সরকারি প্রতিষ্ঠানের ৭৫৫ মিলিয়ন ডলার আমদানি দায় বকেয়ার চাপে সোনালী ব্যাংক
ক্রমাগত ডলার সংকটের মাঝে ঋণপত্র (এলসি) প্রক্রিয়াকরণে, বিশেষ করে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আমদানি করা পণ্যের দায় মেটানোর ক্ষেত্রে হিমশিম খাচ্ছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংক। ১১ জুন পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যাংকের কাছে সোনালী ব্যাংকের বকেয়া আমদানি দায় দাঁড়িয়েছে ৭৫৫ মিলিয়ন ডলারে।
এ বিষয়ে গত ১১ জুন বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের পরিচালক একেএম কামরুজ্জামানকে চিঠি দেন সোনালী ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুভাষ চন্দ্র দাস।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর হাতে আসা ওই চিঠিতে ৭২টি আমদানি এলসির বকেয়া নিষ্পত্তি করতে প্রয়োজনীয় ডলার সরবরাহের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জরুরি সহায়তার অনুরোধ করা হয়েছে।
১৩ জুন ফোনে যোগাযোগ করা হলে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম টিবিএসকে বলেন, 'সরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য বেশিরভাগ আমদানি এলসি সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে খোলা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক এ জন্য ডলার সহায়তা দিলেও সরবরাহ সবসময় সমান পাওয়া যায় না।'
'তবুও সোনালী ব্যাংক নিজস্ব ব্যবস্থায় আমদানি দায় পরিশোধের চেষ্টা করে যাচ্ছে। যদিও শতভাগ অর্থ পরিশোধ সবসময় সম্ভব হচ্ছে না,' তিনি আরও বলেন।
সোনালী ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রয়োজনীয় ডলার সরবরাহ করেনি। এর ফলে বিদেশি ব্যাংকের কাছে দেনা বেড়েছে, আন্তর্জাতিক লেনদেনে সোনালী ব্যাংকের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। পাশাপাশি সম্ভাব্য জরিমানা ও বিলম্বে পরিশোধের মাশুল নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
তিনি বলেন, জরিমানা এবং বিলম্বে পরিশোধের চার্জ এড়াতে বিদেশি ব্যাংকগুলো সুইফট বা ইমেলের মাধ্যমে দ্রুত বকেয়া নিষ্পত্তির জন্য সোনালী ব্যাংককে তাগিদ দিচ্ছে।
সাধারণত দুধরনের এলসি খোলা হয়: সাইট এলসি এবং ডেফার্ড এলসি। সাইট এলসির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র ঠিক থাকলে বিলপ্রাপ্তির তারিখ থেকে পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে বিলের মূল্য পরিশোধ করতে হয়। এ পাঁচদিনের মধ্যে পরিশোধে ব্যর্থতায় বিল ওভারডিউ হয়ে যায়।
আর ডেফার্ড বা বিলম্বিত এলসির চুক্তি অনুযায়ী নথিপত্র পাওয়ার ৯০, ১৮০ বা সর্বোচ্চ ৩৬০ দিন পরে বিল পরিশোধ করা হবে মর্মে সুইফট মারফত অ্যাক্সেপটেন্স প্রদান করা হয় বিদেশি ব্যাংককে। চুক্তির সময়ের মধ্যে বিল পরিশোধ করতে না পারলে তা ওভারডিউ হয়ে যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ করে। বিশেষ করে জ্বালানি তেল, খাদ্য, সার এবং বিদ্যুতের মতো প্রয়োজনীয় পণ্যের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার সরবরাহ করা হয়। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ব্যবস্থা নেই, তাই বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার ব্যবহার করে আমদানির অনুমতি দেয়।
সোনালী ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণের চেষ্টায় জরুরি আমদানির জন্যও ডলার সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে।
গত জানুয়ারি পর্যন্ত দৈনিক ৪০ থেকে ৫০ মিলিয়ন ডলার পাওয়া গেলেও বর্তমানে তা নেমে এসেছে ১০–২০ মিলিয়ন ডলারে। গত মাসে সোনালী ব্যাংকের বকেয়া আমদানি বিলের পরিমাণ প্রায় ৯০০ মিলিয়ন ডলার হয়েছিল বলে জানান তিনি।
সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আমদানির জন্য ডলার সরবরাহ পরিস্থিতি সম্পর্কে টিবিএস জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক হোয়াটসঅ্যাপ বার্তার মাধ্যমে লিখিত আকারে জিজ্ঞাসা পাঠানোর পরামর্শ দেন। সে অনুযায়ী হোয়াটসঅ্যাপে তাকে প্রশ্ন লিখে পাঠালেও তার কাছ থেকে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, নতুন এলসি খোলার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার সোনালী ব্যাংককে মৌখিকভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন।
জুনের প্রথম সপ্তাহে গভর্নর সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিমকে কেবল নিজস্ব তহবিল থেকে বৈদেশিক দায় মেটাতে সক্ষম এমন আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের জন্য এলসি খুলতে বলেছিলেন।
পরবর্তীসময়ে একটি অনলাইন বৈঠকে আফজাল করিম তার ব্যাংকের বৈদেশিক লেনদেন পরিচালনাকারী সমস্ত অনুমোদিত ডিলার শাখার ব্যবস্থাপকদের গভর্নরের নির্দেশনা জানিয়ে দেন বলে সোনালী ব্যাংকের একজন শাখা ব্যবস্থাপক টিবিএসকে জানিয়েছেন।
তবে জানতে চাইলে আফজাল করিম টিবিএসকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এ ধরনের কোনো নির্দেশনা দেয়নি।
সোনালী ব্যাংক বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের খোলা ৭২টি এলসির দায় আংশিকভাবে নিষ্পত্তি করেছে।
যেসব প্রতিষ্ঠানের আমদানি দায় বকেয়া পড়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) এলসি সবচেয়ে বেশি।
এছাড়া বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল), পুলিশ সদর দপ্তর, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি), বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (বিপিডিবি), বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল), পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি বাংলাদেশ (পিজিসিবি), ন্যাশানাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি), খাদ্য অধিদপ্তর ও রূপপুর নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টের আমদানি দায়ের কিছু অংশ বকেয়া পড়েছে।
সোনালী ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার আয় প্রবাহও বিশেষ নয়। মে মাসে সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে ২৮.১৯ মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত ৫ জুন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের বিপিএম৬ পদ্ধতির হিসেবে দেশে ১৮.৬৭ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে। এর মধ্যে ব্যবহার করার মতো রিজার্ভ ১৩ বিলিয়ন ডলারের কম বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
সোনালী ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক চাহিদা অনুযায়ী ডলার সরবরাহ করছে না অনেক আগে থেকেই। যে কারণে সোনালী ব্যাংক এ অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে।
এপ্রিলে আইএমএফ বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ১৪.৭৫ বিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করে দেয়।