এক মহাকাব্য—“আ ম্যান ফ্রম মাউন্টেন”
আফগানিস্তান কমিউনিস্ট বিপ্লবে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন সুলাইমান লায়েক, তিনি মার্কসবাদী বিপ্লবী। এর বাইরে তিনি একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ, বিপ্লবী এবং প্রাক্তন মন্ত্রী।
আফগানিস্তানের পাকতিকা প্রদেশে জন্মগ্রহণকারী কবি সুলাইমান লায়েক ১৯৫৭ সালে কাবুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাহিত্যে স্নাতক করেন। তিনি পশতু এবং ফার্সি ভাষায় প্রচুর লেখালেখি করেছেন। ১৯৫৭-১৯৬৮ এই সময়ে বিভিন্ন আফগান সংবাদ মাধ্যমে তাঁর লেখা প্রকাশিত হতে থাকে নিয়মিত। ১৯৬৮ সালের দিকে তিনি নিজেই পারচাম নামে একটি পত্রিকা চালু করেন এবং তাঁর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
লেখালিখির পাশাপাশি সুলাইমান লায়েকের বর্ণিল রাজনৈতিক জীবনও শুরু ওই ষাটের দশকেই। ১৯৬০ সালের দিকে পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অব আফগানিস্তান বা পিডিপিএ এর মধ্যপন্থি উইংয়ে লায়েক যোগ দেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগানিস্তান দখলের পর সুলাইমান লায়েক পিডিপিএ এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। পরবর্তিতে তাঁকে একাডেমি অব সায়েরন্সের দায়িত্ব দেয়া হয় এবং আফগান পলিটব্যুরোর স্থায়ী সদস্য পদ পান। আরও পরে, সুলাইমান লায়েক জাতীয়তাবাদ এবং উপজাতীয় সম্পর্ক বিষয়ক মন্ত্রিত্বের দায়িত্বও পালন করেন।
নানা পরিচয়ের পরিচিত সুলাইমান লায়েকের আফগানদের কাছে বড় পরিচয় তিনি কবি। চল্লিশ বছর ধরে তিনি রচনা করছিলেন এক মহাকাব্য, যা তাঁর জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ হিসেবে ধরা হচ্ছিল। কিন্তু সুবিশাল এই মহাকাব্যগ্রন্থ তিনি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি। এ পর্যন্ত রচিত দীর্ঘ আটশ পৃষ্ঠার অসমাপ্ত এই মহাকাব্য রচনা করতে গিয়ে তিনি তাঁর পরিবার এবং অন্য অনেক কিছু থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন। তার মহাকাব্য মূলত একজন ইসলামী বিপ্লবের তরুণ যোদ্ধাকে নিয়ে। যে তরুণ ইসলামি বিপ্লব সংঘঠিত হবে এই স্বপ্ন দেখে, সঙ্গে তার জীবনবোধ, তাঁর চিন্তাচেতনা, মানসিক টানাপোড়েনের এসবই ছিল তার কাব্যকাহিনি। এই তরুণ-বিপ্লবী আসলে সোভিয়েট বিরোধী আফগান যোদ্ধাদেরই প্রতিভূ। সঙ্গের তরুণ সাথী যোদ্ধাদের নিয়ে যে সোভিয়েট সমর্থিত কমিউনিস্ট শাসনের ভিত্তি নাড়িয়ে দিয়েছিল। বাস্তবেও কবি সুলাইমান লায়েক নিজেও ছিলেন এরকম একজন, বোধকরি সে কারণেই তার মহাকাব্যের ঘটনাবলীও নব্বই দশকের শুরুর দিকে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক টানাপোড়েন এবং বিশেষ এক সময়কে কেন্দ্র করে।
মহাকাব্যের শ্লোকের পর শ্লোক, পরিচ্ছদের পর পরিচ্ছদ জুড়ে সেই বিপ্লবীর জীবন, তাঁর চিন্তার ধরণ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই কাব্যগ্রন্থ দিয়ে লায়েক আফগানিস্থানের বিভিন্ন জাতি ও সামন্ততান্ত্রিক গোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্যমান অন্যায় অবিচার আর মার্কসীয় সমাজতন্ত্রের আদর্শ বা ইসলামিক শাসনতন্ত্রের আদর্শ সমীচিন হবে কিনা সেরকম কোনো সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করেন নাই। তার নায়কের দৃষ্টিতে দুই আদর্শই দেশের মানুষকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রেখেছে। সঙ্গে উত্তরাধিকার হিসেবে পেয়েছে বিশৃঙ্খলা আর সমাধানহীন রক্তাক্ত পথ।
সুলাইমান লায়েক আফগানিস্তানের ইতিহাসের যে গুরুত্বপুর্ণ অধ্যায় নিয়ে তার এ অসাধারণ সৃষ্টি শুরু করেছিলেন এক ঘাতক বোমার আঘাতে তা স্তব্ধ হয়ে যায়। তার অসামান্য এই মহাকাব্য অসমাপ্তই রয়ে গেল। "কিছুই আর মাথায় আসছে না", পাণ্ডুলিপি দূরে সরিয়ে দিয়ে মৃত্যু শয্যায় ছেলে জামারাককে এ কথা বলেন সুলাইমান লায়েক। কিছুটা সুস্থবোধ করলেও তিনি আর মহাকাব্যে ফিরে যেতে পারেননি। কেবল পড়াটা চালু ছিল, শুয়ে শুয়ে শুধু বই পড়তেন।
নব্বই বছর বয়স্ক সুলাইমান লায়েক গত বছর সেপ্টেম্বরে কাবুলের সাশদারাক এলাকায় তালেবানদের গাড়ি বোমা হামলায় আহত হন। তাঁকে প্রথমে কাবুলে, এরপর ভারতে এবং সর্বশেষ জার্মানীতে চিকিৎসার জন্য নেয়া হয়। কবি সুলাইমান লায়েক জুলাইয়ের শেষের দিকে জার্মানীতে মারা যান।
রাজধানি কাবুলের পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত সমাধিক্ষেত্রে তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন তাঁর আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, এবং বহু-আগেই আফগানিস্থানে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়া বাম আন্দোলনের কয়েক ডজন পুরনো বিপ্লবী সাথী। লায়েকের শেষকৃত্যে আগত বন্ধুরা তাঁর সাহিত্য, রাজনৈতিক জীবন আর অসমাপ্ত গ্রন্থ নিয়ে আলোচনা করেনা, স্মৃতিচারণ করেন সেই সোভিয়েত বিরোধী যুদ্ধের দিনগুলোর।
১৯৭৮ সালে লায়েক আর তাঁর বিপ্লবী বন্ধুদের দ্বারা সংগঠিত রক্তাক্ত বিপ্লব কোনো সুফল বয়ে আনেনি, বরং আফগানিস্তানের ইতিহাসে তা রয়ে গেছে এক অসম্পুর্ণ অধ্যায় হিসেবে। আফগানিস্থান এখনো রক্ত ঝরা থামেনি। এখনও বিদ্রোহ চলছেই দেশের নানা প্রান্তে। লায়েক হতাশায় মুষড়ে ছিলেন, তার কাছেও আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল, অনেকের মতোই কেউ জানে দেশটির ভবিষ্যৎ কী, কী ঘটতে চলেছে এখানে। পাহাড়ের চূড়ায় লায়েকের সেই শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে বন্ধুদের চোখে যখন তেজোদীপ্ত লায়েক পুরোনো সেই দিন ফিরে ফিরে আসছিল বন্ধুদের স্মৃতিতে নিঃশব্দে, তখনও মাথার উপর চক্কর দিচ্ছিল আমেরিকান সেনাদের যুদ্ধবিমানগুলো।
আফগান কমিউনিস্ট শাসনের শেষের দিকে সোভিয়েত সেনারা যখন তাঁদের আস্তানা গুটানো শুরু করেছে তখন কমিউনিস্ট নেতারা যুক্তরাষ্ট্রকে পুনরায় দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে অংশগ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করেন। ইসলামিক বিদ্রোহীদের সাথে আলোচনার জন্য আহবান করেন যাতে একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব হয়। কিন্তু শান্তি আর ফিরে আসে না।
দীর্ঘ প্রায় বিশ বছরের ঝামেলাপূর্ণ অভিযানের পর যুক্তরাষ্ট্রও এখন তাঁদের সৈন্যদের আফগানিস্তান থেকে ফিরিয়ে নিয়ে সরে পড়তে চাইছে। আফগানিস্তানে এখনও তাঁদের সৈন্য সংখ্যা প্রায় ১০০,০০০ কাছা্কাছি, যা একদা সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক পাঠানো সৈন্য সংখ্যার সমান।
আফগানিস্তানের রাজনীতির বিশৃঙ্খলার আর এই টানাপোড়নের শুরু প্রায় চার দশক আগে, যখন বামপন্থী বিপ্লবীরা দেশের প্রথম গনতান্ত্রিক সরকারকে হত্যা করার মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেছিল, তাঁর পরম্পরাই আজকের আফগানিস্তান বয়ে চলেছে। ওই ঘটনা থেকেই আফগানিস্থানে শুরু হয়েছিল পরস্পরকে হত্যার রাজনীতি, ভিন্নমত প্রকাশকারীদের জন্য ভয়াবহ হিংস্রতা এবং পরবর্তিতে যা গৃহযুদ্ধের রূপ নেয় এবং এখন পর্যন্ত আফগানরা তা মোকাবেলা করে চলেছে।
১৯৭৮ সালের ক্ষমতা দখলের নিষ্ঠুরতা এতোটাই ভয়াবহ ছিল যে ক্ষমতা দখলের এক বছরের মধ্যে পরপর দুই জন প্রেসিডেন্টকে হত্যা করা হয়। প্রথম কম্যুনিস্ট প্রেসিডেন্টকে বালিশ চাপা দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। যার আদেশে তাঁকে হত্যা করা হয় তিনিই হন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট। কিন্তু এক মাসের মধ্যে তাঁকেও হত্যা করা হয়। সোভিয়েত এলিট ফোর্স তাঁকে হত্যা করে যখন তিনি তাঁর পরিবার ও বন্ধুদের সাথে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন।
উপত্যকার চূড়ায় অনুষ্ঠিত শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে লায়েকের সাথীরা খুঁজে ফিরছিলেন কী হতে পারতো সেই বিপ্লব পরবর্তী দিন গুলোয়। বাহাত্তর বছর বয়সী প্রাক্তন কর্ণেল দাউদ পোপাল যিনি বিপ্লবের প্রথম দিকের নেতা ছিলেন বলেন, 'আমরা যদি এভাবে টুকরো টুকরো করে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত না হতাম এই পর্বত চূড়া আমাদের সাথীদের মৃতদেহ দিয়ে ভরে উঠতো না। মাঝে মাঝে এই বিষয়টা আমাকে ভাবায়, চিন্তা করি আমার হৃদয় যদি পাথরের তৈরি হতো তা'হলে – কী হতো এটা যদি বিস্ফোরিত না হতো?'
কর্ণেল পোপাল স্মরণ করেন, সুলাইমান লায়েক এবং তিনি ক্যু হওয়ার ঠিক আগে একসাথে জেলে ছিলেন। লায়েকের সততার দৃঢ়তা কর্ণেলকে ভীষণ টানত। তাঁর সততার জন্য সরকারে থাকাকালীন সময়ে প্রায়শ তাঁকে একলা থাকতে হতো, এমনকি ভিন্ন মতের কারণে জেলেও যেতে হয়েছিল তাঁকে।
লায়েকের সমাধির প্রান্তে ঝুঁকে কর্ণেল পোপাল অশ্রুসিক্ত নয়নে বলে উঠেন, 'তোমার বই, তোমার কবিতা আমার কাছে রইলো, বন্ধু!'
আফগানিস্তানে বাম আন্দোলনের শুরুর দিকে একজন অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন লায়েক, বাম আন্দোলনের অদ্বিতীয় নায়ক তিনি। কমিউনিস্ট শাসনের শেষ বছরে তাঁর ভূমিকা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করার মতো। তিনি তখন উপজাতি ও সীমান্ত সম্পর্কীত বিষয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছিলেন। প্রেসিডেন্ট নাজিবুল্লাহকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চাওয়া বিদ্রোহীদের সাথে সিআএ এর আলোচনার সমন্বয়কারী হিসেবে সুলাইমান লায়েক বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন তখন।
১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাঁদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নিলে নাজিবুল্লাহ'র সরকার আরও তিন বছর মধ্যপন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিতে থাকার চেষ্টা করে যায়। 'কোল্ড ওয়ার' যুদ্ধে ভারসাম্য আনার জন্য একই সময়ে আফগানিস্থানের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে নাজিবুল্লাহ'র জন্য ক্ষমতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। ১৯৯২ সালে ক্ষমতা হারান তিনি এবং পরবর্তিতে তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সুলাইমান লায়েক তখন দেশ ত্যাগ করে জার্মানিতে আশ্রয় নেন।
২০০৫ সালে লায়েক দেশে ফিরে আসেন। অতীত রাজনীতি নিয়ে এই সময়টাতে তিনি গভীর ভাবে ভাবেন। সে সময়ের রাজনীতির কঠোর সমালোচনা শুরু করেন। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে সমালোচনার পাশাপাশি আত্মমালোচনাও করেন, তিনি বলতে শুরু করেন,
'আমি যে সরকারে যোগ দিয়েছিলাম তা ছিল পথভ্রষ্ট, নীতিগত কঠোরতা আর মানুষের স্বাভাবিক জীবনাচার থেকে দূরে সরে যাওয়া ছিল চরম ভুল, অগ্রহণযোগ্য।'
রাজনীতিতে যে ভুল তিনি করেছিলেন তাঁর জন্য সাজা পেতে স্বেচ্ছায় বিচারের সম্মুখীন হতে চেয়েছিলেন। তার কথা ছিল তাতে যদি সুদীর্ঘ চার দশক ধরে চলমান হানাহানি ও বিশৃঙ্খলার যে ক্ষত তৈরি হয়েছে, এতে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাঁদের মনে সামান্য শান্তি আসে।
'আমি স্বেচ্ছায় বিচারের অধীন যেতে চাই, আমাকে দিয়েই শুরু হোক,' সুলাইমান লায়েক জোর দিয়ে বলেছিলেন।
"ক্ষমতার খেলায়, দলের খেলায়, আন্তর্জাতিক শক্তির মধ্যকার খেলায় একটা স্বাধীন জাতি কোরবানি হয়ে গেছে, শোষণের জাঁতাকলে শেষ হয়ে গেছে। আমরা আর স্বামীহীন নারী, পিতাহীন সন্তানের হিসেব রাখতে পারছি না।'
সুলাইমান লায়েক তার পুরো রাজনৈতিক জীবন জুড়েই প্রচুর লেখালেখি করেছেন। তার বেশির ভাগ-ই আফগানিস্তানের মূল দুই ভাষায় —পশতু এবং ফারসি। ডজনখানেক কবিতার সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর কবিতা আফগানিস্থানে প্রতিবাদে, মিছিলে, আন্দোলনে শ্লোগান হয়ে ভাসে, বিপ্লবের সংগীতে পরিণত হয়।
'ঘরের পথ যদি কন্টকাকীর্ণ হয়
আমরা খোলা পায়ে তাতে নাচব।'
লায়েকের পুত্র জুমারাক বাবার সত্তুরটির মত অপ্রকাশিত রাজনৈতিক ডায়রি থাকার কথা বলেছেন। সুলাইমান লায়েক যথেষ্ট গোছানো স্বভাবের ছিলেন, দক্ষ সংরক্ষক। রাজনৈতিক জীবনের খুঁটিনাটি বিস্তারিত তিনি নোট আকারে লিখে রেখে গেছেন। দলের নেতা হিসেবে রাত জেগে তিনি প্রত্যেক দিনের প্রাদেশিক কার্যক্রমের বিস্তারিত লিখে রাখতেন।
১৯৮০ র দিকে এক প্রাদেশিক কাজে দেশের পূর্বাঞ্চলে গেলে সুলাইমান লায়েক একজন তরুণ ইসলামি বিপ্লবীর সাক্ষাৎ পান এবং তাঁকে ঘিরেই পরবর্তীতে রচিত হতে শুরু করে তার মহাকাব্য। দীর্ঘ চার দশক ব্যপ্তি রচিত হয়েছে এই মহাকাব্য, কিন্তু অসমাপ্ত এক মহাকাব্য—"আ ম্যান ফ্রম মাউন্টেন" এই ছিল তার মহকাব্যের নাম।
সুলাইমান লায়েক তরুণ যোদ্ধার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের স্মৃতি এভাবে স্মরণ করেছেন, সেনারা একজন তরুণকে তাঁর সামনে নিয়ে এল—'তরুণের শরীরের গঠন এতো সুন্দর যেন মার্বেল পাথর কুঁদে বানানো হয়েছে।' তাঁকে ধরে আনা হয়েছিল একজন গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে।
সুলাইমান লায়েক তাঁকে মুক্ত ঘোষণা করার পরও সে যেতে অস্বীকৃত জানায়। এবং নিজের অপরাধ স্বীকার করে। লায়েক এতে ভীষণ অবাক হন। লায়েক যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করেন কেন সে এটা করছে, সেই তরুণ যে উত্তর দিযেছিল তা ১৯৮৯ সালে আমেরিকার লস এঞ্জেলস টাইমস পত্রিকার এক রিপোর্টে প্রকাশ করা হয়:
'আপনি আমাকে ক্ষমা করে দয়া দেখিয়েছেন এর বদলায় আমিও দয়া দেখিয়েছি, আমি আপনাকে সত্য উপহার দিয়েছি। এ ছাড়া দেয়ার আর কিছু নেই আমার, তাই।'
সেই তরুণের মুখে ছিল "কল্পনার অতীত শক্তি এবং সাহস," যা লায়েক চল্লিশ বছরেও ভুলতে পারেননি। সেই তরুণ বেঁচে ছিল লায়েকের কল্পনায়, তাঁর কবিতার হাজার হাজার পংক্তি জুড়ে, যেখানে তিনি খুঁজেছেন আফগানিস্তানের সীমাহীন কষ্টের উত্তর, এর সমাধান।
গত বছর সেপ্টেম্বরে সুলাইমান লায়েক তাঁর সোভিয়েত বাহিনীর তৈরি ছোট্ট বাসভবন থেকে বেরিয়ে তাঁর অফিস একাডেমি অব সায়েন্সে যাওয়ার পথে তালেবানদের গাড়ি বোমা হামলার শিকার হন। অন্য এক প্রজন্মের তরুণ বিপ্লবী তাঁর বিস্ফোরক ব্যাগ ভর্তি গাড়ি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে ন্যাটো এবং আমেরিকান সৈন্যবাহী যানে। সেই হামলায় লায়েক মারাত্মকরকম আহত হন।
সুলাইমান লায়েকের হাসপাতাল জীবনের শেষের দিকে একজন রিপোর্টার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যান। রিপোর্টারের মতে, সুলাইমান লায়েক মনে করেন এটা তাঁর বিপ্লবী জীবনরেই ঘটনা, সম্ভবত বিস্ফোরণের কারণে তিনি বিস্মৃতিতে ভুগছিলেন। তিনি ফিরে গিয়েছিলেন সেই সোভিয়েত বিরোধী দিনে! এছাড়া তিনি বারবার অনুতাপের সঙ্গে বলেছিলেন, কত না গর্বিত ছিলেন তিনি। তাঁর দণ্ডাজ্ঞা, তাঁর বিশ্বাস কত দৃঢ় ছিল। এখনো, এই বয়সেও তাঁকে হত্যা করার জন্য গুপ্ত হত্যাকারীরা ঘুরে বেড়ায়।