জার্মানির নাগরিকত্ব পেতে ইসরায়েলের অস্তিত্বের অধিকার মেনে নিতে হবে
জার্মানির নতুন সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী, নতুন করে জার্মান নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করা ব্যক্তিদের ইসরায়েলের অস্তিত্বের অধিকার মেনে নিতে হবে।
ক্রমবর্ধমান ইহুদি বিদ্বেষ, ডানপন্থীদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি এবং ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ নিয়ে জার্মানির বিষয়ে অবস্থান নিয়ে চলমান বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে বৃহত্তর সংস্কারের অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) নতুন নাগরিকত্ব আইন কার্যকর করেছে দেশটি৷
জার্মান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, জার্মানিতে নাগরিকত্ব পেতে যে স্বাভাবিককরণ পরীক্ষা দিতে হয় তাতে এখন থেকে ইহুদিবাদ, ইসরায়েলের অস্তিত্বের অধিকার এবং জার্মানিতে ইহুদি জীবন সম্বন্ধে অতিরিক্ত প্রশ্ন অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
গাজার সংঘাত এবং ইসরায়েলের প্রতি বার্লিনের কট্টর সমর্থন জার্মানিতে তাৎপর্যপূর্ণ বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ৭ অক্টোবরের হামলার পর, চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ এবং অন্যান্য আইনপ্রণেতারা জোর দিয়ে বলেছিলেন, ইসরায়েলের নিরাপত্তা জার্মানির জন্য একটি মৌলিক জাতীয় স্বার্থ।
তবে ফিলিস্তিনকে সমর্থন দেয়া বিভিন্ন জার্মান গোষ্ঠী মনে করে, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন ফিলিস্তিনিপন্থীদের জন্য বাক ও সমাবেশের স্বাধীনতা সীমিত করবে। জার্মানিতে ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সব থেকে বেশি ফিলিস্তিন প্রবাসী থাকেন, যাদের সংখ্যা প্রায় ৩ লাখের কাছাকাছি।
জার্মানিতে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনে কী থাকছে অভিবাসীদের জন্য?
জার্মান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মূলত পাঁচটি বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে সংস্কার করা হয়েছে আইনটি৷ এগুলোর মধ্যে আছে: নাগরিকত্ব অর্জনের প্রক্রিয়া গতিশীল করা, দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগ রাখা, অভিবাসীদের বিশেষ যোগ্যতাকে স্বীকৃতি দেয়া। জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব সহজ করা এবং 'অতিথি কর্মীদের' প্রজন্মকে আজীবন সম্মাননা দেয়া।
আইনটি কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জার্মানিতে বসবাসরত বিদেশিরা আট বছরের পরিবর্তে পাঁচ বছর পরই নাগরিকত্ব চেয়ে আবেদন করতে পারবেন৷ জার্মান নাগরিকের সঙ্গে কারো বিয়ে হলে, চার বছর পরই তিনি নাগরিকত্ব চেয়ে আবেদনের সুযোগ পাবেন৷
আবেদনকারীদের মধ্যে যারা জার্মান সমাজে মানিয়ে নেয়ার (ইন্টিগ্রেশন) ক্ষেত্রে 'বিশেষ সাফল্য' দেখাতে পারবেন, তারা তিন বছর পরই নাগরিকত্ব চাইতে পারবেন৷ বিশেষ সাফল্যের মধ্যে রয়েছে: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভালো ফল করা, কর্মক্ষেত্রে নিজেকে প্রমাণ করা, ভাষাগত দক্ষতা এবং স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজে পারদর্শিতা৷
জার্মানির পাসপোর্ট পেতে বা নাগরিক হতে হলে আগের মতো নিজ দেশের নাগরিকত্ব ছাড়তে হবে না কোনো বিদেশিকে৷ জার্মান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, জার্মানির নাগরিকত্ব অর্জনের সময় কোনো শর্ত পূরণ ছাড়াই আবেদনকারী তার আগের নাগরিকত্ব ধরে রাখতে পারবেন৷ তবে আবেদনকারীর নিজ দেশ দ্বৈত নাগরিকত্ব রাখার সুযোগ দেয় কিনা বা এ বিষয়ে জার্মান সরকারের সঙ্গে অন্য কোনো দেশের কোনো চুক্তি আছে কিনা বিষয়টি তার ওপরও নির্ভর করবে৷
আইনি এই সংস্কার নবজাতকদের বিশেষ সুবিধা দেবে৷ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ভবিষ্যতে জার্মানিতে বিদেশি পিতামাতার ঘরে জন্ম নেয়া শিশু 'নিঃশর্তভাবে জার্মান নাগরিকত্ব পাবে৷' এমনকি জার্মান বংশোদ্ভূত শিশুরাও এখন তাদের পিতামাতার নাগরিকত্ব ধরে রাখতে পারে, যদি তাদের মধ্যে একজন নিয়মিতভাবে অন্তত (আট বছর থেকে কমিয়ে) পাঁচ বছর জার্মানিতে বাস করেন৷
অতিথি কর্মী প্রজন্মের সদস্যরা ভাষাগত দক্ষতার প্রমাণ দিতে পারলেই জার্মান নাগরিকত্ব পাবেন৷ জার্মান ন্যাচারালাইজেশন প্রক্রিয়ার পরীক্ষা দেয়ারও প্রয়োজন হবে না তাদের৷ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তাদের প্রমাণ করতে হবে যে তারা ''নিত্যদিনের জীবনে জার্মান ভাষায় কথা বলতে পারেন৷'',
১৯৫০-এর দশকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে জার্মানিকে পুনর্গঠনে সহায়তা দিতে অনেক তুর্কি নাগরিক আসেন জার্মানিতে৷ তাদেরকে জার্মান ভাষায় 'গাস্টআরবাইটার' বা 'অতিথি কর্মী' বলা হয়৷ এতদিন তাদের কেউ জার্মান নাগরিক হতে চাইলে ছাড়তে হতো তুরস্কের নাগরিকত্ব৷
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, জার্মান নাগরিকত্বের জন্য আবেদনকারী কোনো বিদেশির অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার রেকর্ড থাকতে পারবে না৷ তবে ছোটখাটো অপরাধ আমলে নেবে না কর্তৃপক্ষ৷ কোনো অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় কেউ যদি সর্বোচ্চ ৯০ দিনের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে থাকেন, তবে সাজাভোগের পর তিনি বা তারা নাগরিকত্ব চেয়ে আবেদনের যোগ্য হবে ন৷
তবে একটি ব্যতিক্রম থাকছে৷ যদি একজন অভিবাসী 'ইহুদিবিদ্বেষী, বর্ণবাদী বা অন্যান্য অমানবিক কাজের' জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়, সাজার মেয়াদ যা-ই হোক না কেন, তাকে আর নাগরিকত্ব দেয়া হবে না৷
নাগরিকত্ব পেতে হলে বিদেশিদের অবশ্যই নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের ভরণ-পোষণের সামর্থ্য থাকতে হবে৷ কারণ, জার্মান সোশ্যাল কোডের দ্বিতীয় ও দ্বাদশ ধারা (এসজি টু ও টুয়েলভ) অনুযায়ী, তাদের সরকারি কল্যাণ ভাতায় যুক্ত করা হবে না৷
আশ্রয়প্রার্থীদের মধ্যে যাদের আশ্রয় আবেদন বাতিল হয়েছে, কিন্তু নিরাপত্তার কারণে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তারা নাগরিকত্ব পাওয়ার যোগ্য হবেন না৷