২০২৪ অর্থবছরে রেকর্ড জনশক্তি রপ্তানি, সামনেও অব্যাহত থাকবে?
গেলো জুনে গত ৩৩ মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম জনশক্তি রপ্তানি হওয়া সত্ত্বেও, সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে রেকর্ড ১১.৯৬ লাখ শ্রমিক বিদেশে পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যমতে, আগের অর্থবছর ২০২৩ সালে ১১.৩৭ লাখ জনশক্তি রপ্তানির রেকর্ড ছিল বাংলাদেশের।
২০২৪ অর্থবছরে প্রায় ৪৪ শতাংশ অভিবাসী কর্মীর গন্তব্য ছিল সৌদি আরব এবং ২২ শতাংশেরও বেশি গিয়েছে মালয়েশিয়ায়। চার বছরের স্থগিতাদেশের পরে ২০২২ সালের আগস্টে বাংলাদেশের জন্য শ্রমবাজার পুনরায় খুলে দেয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটি।
জনশক্তি রপ্তানি বৃদ্ধির বিষয়টি ২০২৪ অর্থবছরের রেমিট্যান্স প্রবাহতেও প্রতিফলিত হয়েছে। অর্থবছরের শেষদিন ৩০ জুন তারিখের হিসাব অনুযায়ী, দেশে অভ্যন্তরীণ রেমিট্যান্স প্রবাহ ১০.৬৬ শতাংশ বেড়ে প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
তবে, সম্প্রতি বাংলাদেশি শ্রমিকদের বড় তিন গন্তব্য— মালয়েশিয়া, ওমান এবং মালদ্বীপ— স্বল্পদক্ষ কর্মী নিয়োগ বন্ধ করে দেওয়ায় ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন শ্রম রপ্তানিকারকরা।
কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই বাজারগুলো পুনরায় চালু এবং নতুন শ্রমবাজার খুঁজতে সরকারকে সক্রিয় ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
নিয়োগকারী সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগে মালয়েশিয়া ইতোমধ্যেই গত ১ জুন থেকে বাংলাদেশিদের জন্য শ্রমবাজার বন্ধ ঘোষণা করেছে।
বাংলাদেশের ১০০টি বেসরকারি এবং একটি সরকারি রিক্রুটিং এজেন্সিকে কর্মী পাঠানোর অনুমতি দিয়েছিল মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষ।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিস (বায়রা) এর যুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "১০০টি রিক্রুটিং এজেন্সির সিন্ডিকেটের কারণেই মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে গেছে। এখন আবার সংযুক্ত আরব আমিরাত, লিবিয়াসহ কয়েকটি দেশের শ্রমবাজারকে সিন্ডিকেটের দখলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে।"
তিনি বলেন, "সিন্ডিকেটের রাহুমুক্ত করে বন্ধ শ্রমবাজারগুলো খুলতে না পারলে জনশক্তি রপ্তানি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আগামী ১২ তারিখে মালয়েশিয়ার সাথে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে বাংলাদেশ যাতে সব বৈধ এজেন্সির জন্য কর্মী পাঠানোর দাবি জানায়, সে আহ্বান আমরা ইতোমধ্যে রেখেছি।"
২০২২ সালের আগস্টে শ্রমবাজার পুনরায় খোলার পর বাংলাদেশ থেকে ৫ লাখের বেশি শ্রমিক নিতে চেয়েছিল মালিয়েশিয়া; যদিও নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ৪.৯৪ লাখ শ্রমিক সেদেশে পাড়ি দিতে পেরেছেন।
নির্ধারিত সময় ৩১ মে'র আগে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো টিকিটের ব্যবস্থা করতে না পারায় প্রায় ১৭,০০০ কর্মী মালয়েশিয়া যেতে পারেন নি। এই প্রেক্ষাপটে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ তদন্ত করে দায়ী সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।
গত অর্থবছরে সৌদি আরবের পরে বাংলাদেশ থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক কর্মী নিয়োগ দিয়েছে মালয়েশিয়া। মূলত উৎপাদন, নির্মাণ এবং পরিষেবা খাতে এসব কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
তবে, উভয় দেশ থেকেই শ্রমিকদের অভিযোগ— বাংলাদেশ ছাড়ার আগে যে চাকরির প্রতিশ্রুতি তাদের দেওয়া হয়েছিল, তা সেদেশে গিয়ে পাননি তারা।
বাংলাদেশি শ্রমিকদের সবচেয়ে বড় গন্তব্য সৌদি আরবে গত অর্থবছরে ৫ লাখ ২৫ হাজার কর্মী নিয়োগ পেয়েছে।
তবে জুনে এই দেশেও কর্মী নিয়োগের সংখ্যা নেমে এসেছে মাত্র ৩০ হাজারে। কারণ হলো— রিয়াদে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের সত্যায়ন ছাড়া সৌদি আরব যেতে ইচ্ছুক কর্মীদের বহির্গমন ছাড়পত্র দুই সপ্তাহ ইস্যু করেনি জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)।
সৌদি আরবে বাংলাদেশি শ্রমিকরা যাতে তাদের প্রতিশ্রুত চাকরি পাওয়া থেকে বঞ্চিত না হন, সেজন্যই এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
যদিও বায়রা নেতা ফখরুল ইসলামের মতে, এসব পদক্ষেপ সৌদি আরবে বাংলাদেশের শ্রমিক নিয়োগে প্রভাব ফেলেছে।
তিনি বলেন, "যদিও বিএমইটি নিয়ম শিথিল করেছে, তবে এখন ক্লিয়ারেন্স কার্ড (বহির্গমন ছাড়পত্র) ইস্যু করার আগে চাহিদাপত্র এবং চাকরি চুক্তিপত্র দেখাতে হবে।"
বায়রা বলছে, বেকারত্বের পাশাপাশি, বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়োগে আরেকটি বিপত্তি হলো কর্মীদের স্বল্পদক্ষতা।
সৌদি আরব মূলত নির্মাণ শ্রমিক, পরিচ্ছন্নতাকর্মী এবং গৃহকর্মী নিয়োগ করে থাকে। এছাড়া রাজমিস্ত্রি, ছুতার, ওয়েল্ডার, প্লাম্বার এবং ড্রাইভারের মতো আধা-দক্ষ পদেও চাহিদা রয়েছে।
এদিকে, গেলো বছর বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগে তৃতীয় স্থানে আছে সংযুক্ত আরব আমিরাত; এরপরে রয়েছে— কাতার, সিঙ্গাপুর, ওমান এবং কুয়েত।
বাংলাদেশি নিয়োগকারীদের মতে, মধ্যপ্রাচ্যের এই গন্তব্যগুলো সম্প্রতি স্বল্পদক্ষ কর্মী নেওয়া কমিয়ে দিয়েছে– যা দেশের বিদেশি কর্মসংস্থানের ভবিষ্যতের ক্ষেত্রে বড় উদ্বেগের বিষয়।
বর্তমানে সংযুক্ত আরব আমিরাতের কিছু সরকারি ও আধা-সরকারি কোম্পানি বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ দিচ্ছে। যেমন— রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা দুবাই ট্যাক্সি কর্পোরেশন বছরে ২,০০০ ট্যাক্সি ড্রাইভার এবং মোটরসাইকেল চালক নিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
এদিকে, ওমান সম্প্রতি দক্ষ শ্রমিকদের জন্য ভিসা স্থগিতাদেশ শিথিল করেছে; তবে স্বল্পদক্ষ কর্মীদের বিষয়টি এখনও বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। গত সেপ্টেম্বর থেকে দেশটিতে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়েছিল।
বায়রার সাবেক মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান টিবিএসকে বলেন, "পর পর তিন বছর আমরা প্রায় ১০ লাখের উপরে কর্মী পাঠাচ্ছি। কিন্তু বাস্তব কারণেই সবদেশ সব সময় সমানভাবে কর্মী নেবে না। একবারে অনেক লোক পাঠিয়েছি এজন্য আত্মতৃপ্তিতে না ভুগে এই ধারা ধরে রাখার চেষ্টা করতে হবে।"
ইউরোপ-অস্ট্রেলিয়ার শ্রমবাজারে দিকে আরও নজর দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, "ক্রোয়েশিয়া, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, পর্তুগালের মতো দেশগুলো কিছু কিছু লোক নিচ্ছে। তারা যেহেতু দক্ষ কর্মী চায়, সেজন্য তাদের চাহিদা অনুযায়ী কর্মী তৈরি করে পাঠাতে হবে।"