলাম করেন। তিনি ঐদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই কাজে ব্যস্ত থাকেন, দুপুরের খাবারের জন্য মাত্র এক ঘণ্টা বিরতি নেন।
নিলামটি নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশ টি ট্রেডার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টিটিএবি)। প্রডিউস ব্রোকারসহ বাংলাদেশে সাতটি চা ব্রোকার কোম্পানি রয়েছে।
নিলামের আগে মাইশা ও তার টিমকে কিছু পূর্ব পরিকল্পনা করতে হয়। যেমন বাজার গবেষণা করা, দামের পরিবর্তনের দিকে নজর রাখা ইত্যাদি।
মাইশা বলেন, "সোমবার আমরা খুব ব্যস্ত থাকি। আপনাকে বুঝতে হবে যে, নিলাম বিষয়টি একটি বেশ বিচারতাত্ত্বিক বিষয়। আমাদের ঘটনাস্থলেই এই বিচারটি করতে হয়।"
নিলামের স্থানে ক্রেতাদের জন্য চায়ের নমুনা প্রদর্শন করা হয়। একইসাথে তাদের নিকটও কিছু নমুনা দেওয়া হয়। যাতে করে তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারে, কোন নমুনাটি তারা কিনবে।
চা নিলামকারী হিসেবে কী অন্য নারীরা নিজেদের ক্যারিয়ার গড়তে পারে? এমন প্রশ্নের জবাবে মাইশা বলেন, এটি অবশ্যই নারীদের জন্য একটি বিকল্প ক্যারিয়ার হতে পারে। আমি যদি এটা করতে পারি; সেখানে তো আমার থেকেও অনেক যোগ্য নারী আছেন। তারা আরও ভালো করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।"
মাইশা চায়ের স্বাদ যাচাইকারী ও নিলামকারী উভয় কাজই চালিয়ে যেতে চায়। কিন্তু সে এটাও মনে করে যে, চায়ের স্বাদ যাচাইয়ের বিষয়টি আরও চ্যালেঞ্জিং। এক্ষেত্রে তাকে আরও বেশি মনোযোগী হতে হবে।