সহযোগিতার দীর্ঘ ইতিহাস রাশিয়া- উ. কোরিয়ার
দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে গতকাল বুধবার ভোররাতে উ. কোরিয়ায় আসেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। সেখানে তাঁর জন্য বর্ণাঢ্য ও উষ্ণ সংবর্ধনার আয়োজন করেন স্বাগতিক দেশের সর্বোচ্চ নেতা কিম জং উন। পুতিন ও কিম একটি বিস্তৃত কৌশলগত অংশীদারত্বের চুক্তি করেছেন। এই চুক্তির ভিত্তিতেই এখন থেকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন পুতিন।
কূটনীতির পোশাকি ভাষার আড়ালে এটি মূলত একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি। যার আওতায়, উভয় দেশের মধ্যে যে কেউ আক্রান্ত হলে– অন্য দেশ তাঁর প্রতিরক্ষায় এগিয়ে আসবে।
চুক্তিটিকে 'যুগান্তকারী' বর্ণনা করে পুতিন বলেন, এটি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে।
চুক্তির বিষয়ে রাশিয়া বা উ. কোরিয়া আরো বিস্তারিত জানায়নি, তবে একটি বিষয় স্পষ্ট কোরীয় উপদ্বীপে শক্তির ভারসাম্যে পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি হলো। উ. কোরিয়ার প্রতিরক্ষা শিল্প রাশিয়ার কাছে নানান ধরনের গোলাবারুদ, রকেট ইত্যাদি বিক্রি করে বিপুল অর্থ আয় করছে, এই অর্থ দিয়ে দেশটি নিজ সমরসজ্জাকে বাড়াবে দ. কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তিকে মোকাবিলায়। একইসঙ্গে মস্কোর থেকে উচ্চ প্রযুক্তির কারিগরি সহায়তা পাবে পিয়ংইয়ং।
ইউক্রেন যুদ্ধে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়া রুশ সামরিক শক্তি হয়তো আক্রান্ত হলে পিয়ংইয়ংয়ের পাশে এ মুহূর্তেই দাঁড়াতে পারবে না, তাই চুক্তির এই অংশটি আপাতত প্রতীকী। তবে পুতিন যেমন বলেছেন, ভবিষ্যতে চুক্তিটির মাধ্যমে দুই দেশের প্রতিরক্ষা সম্পর্ক পরস্পরের আত্মরক্ষায় কাজ করবে। ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া জয়ী হলে– তখন এই বাধা আর থাকবে না।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে আগ্রাসন চালায় রাশিয়া। এরপর থেকে পশ্চিমা বিশ্বের কাছে ক্রমেই মাথাব্যথা হয়ে উঠেছে পুতিনের সোভিয়েত সীমানা পুনরুদ্ধারের উচ্চাকাঙ্ক্ষা।
এশিয়ার প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তেমনিভাবে পশ্চিমা আধিপত্যের জন্য প্রথাগত হুমকি হলো উ. কোরিয়া। পিয়ংইয়ং পারমাণবিক ওয়ারহেড বহনকারী ক্ষেপণাস্ত্রের সমূহ উন্নতি করেছে এবং পাল্লা বাড়াচ্ছে। এরমধ্যেই দ. কোরিয়া ও জাপানে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলো এসব ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লার মধ্যে রয়েছে। সমাজতান্ত্রিক দেশটির দাবি, যুক্তরাষ্ট্রে হামলা চালানোর মতো ক্ষেপণাস্ত্র তাদের রয়েছে।
উ. কোরিয়ার শাসকগোষ্ঠী সুদীর্ঘ সময় ধরে পারমাণবিক সক্ষমতা বাড়াতে সচেষ্ট। এখন রাশিয়াও যদি তার উন্নত প্রযুক্তি দেয়– তাহলেই পাশার দান উল্টে যাবে। পুতিনের উ. কোরিয়া সফর তাই বুঝেশুনে নেওয়া এক সূক্ষ্ম চাল। ইউক্রেন সীমান্তে ট্যাক্টিক্যাল নিউক মোতায়েনের পাশাপাশি পুতিন যে দূরপ্রাচ্যেও যুক্তরাষ্ট্র ও তাঁর মিত্রদের ঘুম হারাম করতে পারেন– এটি তারই স্পষ্ট বার্তা।
বিনিময়ে রাশিয়া অন্যদিক থেকেও লাভবান হবে। পুতিন উ. কোরিয়া থেকে অপেক্ষাকৃত কম আধুনিক অস্ত্র বা গোলাবারুদ পেতে চান। এনিয়ে ২০২৩ সালেই রাশিয়ার ভ্লাদিভোস্তকে কিম জন উনের সাথে একটি চুক্তি করেন তিনি। এই চুক্তির আওতায়, এরমধ্যেই ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য রাশিয়া বিপুল গোলাবারুদ পেয়েছে বলে দাবি করেছে পশ্চিমারা।
ইউক্রেনের রণাঙ্গনে হাজার হাজার টন কামানের গোলা ও রকেট আর্টিলারির প্রয়োজন হচ্ছে। সেখানে উ. কোরিয়া থেকে পাওয়া সরবরাহ রাশিয়াকে দরকারমতো প্রচুর পরিমাণে গোলা ছোড়ার সুবিধা দিয়েছে।
অন্যদিকে বাইডেন প্রশাসন দ. কোরিয়ার সাথে সামরিক সম্পর্ক শক্তিশালী করেছে। উ. কোরিয়ার বিরুদ্ধে আরো অনমনীয় অবস্থান নিয়েছে। তাই রাশিয়ার সাথে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার মাধ্যমে এগুলোর প্রভাব খর্ব করতে চান কিম।
তাছাড়া, রুগ্ন অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে বিপুল জ্বালানি চাই উ. কোরিয়ার। দরকার খাদ্য সরবরাহ। এ দুটি জিনিসেরই বিপুল প্রাচুর্য আছে রাশিয়ায়। ফলে সামরিক সহযোগিতার বাইরে রাশিয়া থেকে অর্থনৈতিক সহায়তাও চান কিম।
তবে এটাই প্রথম রাশিয়া-উ. কোরিয়ার জোটবন্ধন নয়। বরং গুরুত্বপূর্ণ এই সম্পর্কের রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। কিম জং উনের দাদা- কিম ইল সাং (কিম যার পোশাকের অনুকরণ করেন) এর সাথে সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্টালিনও জোট বেঁধেছিলেন পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ মোকাবিলায়।
মিত্রতার ইতিহাস দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে
অবিভক্ত কোরিয়া জাপান সম্রাজ্য দখল করেছিল। এরপর চীনের মাঞ্চুরিয়াও দখল করে বসে। ১৯৩০'র দশকে অখ্যাত এক কম্যুনিস্ট নেতা হিসেবে মাঞ্চুরিয়ায় জাপানিদের বিরুদ্ধে ছোট্ট একটি গেরিলা যোদ্ধাদলকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন কিম ইল সং। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নে পালিয়ে আসেন এবং লালফৌজে যোগ দেন। সোভিয়েত সেনায় মেজর পর্যন্ত পদোন্নতি লাভ করেছিলেন তিনি।
১৯৪৫ সালের আগস্টে জাপান মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলে, দখলীকৃত কোরীয় উপদ্বীপকে তারা মিত্রশক্তির কাছে হস্তান্তর করে। মিত্রশক্তি কোরিয়াকে দুটি অঞ্চলে বিভক্ত করে। উত্তর অংশের দায়িত্বে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, আর দক্ষিণের দায়িত্ব পায় যুক্তরাষ্ট্র।
কোরিয়ার সমাজতান্ত্রিক দল– কোরিয়ান ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা হিসেবে কিম ইল সাংকে বেছে নিয়েছিলেন খোদ জোসেফ স্টালিন। এরপর ১৯৪৮ সালে উত্তর কোরিয়া রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর দেশটির সর্বোচ্চ নেতা হিসেবেও তাঁকেই মনোনয়ন দেন সোভিয়েত নেতা।
সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি কিম ইল সাংয়ের আনুগত্য ছিল প্রশ্নাতীত; এবং স্টালিনের শাসন কাঠামোর আদলে কোরীয় উপদ্বীপে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন বদ্ধপরিকর।
কিম ইল সাং মূলত ছিলেন একজন জাতীয়তাবাদী, কোরীয় উপদ্বীপকে তিনি ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন তাঁর স্বপ্নের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ছাতাতলে। কিন্তু, যুক্তরাষ্ট্র- নিয়ন্ত্রিত দক্ষিণে সমাজতন্ত্রের বিস্তার ঘটাতে চাইলে দরকার ছিল স্টালিনের সবুজ সংকেত ও সোভিয়েত অস্ত্র সহায়তার।
কিম ইল সাং অনেকবার এই সহায়তা চেয়ে স্টালিনের কাছে ধর্ণা দেন। তবে স্নায়ুযুদ্ধের শুরুর ওই সময়ে বেশ সাবধানী ও ধীরস্থির সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলেন স্টালিন। তাঁর আশঙ্কা ছিল, মিত্র দক্ষিণ কোরিয়া আক্রান্ত হলে যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে পাল্টা-আক্রমণ করতে পারে।
তবে পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন হয়, যখন ১৯৪৯ সনে চীনের সমাজতান্ত্রিক দল তাদের জাতীয়তাবাদী প্রতিপক্ষকে পরাজিত করে গণ প্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠা করে। চীনের জাতীয়তাবাদী নেতা চিয়াং কাই শেক ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তিগুলোর মিত্র। এই অবস্থায়, দক্ষিণ কোরিয়া আক্রান্ত হলে তাঁর প্রতিরক্ষায় এগিয়ে আসবে না বলে ১৯৫০ সনে ইঙ্গিতও দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
এরপর কিম ইল সাংয়ের অনুরোধে সায় দেন স্টালিন। তিনি ভেবেছিলেন, দ্রুতই দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে জয়ী হতে পারবেন কিম ইল সাং। নিজ সম্মতির কথা জানিয়ে তিনি একটি চিঠি দেন এবং টি-৩৪ ট্যাংকসহ দরকারি সব অস্ত্র সহায়তা পাঠান উ. কোরিয়ায়।
এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সোভিয়েত- উ. কোরিয়া সামরিক জোটের সূচনা হয়। দক্ষিণ কোরিয়ায় উত্তরের আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় কোরীয় যুদ্ধ। যা ছিল স্নায়ুযুদ্ধের শুরুর সময়ের সবচেয়ে গুরুতর সংকট। ১৯৫০ সনের ২৫ জুন উত্তর কোরিয়া এই আগ্রাসন চালায়, তবে তাতে দ্রুত জয়লাভে ব্যর্থ হয়। ওয়াশিংটন দ. কোরিয়াকে পরিত্যাগ করেনি, এবং জাতিসংঘের ম্যান্ডেটে ১৫ সদস্য দেশের বাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশ নেয়।
যুদ্ধের একপর্যায়ে উ. কোরিয়া যখন পরাজয়ের সম্মুখীন হয়- তখন তার পক্ষ হয়ে যুদ্ধে নামে সমাজতান্ত্রিক চীন। ফলে প্রথমবারের মতো বিশ্ব পৌঁছায় তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে। তবে বর্তমান ইউক্রেন যুদ্ধের মতোই খুব শিগগিরই এ যুদ্ধ এক অচলাবস্থায় পৌঁছায়। আরো দুই বছর যুদ্ধ চলার পরে একটি অস্ত্রবিরতির চুক্তি সই হয়, যা আজো কার্যকর রয়েছে।
পশ্চিমা দুনিয়া প্রত্যাশা করতেই পারে, রাশিয়া- উ. কোরিয়ার নতুন জোটবন্ধন থেকে এবার কোরীয় যুদ্ধের মতো ধ্বংসাত্মক কোনো সংঘাতের সূচনা হবে না। কিন্তু, তাদের বুঝতে হবে এই সম্পর্কের বুনিয়াদ সুদীর্ঘ কালের। এর শেকড় রয়েছে আরেক রক্তক্ষয়ী সংঘাতের যুগে– যখন মস্কো ও পিয়ংইয়ংয়ের নেতারা সমূহ বিপদ অনুমান করে বিপজ্জনক পদক্ষেপ নিতেও দ্বিধা করেননি।
লেখক: রবার্ট বার্নেস যুক্তরাজ্যের ইয়র্ক সেন্ট জন ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক। এই নিবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয় দ্য কনভারসেশনে। এশিয়া টাইমসে প্রকাশিত লেখাটি তারই পরিমার্জিত সংস্করণ।
ভাবানূবাদ: নূর মাজিদ