মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষা! কক্সবাজার সৈকতে কোত্থেকে আসে এই বেওয়ারিশ ঘোড়া!
বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত শহর কক্সবাজারের রাস্তা, ময়লার স্তূপ বা সৈকতের কাছাকাছি এলাকায় বিভিন্ন সময় দেখা মেলে মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ানো ঘোড়ার। আবার মধ্যরাতে রাস্তার পাশেই এসব ঘোড়ার শুয়ে থাকা দৃশ্যও চোখে পড়ে। প্রথম দেখায় এসব ঘোড়াকে ভবঘুরে বা মালিকবিহীন ঘোড়া মনে হতে পারে।
সৈকতে নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে কোনো ঘোড়া। অসহায়, স্থবির। যেন স্থবির কোনো ভাস্কর্য। তবে সব ছাপিয়ে চোখে পড়বে একাকী দাঁড়িয়ে থাকা ঘোড়ার অসহায়ত্ব। রোগা, পাঁজরের হাড় বেরিয়ে আসা ঘোড়া যেন অন্তিম মুহূর্তের জন্য দিন গুনছে।
কোত্থেকে এসেছে এ ঘোড়া? এসব ঘোড়া মূলত কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে আসা পর্যটকের বিনোদনে ব্যবহার হতো। সৈকতে আসা পর্যটকদের অনেকেই এসব ঘোড়ার পিঠে চড়েন, ছবি তোলেন। এজন্য ঘোড়ার মালিককে টাকা দিতে হয়। আর এটাই ঘোড়ার মালিকের আয়-রোজগারের পথ। তারাই ঘোড়াগুলোর দেখভাল করেন।
যদি তাই হয়, তাহলে সৈকতে ঘুরে বেড়ানো এসব ঘোড়া কি মালিকহীন? বেওয়ারিশ? এরকম অসহায়ভাবে তারা সৈকতের পাশে দাঁড়িয়ে কেন?
কারণ, এই দৃশ্য শুধু বছরের একটা সময়েই চোখে পড়ে। যখন কক্সবাজার সৈকতে পর্যটক কম আসেন বা পর্যটক থাকেন না, টুরিস্ট সিজন শেষ হয়ে যায়, তখন মালিকরা ঘোড়াগুলো ছেড়ে দেন মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ানোর জন্য। তখন এই ঘোড়া হয় রাস্তায় এদিক-সেদিক ঘোরাফেরা করে কিংবা সৈকতে হেঁটে বেড়ায় কিংবা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।
এখন কক্সবাজারে মন্দার সময় চলছে। টুরিস্ট সিজন না। ফলে সৈকতে দেখা মিলছে এসব নিঃসঙ্গ ঘোড়ার। তাদের অসহায় অবস্থা দেখে অনেকেরই মন খারাপ হচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে এসব ঘোড়া দেখে মনে হবে না ভরা টুরিস্ট মৌসুমে তাদেরই পিঠে পর্যটক সওয়ারি হয়ে কিংবা অশ্বারূঢ় কাউকে নিয়ে ছবির পোজ দেয়।
গত তিন দিন সৈকতে ঘুরে মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার কক্সবাজার শহরের কলাতলী হোটেল-মোটেল এলাকা, সৈকতের ঝাউবাগান সহ রাস্তায় এসব ঘোড়ার দেখা পাওয়া গেছে। হয় দাঁড়িয়ে ঝিমুচ্ছে, নয়তো রাস্তার পাশে ঘাসের মধ্যে মুখ গুঁজে আছে।
সৈকতের বিনোদনের জন্য ব্যবহৃত এসব ঘোড়ার মালিক সমিতিও রয়েছে। তাদের একজন নুরুল আলম। তাকে এসব ঘোড়ার করুণ অবস্থা আর অসহায়ভাবে বেওয়ারিশ প্রাণীর মতো ঘুরে বেড়ানোর বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে জানান: বছরে এই সময়টায় এসব ঘোড়া কিছু সময়ের জন্য ছেড়ে রাখতে হয়। সৈকতে বা ঘরে বেঁধে রাখার কারণে ঘোড়া বিরূপ আচরণ করে। এ সময়ে কাজ থাকে না। অলস ঘোড়া তাই ছেড়ে রাখা হয় ঘুরে বেড়ানোর জন্য, যেহেতু ভরা মৌসুমে ঘোড়া সব সময় ছেড়ে দেওয়া সম্ভব হয় না। পর্যটকরা আসা শুরু করলে ঘোড়াও ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ব্যবসার জন্য ব্যবহার করতে হয় ওদের। তাই যখন পর্যটক কম থাকে ঘোড়া ছেড়ে দিয়ে রাখা হয়।
নুরুল আলম আরও বলেন, 'এখন বর্ষাকালে বৃষ্টি এবং বিরূপ আবহাওয়া বিরাজমান। এ সময়টায় ঘোড়া ছেড়ে দেওয়া হয়। ঘোড়া ছেড়ে দিলে নিজের মতো ঘোরাফেরা করে। ঘাসসহ নানা ধরনের খাবার খায়। একসময় ঘোড়াগুলো আবার ঠিকই ঘরে ফিরে আসে।'
তিনি বলেন, 'তবে ঘোড়া ছেড়ে দিয়ে রাখায় অনেক ক্ষেত্রে কিছু ঘোড়া পথ ভুলে যায়। মালিকের কাছে ফিরতে দেরি করে। সেসব ঘোড়া অবশ্য মালিকরা চেনেন। ঘরে না ফিরলে খোঁজ করে ফিরিয়ে আনা হয়।'
ঘোড়া মালিক সমিতির তথ্য থেকে জানা যায়, কক্সবাজার সৈকতে বেড়াতে আসা পর্যটকদের বিনোদন দেওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে ৬০টি ঘোড়া ব্যবহার হয়ে আসছে। এসব ঘোড়ার পিঠে চড়ে, ছবি তুলে নানাভাবে উপভোগ করেন পর্যটকরা। সৈকতের পর্যটকদের বিনোদন দিয়ে প্রতি বছরের পর্যটন মৌসুমে ডিসেম্বর, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে প্রতিদিন গড়ে একটি ঘোড়া দিয়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা পর্যন্ত আয় হয়। গড়ে তিন হাজার টাকা হিসাবে চার মাসে একটি ঘোড়া দিয়ে তিন লাখ ৬০ হাজার টাকা আয় করেন মালিকরা। বাকি অফ সিজনে আয় কমে যায়। এই অফ সিজনেই খরচ বাঁচানোর জন্য ঘোড়ার যত্ন না করে, খাবার না দিয়ে তাদের ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ করেছেন অনেকেই।
শুধু তাই না, অনেক ক্ষেত্রে বয়স্ক বা আর কর্মক্ষম নয় এমন অনেক ঘোড়াই মালিকরা ইচ্ছে করে ছেড়ে দেন— এমন তথ্যও মিলেছে।
বিচকর্মী বেলাল হোসেন জানিয়েছেন, মালিকরা ঘোড়াগুলোকে কেবল আয়ের উৎসের জন্য ব্যবহার করলেও রোগ হলে চিকিৎসা আর পর্যাপ্ত খাবারের পেছনে খরচ করতে চায় না। আর ঘোড়া বয়স্ক হলে কর্মক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। সেসব ঘোড়াও ছেড়ে দেন তারা। যে কারণে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যবসায়ীদের এভাবে ঘোড়া ছেড়ে না দিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলেও তা শুনছেন না কেউ।
কিন্তু মালিকপক্ষ ইচ্ছা করে বয়স্ক ঘোড়াকে পরিত্যাগ করার অভিযোগ মানছেন না। তাদের বক্তব্য- বয়স্ক ঘোড়াকে উৎফুল্ল রাখতেই মাঝে মাঝে ছেড়ে দেওয়া হয়। এই দাবি কক্সবাজার ঘোড়া মালিক সমিতির সভাপতি আহসান উদ্দিন নিশানের।
তিনি বলেন, 'মাঝে মাঝে ছেড়ে দেওয়া হয় ঘোড়াগুলো, এটা ঠিক। নির্দিষ্ট সময় পর আবার নিয়েও আসা হয় তাদের। বয়স্ক ঘোড়াগুলোকে সবসময় চোখে চোখেই রাখা হয়। তাদের যত্নে কোনো গাফিলতি নেই। আর বয়স্ক ঘোড়া মারাও যায়। তখন মৃত ঘোড়া মাটিতে পুঁতে রাখা হয়।'
তিনি আরও দাবি করেন, ঘোড়াগুলোর নিয়মিত তত্ত্বাবধানের জন্য সার্বক্ষণিক পশু হাসপাতাল ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সহায়তাও তারা নেন।
তিনি জানান, প্রতিটি ঘোড়া ৮ থেকে ১০ বছর পরিশ্রম করতে সক্ষম। ঘোড়াগুলোর পেছনে দিন প্রতি খাবার বাবদ খরচ হয় ৬০০ টাকা। এছাড়া ঘোড়াগুলো রোগে আক্রান্ত হলে তখন তাদের চিকিৎসাবাবদ খরচ বাড়ে। এক্ষেত্রে অনেক ঘোড়ার মালিক আয় কমার কারণে বা বন্ধ হয়ে গেলে তখন ঘোড়াকে ছেড়ে দেন। এসব ঘোড়া ঘুরে ফিরে নিজেদের মতো খাদ্য সংগ্রহ করে খায়। তবে এটা উচিত না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
কক্সবাজার সৈকতের ব্যবসায়ী হাসান আহমদ জানান, তার নিজের ২টি ঘোড়া রয়েছে। এ ঘোড়াগুলো থেকে তাদের যা আয় হয় তা দিয়ে প্রতিদিন ঘোড়ার খাবার কিনে বাকি টাকা দিয়ে চলে তাদের সংসার। ফলে তিনি তার ঘোড়ার যত্ন নিতে ভোলেন না। নিয়ম করেই ঘোড়ার যত্ন নিতে হয়, এ নিয়মে কখনও কখনও ছেড়ে দিতে হয়, কখনও কখনও উন্মুক্ত স্থানে রাখা, গোসল, খাবার- এসবই নিয়ম মেনে করতে হয়। বয়স হলে মনোযোগ আরও বাড়িয়ে দিতে হয়। তবে এটা অনেক ঘোড়া মালিক মানেন না, স্বীকার করলেন হাসান।
কক্সবাজার পিপলস ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ ইকবাল জানান, ঘোড়ার আয়ের ওপরে নির্ভর করে আজ মালিকদের অনেকেই গাড়ি-বাড়ির মালিক হয়েছেন। গড়েছেন বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও। কিন্তু আয় কম বা বন্ধ হলেই ঘোড়ার খাবার বন্ধ করে ছেড়ে দেয়া অমানবিক কাজ। এ বিষয়টি নিয়ে ২০২০ সালে আলোচনাও হয়েছে। ওই সময় মালিকদের ঘোড়াগুলো এভাবে ছেড়ে না দেওয়ার নিদের্শ দিয়েছিল প্রশাসন। কিন্তু তা মানছেন না মালিকরা।
ফরহাদ জানান, ২০২১ সালে করোনার সময় ২৪টি ঘোড়া মারা যায়। এসব ঘোড়া ছেড়ে দেয়ার পর একে একে মৃত্যু হয়। এ নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর হৈচৈ শুরু হয়। এরপর কিছু দিন নানা নিদের্শনার কারণে ঘোড়া ছেড়ে দেয়া বন্ধ করলেও আবার শুরু হয়েছে এখন। এটা রোধে প্রশাসনকে আবারও কঠোর হওয়ার কথা বলেন তিনি।
কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মাহবুবুর রহমান জানান, বিভিন্ন সময় বলার পরও কিছু মালিক তাদের ঘোড়া বেওয়ারিশভাবে ছেড়ে দিয়ে রাখেন। যা যানবাহন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে, সাধারণ মানুষও ভয় পায়। এই ব্যাপারে মালিকদের একাধিকবার বলা হয়েছে। না মানলে ছেড়ে দেয়া ঘোড়া উদ্ধার করে ডুলহাজারায় বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে নিয়ে যাওয়া হবে।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আতাউল গনি ওসমানি জানান, এ ব্যাপারে ঘোড়া মালিকদের সাথে আবার সভা করে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।