মুগ্ধকে হারিয়ে শোকসাগরে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করে গত মার্চে ঢাকায় আসেন মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ। এরপর বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে (বিইউপি) এমবিএতে ভর্তি হন। স্বপ্ন ছিল উচ্চশিক্ষা নিতে একদিন দেশের বাইরে যাবেন। সেই প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সংঘর্ষে গত ১৮ জুলাই রাজধানীর উত্তরায় গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান তিনি।
মুগ্ধ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলা, গান ও সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে ক্যাম্পাসের প্রিয়মুখ ছিলেন তিনি। তার মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। তার মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান তারা সবাই।
মুগ্ধের মৃত্যুর মিনিট ১৫ আগে ধারণ করা একটি ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাসছে। তাতে দেখা যায়, ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন সড়কে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ছোটাছুটি করছেন। এর মধ্যেই হাতে পানি ভর্তি বাক্স ও বিস্কুট নিয়ে ছুটছেন মুগ্ধ। শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ তার কাছ থেকে পানি পান করছেন। ধোঁয়ার মধ্যে বেশ কয়েকবার চোখ মুছতেও দেখা গেছে মুগ্ধকে।
ওই দিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে মুগ্ধের সঙ্গে থাকা বন্ধু নাইমুর রহমান আশিক বলেন, 'উত্তরায় ছাত্রদের ওপর হামলা হচ্ছে শুনে তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য বন্ধুরা মিলে সেখানে ছুটে যাই। ওই দিন অনেককেই মুগ্ধ আর আমি হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছি। সন্ধ্যা ৬টার দিকে ছাত্রদের মাঝে পানি ও বিস্কুট বিতরণ করে রোড ডিভাইডারে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। হঠাৎ রাজউক কমার্শিয়ালের সামনে থেকে গুলি শুরু হয়। তখন অন্যদের সঙ্গে আমরাও দৌড় দিই। হঠাৎ গুলি লেগে সড়কে পড়ে গেছে মুগ্ধ। ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।' পরে উত্তরাতেই তার দাফনকার্য সম্পন্ন হয়।
মুগ্ধের জন্ম উত্তরায়, ১৯৯৮ সালে। তার গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তিন ভাইয়ের মধ্যে মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ ও মুগ্ধ ছিলেন যমজ।
উত্তরার ইসলামিক এডুকেশন সোসাইটিতে প্রাথমিক এবং উত্তরা হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি সম্পন্ন করে ২০১৯ সালে মুগ্ধ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। লেখাপড়ার পাশাপাশি ফুটবল খেলোয়াড়, গায়ক, গিটারিস্ট ও দক্ষ সংগঠক হিসেবে বেশ সুনাম ছিল তার। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান শিক্ষা সমাপনী-২০২৩ এর আহ্বায়ক ছিলেন তিনি, ছিলেন স্কাউট গ্রুপের ইউনিট লিডার। শ্রেষ্ঠ সংগঠক হিসেবে বাংলাদেশ স্কাউটস থেকে পেয়েছেন 'ন্যাশনাল সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড'।
মুগ্ধের বড় ভাই মীর মাহমুদুর রহমান দীপ্ত বলেন, 'পরিবারে সবার আদরের ছিল মুগ্ধ। ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করত ও। এমবিএর পাশাপাশি দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষার জন্য আইইএলটিএস করছিল। কিন্তু সব কিছু এভাবে শেষ হয়ে যাবে, কে জানত!'
মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ বলেন, 'আমাদের তিন ভাইয়ের মধ্যে মায়ের সবচেয়ে বেশি খেয়াল রাখত মুগ্ধ। সবসময় মায়ের দেখাশোনা করত। ফ্রিল্যান্সিং করে নিজের খরচ চালাত। মা এখনও কাঁদছেন। বাবা চুপচাপ হয়ে গেছেন।'
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শেখ আবদুস সামাদ বলেন, 'মুগ্ধ অসাধারণ একটি ছেলে ছিল। কারও সঙ্গে কখনও গোলমাল, বেয়াদবি করতে দেখিনি বা শুনিনি। ক্লাসে ওকে বকা দিলে এমনভাবে হেসে দিত, পরে ওকে আর কিছুই বলতে পারতাম না।'
বিশ্ববিদ্যালয়টির গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী মুহিব্বুল্লাহ বলেন, 'যেকোনো আয়োজনে সামনের সারিতে থাকতেন মুগ্ধ ভাই। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের আগে আন্দোলনে আমরা সক্রিয় ছিলাম। ঢাকায় থেকে তিনি আমাদের সাহস দিতেন।'