তিন দশকে ২৮ লাখ টন বরফের আচ্ছাদন হারিয়েছে পৃথিবী, এক মিটার বাড়বে সমুদ্রের উচ্চতা
আমাদের গ্রহের উত্তর এবং দক্ষিণ মেরু জুরে থাকা বিশাল বরফের আচ্ছাদন- তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের এক প্রাকৃতিক সুরক্ষা কবচ। বিশাল হিমবাহ সঞ্চিত জলরাশি যেমন নিশ্চিত করে অনুকূল সমুদ্র স্রোত এবং আবহাওয়ার চক্র। ঠিক তেমনি বরফের সাদা আস্তরণে প্রতিফলিত হয়ে বিপুল সুর্যালোকের তাপ ফেরত যায় মহাশূন্যে। এভাবেই পৃথিবীর স্বাভাবিক জলবায়ুর অস্তিত্বের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জরিয়ে আছে হিমশীতল মেরু অঞ্চল।
তবে, মানুষের মতো আত্মঘাতি জীব পৃথিবীর অন্য কোনো প্রজাতি নয়। বৈশ্বিক সম্পদ আহরণ ও অপব্যবহারের যে বিধ্বংসী প্রক্রিয়া আমাদের প্রজাতি সূচনা করেছে, তার হাত ধরেই এসেছে জলবায়ু পরিবর্তন। বায়ুমণ্ডলে তাপমাত্রা শোষণকারি গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে চলায় তৈরি হয়েছে এ অবস্থা। সমুদ্রজলও শোষণ করে নিচ্ছে বাড়তি তাপ। ফলশ্রুতিতে জীবনদায়ী হিমশৈল হারিয়ে চলেছে পৃথিবী।
১৯৯৪ সালের পর থেকে গ্রিনহাউজ উষ্ণতা চক্রের এ প্রভাবে ২৮ লাখ কোটি টন বরফের আচ্ছাদন হারিয়েছে, বলে জানান বিজ্ঞানীরা। যুক্তরাজ্যের একটি বিজ্ঞানীদল সম্প্রতি পৃথিবীর দুই মেরুর পাহাড় এবং হিমবাহের স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণের মাধ্যমে রক্তহিম করা এ তথ্য দিয়েছেন।
লিডস ও এডিনবরা- বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের বিজ্ঞানীরা হিমবাহ এবং সামুদ্রিক বরফ গলার এ হারকে 'গগণচুম্বি' আখ্যা দিয়ে হুঁশিয়ার করে বলেন, এর ফলে চলতি শতকের শেষ নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার পর্যন্ত বাড়বে।
বাংলাদেশের মতো নিম্নভূমির পলিগঠিত বদ্বীপের জন্য সমুদ্রের উচ্চতা বাড়ার সর্বনাশা প্রভাব এড়ানো একেবারেই অসম্ভব। মহাসমুদ্র বেষ্টিত পৃথিবীর বিচ্ছিন্ন কিছু দ্বীপরাষ্ট্রের পাশাপাশি বাংলাদেশেও এর ফলে দারিদ্র্য বাড়ার কথাও জানানো হয়েছে ইতোপূর্বের অনেক গবেষণায়।
''বিষয়টির গুরুত্ব ব্যাখ্যা করা যায়; মানুষের জীবন ও জীবিকার উপর তার প্রভাবের মধ্য দিয়ে। সমুদ্রপৃষ্ঠের প্রতি সেন্টিমিটার উচ্চতা বৃদ্ধির অর্থ; এতে নিম্নভূমিতে বসবাসকারী এক কোটি মানুষ তাদের জন্মভূমি থেকে বাস্তুচ্যুত হবে। তাই একশ' সেন্টিমিটার (এক মিটার) বৃদ্ধির অর্থ শত কোটি মানুষের জলবায়ু শরণার্থীতে পরিণত হওয়া'' বলছিলেন লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর পোলার অবজারভেশন অ্যান্ড মডেলিং- এর পরিচালক অধ্যাপক অ্যান্ডি শেফার্ড।
বরফরাশির ক্ষয় সূর্যরশ্মির তীব্র বিকিরণ মহাশূন্যে ফিরিয়ে দিতে আমাদের গ্রহের সক্ষমতা হ্রাস করছে। তারা জানান, বরফ আর তুষারের আচ্ছাদন সরে গিয়ে উন্মুক্ত হয়ে পড়া সমুদ্র এবং কালো রঙা মাটি, আরো বেশি পরিমাণে সূর্যকিরণের তাপ শুষে নিচ্ছে। ফলে চক্রাকারে বাড়ছে গ্রহের উষ্ণতা আর বরফগলার পরিমাণ।
পাশাপাশি, হিমবাহ থেকে গলে ধেয়ে আসা বিপুল ঠাণ্ডা পানির স্রোত উত্তর ও দক্ষিণ মেরু সাগরের বাস্তুসংস্থান এবং জীব-বৈচিত্র্যকে হুমকির মুখে ফেলেছে। হিমবাহ গলে যাওয়ায়; মেরুর প্রতিকুল পরিবেশে বসবাসকারী মানুষের বিশুদ্ধ পানির উৎসও ক্রমে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
''অতীতে গবেষকরা শুধু নির্দিষ্ট একটি অঞ্চল যেমন; দক্ষিণ মেরু বা গ্রিনল্যান্ডে বরফ গলার ঘটনা নিয়ে গবেষণা করেছেন। কিন্তু, এই প্রথমবার কোনো অনুসন্ধানের আওতায় পুরো পৃথিবীর বরফের আচ্ছাদন হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। এ গবেষণার ফলাফল আমাদের বাকরুদ্ধ ও বিস্মিত করে দেয়'' বলছিলেন অ্যান্ডি শেফার্ড।
জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্তঃসরকার প্যানেল সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে যেভাবে বরফ গলার অনুমান করেছিলেন, সেটাই আমাদের গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে- যোগ করেন তিনি।
ব্রিটিশ গবেষক দলটি দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়া, কানাডা এবং বিশ্বের অঞ্চলের পর্বতমালায় অবস্থিত হিমবাহের অবস্থাও কৃত্রিম উপগ্রহ চিত্রের সাহায্যে বিশ্লেষণ করেন। তাছাড়া, উত্তর ও দক্ষিণ মেরু সাগরের সামুদ্রিক বরফের স্তর গলন এবং উত্তর মেরুর মূল বরফ হিমবাহ স্তর থেকে হিমশৈলের সাগরে স্খলন গতিও পর্যবেক্ষন করেছেন বিজ্ঞানীরা। ১৯৯৪ থেকে ২০১৭ সাল নাগাদ তোলা কৃত্রিম উপগ্রহের ছবি একত্র করে তুলনা করেন তারা।
বিজ্ঞানীরা তাদের অনুসন্ধানের ফলাফলে জানিয়েছেন, পৃথিবীর সমস্ত অঞ্চলেই বরফের আচ্ছাদন মারাত্মক আকারে কমেছে গত তিন দশকে। আর এই হারিয়ে যাওয়ার হার ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা দলের সদস্য টম সল্টার বলেন, ''২৮ লাখ কোটি টন বরফ আচ্ছাদন হারিয়েছি আমরা। এ পরিমাণ বরফ দিয়ে পুরো যুক্তরাজ্যকে ১০০ মিটার পুরু জমাট পানির আস্তরণে ঢেকে দেওয়া সম্ভব। বিষয়টি চিন্তা করলেই হতবাক হতে হয়।''
ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের গবেষণাটির রিভ্যিউ পেপার সম্প্রতি প্রকাশিত হয় অনলাইন জার্নাল- ক্রায়োস্ফিয়ার ডিসকাশন্স- এ। বিজ্ঞানীরা সেখানে জোর দাবি করে বলেছেন, শুধুমাত্র জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ প্রভাবেই পৃথিবী তার বিপুল বরফের সুরক্ষা চাদর হারিয়েছে।
তারা জানান, ১৮৮০ সাল থেকে পৃথিবীর উপরিপৃষ্ঠের তাপমাত্রা দশমিক৮৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস বাড়ে। এ বৃদ্ধি মেরু অঞ্চলে বহুগুণ শক্তিশালী আকারে প্রভাব ফেলতে শুরু করে। বিশেষ করে, গ্রিনহাউজ গ্যাসের তাপমাত্রা ধরে রাখার কারণে বায়ুমণ্ডল এবং সমুদ্রস্তর দুই মাত্রিকে উষ্ণতা বাড়তে থাকে। এই দ্বিমুখী চাপেই বিপর্যয়কর হারে বরফ গলা শুরু হয়েছে। বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে বিশ্বের নীতি-নির্ধারকদের উদাসীনতার নিন্দা করেছেন।
হিমালয়ের মতো ভূভাগের পর্বতমালায় হিমবাহ গলার পরিমাণ বাড়ার জন্য তারা অবশ্য বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতাকেই মূল প্রভাবক হিসেবে চিহ্নিত করেন।