অভিবাসী কর্মীর জন্য দ্বার উন্মুক্ত করেছে জাপান, বাংলাদেশিরা কী এর সুবিধা নিতে পারবে?
আজ থেকে সাত বছর আগের কথা; প্রকৌশলবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রী অর্জনের চাইতে মায়ের দেখাশোনা করাকেই অগ্রাধিকার দেন ইস্থিনা হিমি। রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ সেমিস্টারের ছাত্রী থাকাকালে তার বাবা-মার বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। এসময় মায়ের সঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় হিমির পড়াশোনার খরচ দেওয়া বন্ধ করে দেন তার বাবা।
নড়াইলবাসী হিমি স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেই উচ্চ-মাধ্যমিক পাস করেছিলেন। এখন অবশ্য আর সেখানে থাকেন না। মাকে নিয়ে এখন থাকেন গাজিপুরের কাপাসিয়া উপজেলার নানাবাড়িতে। এভাবে তার জীবনের গতিপথ আমূল বদলে যায় বেদনাময় সময়ের পরিক্রমায়।
অনেক বছর পর অবশ্য তার জীবনে ক্ষীণ আশার আলো দেখা দেয়, যখন গত বছরের ডিসেম্বরের শেষে জাপানের মাচিডা হাসপাতালে একজন সেবিকা হিসেবে চাকরির জন্য নিবন্ধন করেন হিমি। তার মাও কাপাসিয়ার একটি বেসরকারি হাসপাতালে সেবিকার চাকুরি করেন। মাকে ঘিরে উদ্বেগের অন্ত নেই হিমির। মার কথা ভেবেই জাপানে চাকরির মাধ্যমে তাকে সহযোগিতা করতে চেয়েছিলেন।
''মা আমাকে সকল প্রকার সাহায্য করেছেন। তাই আমি তার শেষ বয়সের অবলম্বন আর নির্ভরতার স্থল হতে চাই। সেজন্যই নিজেকে প্রস্তুত করছি'' বলেন হিমি।
করোনাভাইরাস যদি বিশ্বজুড়ে না ছড়াতো আর আকাশপথে চলাচলে নিষেধাজ্ঞা বহাল না করা হতো; তবে গত ১১ জুনেই জাপানের উদ্দেশ্যে মাতৃভূমি ছেড়ে যেতেন তিনি।
তবে হিমি একা ভাগ্যের পরিহাসের পাত্র নন; তার মতো আর চার শতাধিক নারী-পুরুষের জাপান যাত্রা এখন স্থগিত হয়ে আছে। বিদেশের মাটিতে ওই দেশের মান ও চাহিদা অনুসারে হাসপাতাল এবং বৃদ্ধাশ্রমে সেবা দেওয়ার যোগ্যতা অর্জনে তারা অনেক পথ পাড়ি দেন। শিক্ষানবিশ হিসেবে নির্বাচিত হওয়া, প্রশিক্ষণ ও সেই অনুযায়ী কর্মসংস্থান বাছাইয়ের দীর্ঘ একবছর মেয়াদি প্রশিক্ষণে শেষ পর্যন্ত টিকেছেন এই চারশত জন। তবু সবশেষে এসে কিনা স্বপ্নপূরণে বাঁধা হয়ে দাঁড়াল কোভিড-১৯ বিশ্বমারি।
দেশের সবচেয়ে বড় প্রবাসী কর্মসংস্থান বাজারে অনিশ্চয়তা:
দেশের প্রবাসী আয়ের বড় উৎস ছিল মধ্যপ্রাচ্য। কিন্তু, মহামারি সৃষ্ট মন্দায় সেখানে অনেক সেবা খাতের ব্যবসা বন্ধ হয়েছে। তেলের দরপতনের কারণে হয়েছে বাজেট কর্তন, বাতিল হয়েছে অনেক উচ্চাভিলাষী অবকাঠামো নির্মাণ উদ্যোগ। বৈশ্বিক সঙ্কটের এ পরিক্রমার পরও মধ্যপ্রাচ্যের শ্রম বাজার অচিরেই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে না- এমন পূর্বাভাসও দেওয়া হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীদের শঙ্কা তাদের বৈধভাবে অবস্থানের অধিকার বাতিল করা হবে এবং ভবিষ্যতে খুব কম সংখ্যকই উপসাগরীয় দেশগুলোয়ে চাকরির সুযোগ পাবেন।
মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রবাসী আয় আগামীদিনে কমার আরও বেশকিছু কারণ আছে। কর্মস্থলে হয়রানি, শোষণ, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের পরিবেশ, রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর প্রতারণার ঘটনা জনমানসে নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ সৃষ্টি করে। উদয়াস্ত পরিশ্রমের পরিবেশে ইচ্ছে করেই পুরুষ কর্মীদের নিয়োগ দেওয়া এবং নারীদের নামমাত্র মজুরির বিনিময়ে গৃহস্থালি কাজে নিয়োজিত করার জন্য রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো বিশ্বাসযোগ্যতাও হারিয়েছে।
এসব কিছু মিলিয়েই মধ্যপ্রাচ্যের উপর আগামীদিনে প্রবাসী আয় উৎস হিসেবে নির্ভর করাটা কঠিন হবে। ফলে অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের দীর্ঘদিনের পরামর্শ, বিকল্প কর্মসংস্থান বাজারের সন্ধান করাটা এখন আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতি বাংলাদেশকে সেদিকেই ঠেলে দিতে পারে।
জাপানে সম্ভাবনাময় শ্রম বাজার:
এ অবস্থায় জাপান হতে পারে দেশের শিক্ষিত তরুণ সমাজের জন্য নিরাপদ এবং নিশ্চিত কর্মসংস্থানের উৎস।
যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের পরই বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ অর্থনীতি জাপান। কিন্তু, দেশটিতে বাংলাদেশিরা অভিবাসন সুযোগ পেয়েছেন খুবই কম।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো'র (বিএমইটি) দেওয়া তথ্যানুসারে, ১৯৭৬ থেকে চলতি ২০২০ সাল নাগাদ মোট এক কোটি ৩০ লাখ বাংলাদেশি প্রবাসে কাজের সন্ধানে যান। এদের মধ্যে মাত্র শূন্য দশমিক দুই শতাংশ (০.০২) জাপানে যাওয়ার সুযোগ পান।
এদের মধ্যে আবার সরকারি ব্যুরোটির প্রশিক্ষণ নিয়ে জাপানে গিয়েছেন মাত্র দুই হাজার জন। তবে বিএমইটি'র সহকারী পরিচালক মো. মশিউর রহমান খান বলেন, অতীতে শিক্ষার্থী ভিসায় অনেকেই জাপানে গিয়েছেন। পড়াশোনা শেষে তাদের অনেকেই দেশটির শ্রম বাজারে যোগ দিয়েছেন।
বাংলাদেশিদের সংখ্যা কম হলেও জাপান থেকে আসা প্রবাসী আয়ের (রেমিটেন্স) তথ্য আশা জাগায়। দেশের প্রবাসী আয়ের শীর্ষ ৩০ দেশের মধ্যে জাপান রয়েছে ২০ তম স্থানে। গত ৩০ জুনে সমাপ্ত অর্থবছরে দূরপ্রাচ্যের দেশটি থেকে আসা ৪ কোটি ৪৪ লাখ ৪০ হাজার ডলার বিদেশি মুদ্রা প্রবাহ যোগ হয় দেশের অর্থনীতিতে। আগামীতে এ আয় বহুগুণে বাড়ানোর সুযোগও আছে।
বয়স্ক জনগোষ্ঠীর ভারাক্রান্ত জাপান এখন বাধ্য হয়েই বিদেশি কর্মীদের জন্য নিজেদের দুয়ার খুলেছে। ২০১৭ সালে একটি আইনি সংস্কারও করে দেশটি। যার আওতায়; বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে তাদের মোট কর্মীর সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ বিদেশি উৎস থেকে নিয়োগ দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। ইতোপূর্বে, যা মাত্র ৫ শতাংশ ছিল।
মশিউর রহমান জানান, একইসঙ্গে জাপান বিদেশি কর্মীদের চাকরির মেয়াদ নুন্যতম তিন বছর থেকে পাঁচ বছরে উন্নীত করেছে। দেশে ফেরার পর, তারা জাপানে প্রতিবছর কাজ করার জন্য ২ লাখ ইয়েন বা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা বেতন পাবেন।
বিএমইটি ইতোমধ্যেই ২০১৭ সালের মার্চে জাপানের কর্মী নিয়োগদাতা সংস্থা- আইএম এর সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছে। এর আওতায় আইএম বাংলাদেশ থেকে ৩০ বছরের কম বয়সী তরুণদের বেতনভুক্ত শিক্ষানবিশ কার্যক্রমের আওতায় নিয়োগ দেবে।
ওই চুক্তির আলোকেই গাজিপুরের কাপাসিয়া এলাকা নিবাসী ৫৫০ জন তরুণ উচ্চ-মাধ্যমিক পাস নারী-পুরুষকে কারিগরি এবং ভাষাগত শিক্ষা দেওয়া হয়। তাদের মধ্যেই একজন ছিলেন- ইস্থিনা হিমি।
চাকরিতে নিয়োগের পূর্বে প্রশিক্ষণ গ্রহণকারীদের আবারও পরীক্ষা নেওয়া হয়। এরপর তাদের মধ্যে ১৫০ জন কোভিড-১৯ মহামারির আগেই বাংলাদেশ থেকে জাপানে গিয়ে কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার সুযোগ পান। পরবর্তীতে, অবশ্য মহামারির কারণে বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় প্রশিক্ষিত বাকি চারশ' জনের যাওয়াটা স্থগিত হয়ে পড়ে।
বিএমইটি কর্মকর্তারা জানান, মহামারির মধ্যেও আইএম জাপানের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চলমান ছিল। জাপানের সঙ্গে ফ্লাইট চলাচল স্বাভাবিক হওয়া মাত্রই নির্বাচিত প্রার্থীরা সেখানে গিয়ে কাজের সুযোগ পাবেন।
গোলাম কিবরিয়া ভূঁইয়া নামের একজন জাপানি ভাষা শিক্ষক জানান, তিনি মহামারির মধ্যে জুম এবং সামাজিক গণমাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমে ভাষা শিক্ষার কাজ চালিয়ে গেছেন।
তিনি বলেন, ''প্রান্তিক অঞ্চলে বসবাসকারী অনেক শিক্ষার্থীর জন্য অনলাইন ক্লাসে যোগ দেওয়া কঠিন ছিল। কিন্তু, তারপরও তারা যথাসম্ভব যোগ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। আসলে মানসম্মত কাজের সুযোগ এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই তারা এ প্রশিক্ষণের ব্যাপারে আশাবাদী।''
বিএমইটি এবং আইএম এর মাধ্যমে ইতোমধ্যেই যারা জাপানে গেছেন; তারা ভালোই আছেন বলে জানা গেছে। মহামারির মধ্যেও তাদের নিয়োগদাতারা সময়মতো বেতন দিচ্ছেন, বলে জানান নরসিংদী থেকে যাওয়া একজন কর্মী। তবে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার স্বার্থে তিনি নাম না প্রকাশের অনুরোধ করেন।
বিএমইটি'র শিক্ষানবিশ পঞ্চম ব্যাচের আওতায় তিনি জাপান যান। ওই ব্যাচে মোট ছিলেন ৪৪ জন। তিনি এখন আছেন জাপানের রাজধানী টোকিও থেকে ৪৫০ কিলোমিটার দূরের কিয়েটো নগরীতে। এখানকার কর্মস্থলের পরিবেশ নিয়ে তার ব্যাচমেটরা তাকে আগেই আশ্বস্ত করেছিলেন।
আইএম'র প্রশিক্ষণের সকল শর্ত পুরণ করা পর নরসিংদীর এ কর্মী এখন জাপানি ঐতিহ্যের জন্য পরিচিত শহরটির একটি অবকাঠামো নির্মাণ কোম্পানিতে কারগরি শিক্ষানবিশ যোগ দেওয়ার অপেক্ষা করছেন।
জাপানে আসার পর দেশটির সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করতে অভিবাসী কর্মীদের আরো একমাস প্রশিক্ষণ নিতে হয়। করা হয় স্বাস্থ্য পরীক্ষাও। সব পরীক্ষায় ইতিবাচক ফলাফল মিললে, তারা কাজ করতে করতেই আরো শেখার সুযোগ পান। নির্দিষ্ট সময় পরপর তাদের অর্জিত দক্ষতার পরীক্ষাও নেওয়া হয়।
শিক্ষানবিশ প্রবাসী কর্মীদের নানা মেয়াদে নেওয়া এসব প্রশিক্ষণের সফলতা অর্জনের ফলাফল মূল্যায়ন করেই তাদের কাজের মেয়াদ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
একইসঙ্গে, অর্থ উপার্জন এবং কাজ শেখার মতো এ সুযোগকে নিজের জন্য খুবই ভালো বলে মনে করেন হিমি।
''আমি যদি সেখানে (জাপানে শিক্ষানবিস সেবিকা হিসেবে) পাঁচ বছর কাজ করতে পারি, তাহলে একটি মূল্যায়ন সনদও পাব। যা আমাকে বাংলাদেশ বা অন্য কোনো দেশে ভালো একটি চাকরি পেতে সহায়তা করবে'' বলেন তিনি।
শুধুমাত্র উচ্চ-মাধ্যমিক পাস হিমির জন্য বাংলাদেশে ভালো চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
টেলিফোনে দেওয়া সাক্ষাৎকারের কথাবার্তায় তাকে খুবই আত্মবিশ্বাসী শোনায়। হিমি বর্তমানের অনিশ্চয়তা আর অন্ধকার থেকে বেড়িয়ে আসার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
জীবনযুদ্ধের ফেরে যখন শিক্ষার চাইতে অর্থের সঙ্কট প্রকট হয়ে ওঠে, তখন নিজ এলাকায় লাইফবয় সাবানসহ অন্যান্য ভোক্তা পণ্যের বিজ্ঞাপনী সংস্থার হয়ে কাজ করেছেন হিমি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাচ্চাদেরও পড়িয়েছেন।
হিমি এখন নিজের জাপানি ভাষার দক্ষতা এন-২ লেভেলে উন্নীত করার জন্য পড়াশোনা করছেন। জাপানি ভাষার দক্ষ হওয়ার জন্য এন-৫ থেকে এন-১ পর্যন্ত ধারাবাহিক স্তর হয়েছে। তবে জাপানে সেবিকা হওয়ার জন্য এন-৪ পর্যন্ত দক্ষতা থাকাই যথেষ্ট।
তবে যে সময়টা দেশে বসে আছেন- তা ভাষা শিক্ষার দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমেই পার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এ তরুণী।
এব্যাপারে হিমির মন্তব্য, ''আমি যদি সবগুলো লেভেল শেষ করি, তাহলে কাজেও ভালো করতে পারব। আর সামনের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলাতেও অনেক বেশি প্রস্তুতিও থাকবে আমার।''
- মূল লেখা: Japan opens doors to migrant workers. Can Bangladeshis seize the opportunity?
- অনুবাদ: নূর মাজিদ