মেগা প্রকল্প: মেট্রোরেলের দুই প্রকল্পের বরাদ্দ কমেছে, বেড়েছে একটিতে
আগামী অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) মেট্রোরেলের দুটি প্রকল্প এমআরটি-৬ ও এমআরটি-১-এ বরাদ্দ কমেছে। তবে এমআরটি-৫ নর্দার্ন রুট প্রকল্পে আগামী বরাদ্দ সামান্য বেড়েছে।
আগামী অর্থবছরের এডিপিতে বেশিরভাগ মেগা প্রকল্পের জন্যই বরাদ্দ বাড়ানো হয়নি। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের শেষ পর্যায়ে থাকায় অর্থ ব্যয়ের চাহিদা কমেছে। এ কারণে বেশিরভাগ মেগা প্রকল্পে আগামী অর্থবছরেও বরাদ্দ কমেছে।
প্রকল্প কর্মকর্তারা জানান, সব মেগা প্রকল্পে বরাদ্দের চাহিদা নির্ধারণে সতর্ক ছিল বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো। আগামী অর্থবছরে শুধু যে পরিমাণে অর্থের প্রয়োজন হবে, সেটাই বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।
তারা বলেন, এবার এমনভাবে চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে, যাতে অব্যবহৃত অর্থ ফেরত না যায়। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে বেশি বরাদ্দের প্রয়োজন হলে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ বাড়ানোর কৌশল নেওয়া হয়েছে।
এডিপি পর্যালোচলা করে দেখা গেছে, এমআরটি-৬, এমআরটি-১, এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়ক, যমুনা রেল সেতু, পদ্মা রেল সংযোগ, ঢাকা বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পের মতো বড় বড় প্রকল্পগুলোতে গত অর্থবছরের তুলনায় বরাদ্দ কমেছে।
বিপরীতে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও ঢাকা-সিলেট চার লেন সড়কের জন্য অর্থায়ন বাড়ানো হয়েছে।
মেগা প্রকল্পে বরাদ্দ কমানো ও অতিরিক্ত বরাদ্দ না রাখাকে স্বাগত জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে মেগা প্রকল্পে অতিরক্তি অর্থ বরাদ্দ না রাখাই যৌক্তিক হবে।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের (পিইবি) চেয়ারম্যান ও সিইও এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, 'আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতি চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ফলে এই মুহূর্তে উন্নয়ন ব্যয়ে লাগাম টানা দরকার। অগ্রাধিকার দিয়ে মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'মেগা প্রকল্পের যে অর্থ এখনই ব্যয় না করলে কোনো সমস্যা হবে না, সেখানে বরাদ্দ কমানোই ভালো। মেগা প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় বন্ধ না হলে আগামী অর্থবছরেও উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।'
অনেকটা একই মত প্রকাশ করে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) গবেষণা পরিচালক সায়েমা হক বিদিশা বলেন, সরকার সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কারণ ঘাটতি মেটাতে হবে।
এ অর্থনীতিবিদ আপাতত নতুনগুলো বন্ধ রেখে বিদ্যমান জরুরি প্রকল্পগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়ার পরামর্শ দেন। তবে তিনি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে অর্থ বরাদ্দ অব্যাহত রাখার পরামর্শ দেন।
প্রয়োজনে বৈদেশিক ঋণ সংশোধন করা হবে
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা বলেন, প্রকল্পগুলোতে কতটুকু বৈদেশিক ঋণ ব্যবহার করা হবে, সেই সিদ্ধান্ত নেয় অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। প্রয়োজনে তারা সংশোধিত এডিপিতে বৈদেশিক সহায়তা বাড়াতে পারে।
তবে বৈদেশিক ঋণ বরাদ্দ করার জন্য সরকারি তহবিলে 'ম্যাচিং ফান্ড' রাখতে হয়। ফলে বৈদেশিক ঋণ অতিরিক্ত বরাদ্দ রাখলে সরকারি তহবিলের বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
কর্মকর্তারা জানান, এ কারণে আগামী অর্থবছরে মেগা প্রকল্পে অহেতুক বরাদ্দ বেশি রাখা হয়নি। যে অর্থ ব্যবহার না করলেই নয়, কেবল সেটুকুই বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
পরিকল্পনা বিভাগের সাবেক সচিব মামুন-আল-রশীদ বলেন, প্রায় সব মেগা প্রকল্পই বৈদেশিক ঋণে বাস্তবায়ন হচ্ছে। বৈদেশিক ঋণের এসব প্রকল্প সরকার অগ্রাধিকার দিয়ে বাস্তবায়ন করছে। ফলে প্রকল্পগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ দেওয়া হয়।
উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্পে বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে কম চাহিদা থাকা প্রকল্পগুলো প্রত্যাশা অনুযায়ী কম বরাদ্দ পেতে পারে।
মেগা প্রকল্পে ঋণের বিষয়ে অর্থনীতিবিদ সায়েমা হক বিদিশা বলেন, সরকারকে দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে।
তিনি আরও বলেন, 'আমরা যদি বিদেশি ঋণ নিই, তাহলে চীনের মতো উচ্চ-সুদের ঋণদাতাদের এড়িয়ে স্বল্প সুদে ঋণ দেয় এমন দেশ বা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বেছে নেওয়া ভালো।'
বরাদ্দ কমেছে
অনুমোদিত এডিপির তথ্য অনুযায়ী, মেট্রোরেল লাইন এমআরটি-৬ (মতিঝিল থেকে কমলাপুল) প্রকল্পেরর জন্য আগামী অর্থবছরে বরাদ্দ কমেছে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে একেবারে শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আগামী অর্থবছরে এডিপিতে এই প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের এডিপির তুলনায় আগামী এডিপিতে এই প্রকল্পের বরাদ্দ কমেছে ৪২ শতাংশ। আর সংশোধিত এডিপির তুলনায় আগামী অর্থবছরের এডিপিতে এই প্রকল্পের বরাদ্দ ১৮ কোটি টাকা কমেছে।
এমআরটি-১ প্রকল্পে আগামী অর্থবছরে ৩ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। দেশের প্রথম পাতাল রেল বিমান বন্দর থেকে কমলাপুর এবং নতুনবাজার-পূর্বাচল পর্যন্ত মেট্রোরেলের এই প্রকল্পে বরাদ্দ চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৮ শতাংশ কমেছে।
এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দ কমেছে। এ প্রকল্পে চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ৫০১ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের এডিপি বরাদ্দের চেয়ে ১২ শতাংশ কম। আর চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপির তুলনায় এ প্রকল্পে বরাদ্দ ৩৫ শতাংশ কমেছে।
এ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কাজ প্রায় ৭৫ শতাংশ শেষ। এ কারণে প্রতি অর্থবছরেই পর্যায়েক্রমে চাহিদা কমছে। চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরে যেমন চাহিদা কমেছে, আবার এর পরের অর্থবছরের আরও কম বরাদ্দের প্রয়োজন হবে।
যমুনা নদীর ওপর নির্মিতব্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু নির্মাণ প্রকল্পে বরাদ্দ কমেছে। আগামী অর্থবছরে এই প্রকল্পের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। এই বরাদ্দ চলতি অর্থবছরের এডিপির চেয়ে ৩২.২৪ শতাংশ এবং সংশোধিত এডিপির চেয়ে ৫.৮০ শতাংশ কম।
প্রকল্প পরিচালক আল ফাত্তাহ মো. মাসুদুর রহমান বলেন, এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের শেষ পর্যায়ে থাকার কারণে চাহিদা কমেছে। এ কারণে আগামী অর্থবছরে যেটুকু প্রয়োজন, সেটুকুই শুধু বরাদ্দ নেওয়া হয়েছে। 'কারণ অতিরিক্ত বরাদ্দ নিয়ে ব্যয় করা না গেলে জটিলতা তৈরি হয়। তবে প্রয়োজনে সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে।'
একইভাবে বাস্তবায়নের একেবারে শেষ পর্যায়ে থাকা পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পেও আগামী বছরের বরাদ্দ কমছে। এ প্রকল্পে আগামী অর্থবছরে ৩ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপি বরাদ্দের চেয়ে আগামী অর্থবছরের এডিপিতে এই প্রকল্পের বরাদ্দ ২৬ শতাংশ কম। একইভাবে চলতি অর্থবছরের এডিপির তুলনায় আগামী অর্থবছরে রেল পদ্মা সংযোগ প্রকল্পে বরাদ্দ ৩৩.৫৫ শতাংশ কমেছে।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পে নতুন অর্থবছরে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৩ হাজার ৫৩৫.৬৮ কোটি টাকা। এ বরাদ্দ চলতি অর্থবছরের এডিপির তুলনায় ৩৬ শতাংশ এবং সংশোধিত এডিপির তুলনায় ৩১ শতাংশ কম। আগামী অর্থবছরের মধ্যে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কাজ শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
মাতারবাড়ী আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল-ফায়ারড বিদ্যুৎ প্রকল্পে আগামী অর্থবছরের জন্য ৬ হাজার ১০৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এই বরাদ্দ চলতি অর্থবছরের এডিপি ও সংশোধিত এডিপির চেয়ে ৩৪ শতাংশ। এদিকে ঢাকা-আশুলিয়া এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পেও গত অর্থবছরের এডিপির তুলনায় ১৪ শতাংশ বরাদ্দ কমেছে।
বরাদ্দ বেড়েছে
অন্যান্য মেগা প্রকল্পের বরাদ্দ কমলেও বেড়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ব্যয়ের প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে। আগামী অর্থবছরে এ প্রকল্পে ১০ হাজার ৫০২.৯০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গত বছরের এডিপি ও সংশোধিত এডিপির তুলনায় এ বরাদ্দ ৮.২০ শতাংশ বেশি। আগামী অর্থবছরে এই প্রকল্পে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া এমআরটি-৫ নর্দার্ন রুট প্রকল্পে আগামী অর্থবছরে বরাদ্দ সামান্য বেড়েছে। আগামী অর্থবছরের এডিপিতে এই প্রকল্পে ৯৬৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হযেছে। এই বরাদ্দ চলতি অর্থবছরের এডিপির তুলনায় ১০ শতাংশ এবং সংশোধিত এডিপির তুলনায় ২৪ শতাংশ বেশি।
সড়কের বড় প্রকল্পের মধ্যে ঢাকা-সিলেট করিডর উন্নয়ন প্রকল্পে চলতি অর্থবছরের এডিপির তুলনায় ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ বেশি দেওয়া হয়েছে।
আগামী অর্থবছরে সরকারের আরেকটি নতুন মেট্রোরেল প্রকল্প, এমআরটি-৫-এর অনুমোদন দেওয়ার কথা রয়েছে। এমআরটির এই রুটটি গাবতলী থেকে আফতাবনগর পর্যন্ত ১৩.১০ কিলোমিটার যাবে মাটির নিচ দিয়ে এবং আফতাবনগর থেকে দাশেরকান্দি পর্যন্ত ৪.১০ কিলোমিটার যাবে উড়ালপথে। এই প্রকল্পে মোট ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫৪ হাজার ৬১৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণ ধরা হয়েছে ৩৯ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা।