ইতিহাস আবার এই একনায়কদের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে
নিরো: তরুণ এক সম্রাটের পতন
নিরো আর একনায়কতন্ত্র শব্দটি সমার্থক হয়ে গেছে। রোম যখন পুড়ছিল, নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন– এ প্রবাদবাক্য জানেন সবাই। রোমের এই পঞ্চম সম্রাট রাতারাতি একনায়ক হয়ে ওঠেননি। বরং ধারাবাহিক ঘটনাক্রমের মধ্য দিয়ে তার অভ্যুদয় এবং পতন ঘটেছে।
নিরোর পুরো নাম লুসিয়াস ডোমিটিয়াস নিরো। ৩৭ খ্রিষ্টাব্দে তার জন্ম। মামা সম্রাট ক্লডিয়াস ৫০ খ্রিষ্টাব্দে নিরোকে দত্তক নেন। ক্লডিয়াসের মৃত্যুর পর মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি সাম্রাজ্যের সিংহাসনে আরোহণ করেন।
প্রথম দিকে নিরো এক জনপ্রিয় সম্রাট হয়ে ওঠেন। নিজ বিজ্ঞ উপদেষ্টা সেনেকার পরামর্শ গ্রাহ্য করতেন। নিরোর রাজত্ব শুরু হয় আপেক্ষিক শান্তি এবং সমৃদ্ধির মধ্য দিয়ে।
উচ্চাভিলাষী নির্মাণ প্রকল্প নিতে থাকেন তিনি। এর মধ্যে ছিল তার বিলাসবহুল প্রাসাদ ডোমাস আউরিয়া। নিরো তখনও একাধারে শিল্পকলার পৃষ্টপোষক সঙ্গে কবি, সংগীতজ্ঞদের উদার সমর্থনও জুগিয়েছেন।
কিন্তু সকাল দেখে দিনটি কেমন যাবে বলে প্রবাদবাক্যের সত্যতা নিরোর জীবনে খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্রতিশ্রুতিশীল যাত্রা মোড় ঘুরে গেল অল্প সময়েই। আচরণে নিষ্ঠুর ও অস্থিরমতি হয়ে উঠতে থাকলেন তিনি। ৬৪ খ্রিষ্টাব্দে রোমের মহা অগ্নিকাণ্ডের জন্য দায়ী করা হয় নিরোকেই। বলা হয়, অগ্নিকাণ্ডের দৃশ্য তিনি নিজ প্রাসাদ থেকে আনন্দের সাথেই উপভোগ করছিলেন। এ সময় তিনি নাকি কবিতাও আবৃত্তি করছিলেন। প্রবাদে অবশ্য বলা হয়েছে, রোম যখন পুড়ছিল, নিরো তখন বাজাচ্ছিলেন বাঁশি। অবশ্য অগ্নিকাণ্ডের দায়ভার সম্রাট চাপালেন খ্রিষ্টানদের ওপর। এ সূত্র ধরে খ্রিষ্টানদের ওপর নেমে এল ভয়াবহ নির্যাতন। নিজ মা এগ্রিপিনা দ্য ইয়াংগার এবং প্রথম স্ত্রী অক্টাভিয়াকেসহ যাদেরই প্রতিপক্ষ বা প্রতিদ্বন্দ্বী বলে ভেবেছেন তাদের সমূল নির্মূল করতে থাকেন। নিজ রক্ষিতা পপিয়া সাবিনাকে নিরো বিয়ে করেন। বলা হয়, অক্টাভিয়াকে বিষ দিয়েছিলেন সাবিনা।
তার মাত্রা ছাড়া এবং অযথা নির্মাণ প্রকল্পের ব্যয়ের খায়েশ মেটাতে গিয়ে রোমান কোষাগার শূন্য হয়ে যায়। সংগীত এবং অভিনয়ের প্রতি তার উদ্দাম টান রোমের মানুষের কাছে উপহাসের উৎস হয়ে ওঠে। ক্রমবর্ধমান স্বৈরাচারী শাসনের মধ্য দিয়ে রোমের সিনেট এবং জনগণ থেকে নিরো ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।
দিনে দিনে নিরোর শাসন মেনে নেওয়ার জো আর রইল না। তার রাজত্ব অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে শুরু করে। নিরোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন হিস্পানিয়া ট্যারাকোনেনসিসের গভর্নর গালবা। ক্রমবর্ধমান বিদ্রোহ এবং বিরোধিতার ধকল সামাল দেওয়া সম্ভব হয়ে উঠল না। তিনি রোম ছেড়ে পালিয়ে যান। ৬৮ খ্রিষ্টাব্দের ৯ জুন আত্মহত্যা করেন। তখন তার বয়স মাত্র ৩১।
নিরোর রাজত্বকাল নিষ্ঠুরতা এবং বাড়াবাড়ির প্রতীক হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণহীন ক্ষমতার বিপদ সম্পর্কে একটি সতর্ক কাহিনি হয়েও বিরাজ করছে ইতিহাসে।
হিটলার: চিত্রকর হওয়ার চেষ্টায় ব্যর্থ, হলেন একনায়ক
অ্যাডলফ হিটলারের জন্ম ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে অস্ট্রিয়াতে। প্রথম জীবনে দুই দুইবার তিনি ভিয়েনা একাডেমি অব ফাইন আর্টসে ভর্তি হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেন।
আকর্ষণীয় এবং কৌশলী ব্যক্তিত্বের অধিকারী হিটলারের জীবনের মোড় এ ব্যর্থতার পর ঘুরে যায়। তিনি প্রথম মহাযুদ্ধোত্তর নড়বড়ে জার্মানির দশাকে পুঁজি করেন। মহাযুদ্ধে পরাজয়ের পর জার্মানি অর্থনৈতিক দিক থেকে এক টালমাটাল অবস্থায় পড়ে। পাশাপাশি দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিরতার ঝোড়ো হাওয়া বইতে থাকে। ভার্সেই চুক্তিতে জার্মানির ওপর কঠিন শর্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়। ফলে জার্মানিতে হতাশা এবং স্বজাত্য বোধ ও উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রকোপ বাড়তে থাকে।
হিটলার এ সময়ে শিল্পী হওয়ার স্বপ্নকে বাদ দিয়ে জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি নামে একটি উগ্রপন্থী দলে যোগ দেন। দলটির নাম পরে বদলে ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়াকাস পার্টি বা নাজি পার্টি রাখা হয়। বাগ্মিতাশৈলীতে হিটলারের দক্ষতা ছিল ঈর্ষণীয়। তিনি জার্মানির হারানো গৌরব এবং মহত্ত্বকে ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেন। তার এ রকম ভাষণ জার্মান জনগণকে ব্যাপকভাবে আকর্ষণ করতে থাকে। তিনি জনপ্রিয়তায় ভাসতে থাকেন।
সমস্যাসংকুল জার্মানিতে মহামন্দা 'বিষফোঁড়া' হয়ে দেখা দেয়। হিটলার এ সংকটের সহজ সমাধান বের করেন এবং বলির পাঠাও খুঁজে পান। দেশটির সকল দুর্দশার জন্য ইহুদি এবং কমিউনিস্টদের দায়ী করেন হিটলার।
নির্বাচনে জয়, হুমকি-ধমকি এবং রাজনৈতিক চালবাজির মধ্য দিয়ে ১৯৩৩-এ জার্মানির চ্যান্সেলর নিযুক্ত হলেন হিটলার। দ্রুতগতিতে তিনি সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন। জার্মানিতে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
কিন্তু হিটলারের উচ্চাভিলাষী যুদ্ধ ধ্বংস ডেকে আনে এবং তার পতনের কারণ হয়ে যায়। আর্য রক্তের শ্রেষ্ঠতার ঘোরে আচ্ছন্ন হিটলার মিথ্যা উছিলায় ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে পোল্যান্ডে আগ্রাসন চালান। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের দাবানল এভাবেই জ্বলে উঠল।
প্রথম দিকে সফলতা পেলেও ধীরে ধীরে যুদ্ধের গতি বদলে যেতে শুরু করল। এবারে জার্মানি হারতে শুরু করল। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মিত্র পক্ষে যোগ দিলে হিটলারবিরোধী মারাত্মক জোট গঠন করা হলো।
শুরুতে জার্মান মানুষ এ যুদ্ধের পক্ষে ছিল। কিন্তু যুদ্ধে হারার পালা সূচনা হলে এবং বিপর্যয় নেমে আসতে থাকলে জনমতও ঘুরে যায়।
১৯৪৫-এ মিত্রপক্ষ বার্লিন অবরোধ করার জন্য এগিয়ে আসে। পরাজয় নিশ্চিত টের পেয়ে হিটলার বাংকারে আত্মহত্যা করে। জার্মানি বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করে।
হিটলারের শাসনামলকে ইতিহাসের অন্যতম কালো অধ্যায় হিসেবে গণ্য করা হয়। ধুমকেতুর মতো তার উত্থান এবং মর্মান্তিক পতনের মধ্য দিয়ে উগ্রবাদ এবং নিয়ন্ত্রণহীন একচ্ছত্র ক্ষমতার বিপদ সম্পর্কে দুনিয়াকে হুঁশিয়ারি দিচ্ছে।
বেনিটো মুসোলিনি: স্পষ্টভাষী সাংবাদিক যখন একনায়ক
আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব এবং স্পষ্টভাষী সাংবাদিক বেনিটো মুসোলিনি প্রথম মহাযুদ্ধোত্তর ইতালিতে শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। ইউরোপীয় অন্যান্য দেশের মতোই ইতালিও অর্থনৈতিক সমস্যায় হাবুডুবু খাচ্ছিল। চলছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা। এ ছাড়া দেশটা হতাশা ও অপমান বোধের তাড়নায় ভুগছিল।
এদিকে সোশ্যালিস্ট মতবাদে মোহভঙ্গ হওয়ার পর ইতালিতে ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে ফ্যাসিস্ট পার্টি গঠন করেন। দলটি ইতালিবাসীকে শক্ত নেতৃত্ব গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দেয়। প্রতিশ্রুতি দেয় আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার। ইতালির জাতীয় গৌরব পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তারা।
১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে দলটি শক্তি প্রদর্শনের পরিকল্পনা নেয়। সুসংহত পরিকল্পনা মোতাবেক তারা 'মার্চ টু রোম'-এর ডাক দেয়। তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে হাজার হাজার ফ্যাসিস্ট সমর্থক ইতালির রাজধানীতে সমবেত নয়। এভাবে শক্তি প্রদর্শনের ফল প্রায় হাতে হাতে পান মুসোলিনি। রোম সরকার ভয় পায়। রাজা তৃতীয় ভিক্টর ইমানুয়েল এবারে মুসোলিনিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন।
একনায়ক বা এল দুচে হিসেবে মুসোলিনির রাজত্ব ১৯৪৩ পর্যন্ত চলে। কিন্তু নিজ নীতিমালা এবং জোট তাকে পতনের পথে ঠেলে দেয়।
মুসোলিনি সব ক্ষমতা নিজের হাতে কুক্ষিগত করেন। বিরোধীদের ওপর কঠোর দমন চালান। এবং একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। অর্থনৈতিক পুনর্গঠন এবং জাতীয় সমৃদ্ধিকে লক্ষ্যে নিয়ে নীতিমালা বাস্তবায়ন করেন তিনি। নাজি জার্মানির সাথে দহরম-মহরমের পরিণামে ইতালিকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জড়িয়ে ফেলেন। অক্ষ শক্তির পক্ষ নিলেন মুসোলিনি। এই সিদ্ধান্ত দেশটির জন্য মহা বিপর্যয় হয়ে দেখা দেয়।
উত্তর আফ্রিকাসহ অন্যান্য স্থানে ইতালির সেনাবাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে দেয় মিত্রপক্ষের সেনারা। এদিকে যুদ্ধ এবং মুসোলিনির নেতৃত্ব নিয়ে ইতালিবাসীর প্রত্যাশার অপমৃত্যু ঘটে।
১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে মুসোলিনিকে গ্রেপ্তার করা হয়। ইতালির রাজা তাকে বরখাস্ত করেন। কিন্তু জার্মান বাহিনী মুসোলিনিকে উদ্ধার করে। উত্তরা লীয় ইতালিতে পুতুল রাষ্ট্রের প্রধান বানানো হয়। তা-ও বেশি দিন টেকেনি।
মিত্রপক্ষের বিজয় অভিযানের মুখে মুসোলিনি এবং তার রক্ষিতাকে ইতালির মিত্ররা পাকড়াও করে। দুজনকেই হত্যা করে মিলানে লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়।
মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট বাহিনী নিষ্ঠুরতা, আগ্রাসন এবং শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতার প্রতীক হয়ে ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে। ফ্যাসিস্ট শব্দটি এখন গালাগালির স্তরে চলে এসেছে। অনেকের দৃষ্টিতে মহান পেশা সাংবাদিকতাও যে একনায়ক হওয়ার পথে বাধা হতে পারে না, তার অনন্য উদাহরণ মুসোলিনি।
জোসেফ স্তালিন: সোভিয়েত বিপ্লবী থেকে এক লাফে একনায়ক
জর্জিয়ান বিপ্লবী জোসেফ স্তালিন জন্মেছিলেন জোসেফ ভিসারিওনোভিচ ঝগাশভিলি হিসেবে। তরুণ বয়সেই বিপ্লবী তৎপরতায় যোগ দেন তিনি। ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে বলশেভিক পার্টির কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। নির্মম প্রকৃতি এবং সাংগঠনিক দক্ষতা দ্রুতই দলের মধ্যে তাকে বিশিষ্ট করে তোলে।
১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে লেনিনের মৃত্যুর পর অন্যান্য বলশেভিক নেতার সাথে ক্ষমতার লড়াইয়ে নামেন স্তালিন। অবশেষ বিজয়ীও হন। সাইবেরিয়াসহ নানা স্থানে নির্বাসন, কারাবাস বা হত্যা করে প্রতিদ্বন্দ্বীদের পুরোপুরিই নির্মূল করেন তিনি। এভাবেই ক্ষমতা সুসংহত করেছিলেন স্তালিন।
১৯২০-এর দশকের শেষ দিকে নিজেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের নিরঙ্কুশ শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন স্তালিন। সোভিয়েত নাগরিকের জীবনের সকল দিকে তার শাসনের জগদ্দল পাথর চেপে বসে। নিজেকে তিনি প্রায় দেবতার আসনে নিয়ে গিয়েছিলেন।
১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে এই নির্মম একনায়ক মারা যান। সম্ভবত স্ট্রোক ছিল তার মৃত্যুর কারণ। তার মৃত্যুর পর ক্ষমতার লড়াই শুরু হয়ে যায়। নিকিতা ক্রুশ্চেভ সে সময় সোভিয়েত নতুন নেতা হিসেবে বের হয়ে আসেন। তিনি স্তালিনের শাসনের সময় ঘটে যাওয়া অপরাধ এবং নীতিমালার তীব্র এবং প্রকাশ্য নিন্দা করা শুরু করেন। ধীরে ধীরে তিনি সরে আসেন স্তালিনবাদ থেকে। বলা হয়, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মানির হামলায় যত সোভিয়েত নাগরিক নিহত হয়েছে, তার থেকে বেশি প্রাণ হারিয়েছে স্তালিনের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে।
আগাস্টো পিনোশে: সামরিক কর্মকর্তা থেকে একনায়ক
সামরিক কর্মকর্তা আগাস্টো পিনোশে ১৯৭৩-এর ১১ সেপ্টেম্বর অভ্যুত্থান করে চিলির ক্ষমতায় বসেন। প্রেসিডেন্ট সালভাদর আলেন্দের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সমাজতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করেন।
আলেন্দের সরকারের আমলে চিলিকে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মুখে পড়তে হয়েছে। এর পরিস্থিতি সৃষ্টিতে মার্কিন মদদপুষ্ট পঞ্চম বাহিনী কলকাঠি নেড়েছে, বিশ্বাস করা হয়। দেশটির মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত ক্রমবর্ধমান বিরোধিতা তো ছিলই; সে সাথে সমাজতন্ত্রের রাস্তায় দেশটি হাঁটছে, তা-ও তাদের ভালো লাগেনি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে এক সামরিক অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন পিনোশে। অভ্যুত্থানের সময় আলেন্দে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদেই গুলিতে নিহত হন।
দেশটিতে সামরিক একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন পিনোশে। তার সরকার ১৯৯০ পর্যন্ত ক্ষমতায় টিকে ছিল। নির্যাতন, গুম এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যার লাগাম ছাড়া অজস্র ঘটনা এ সময়ে ঘটেছে। হাজার হাজার চিলিবাসী হয় নিহত, না হয় গুম হয়ে গেছে। অর্থনৈতিক সংস্কারের নামে নব্য উদারবাদী অর্থনৈতিক নীতি বাস্তবায়ন করেন তিনি। 'শিকাগো বয়েজ' নামে পরিচিত এই অর্থনৈতিক আদল (মডেল) অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি দেশটিতে বৈষম্য এবং দারিদ্র্য বাড়ায়।
চিলির জন্য নতুন সংবিধান রচনা করে পিনোশে একচ্ছত্র কর্তৃত্ব হাতিয়ে নেয়। সামরিক বাহিনী তার কবজায় রেখে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের দমন-পীড়ন চালান তিনি।
১৯৮০-এর দশক থেকে পিনোচেট সরকারের ওপর অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে থাকে।
অর্থনীতি উন্নয়নের রাস্তায় চললেও যথেচ্ছ মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং একনায়কের শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে চিলির মানুষ। ঘন ঘন বিক্ষোভ শোভাযাত্রা হতে থাকে দেশটিতে। মার্কিন মদদে সেনা অভ্যুত্থান ঘটালেও শেষে ওয়াশিংটন পিনোশে সরকারের পেছন থেকে সরে যায়।
১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে দেশটিতে ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হলে জনতা পিনোশে শাসন অবসানের জন্য ব্যাপক ভোট দেয়। এর মধ্য দিয়ে দেশটিতে গণতন্ত্রের প্রতি অভিযাত্রার সূচনা ঘটে। ১৯৯০ সালে পিনোশে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব থেকে ইস্তফা দেন। তবে একনায়ক থাকা সময়ের জন্য তার বিচার করা যাবে না বলে সুরক্ষা দেওয়া হয় তাকে।
চশেস্কুু: যে একনায়ককে স্ত্রীসহ ফায়ারিং স্কোয়াডে প্রাণ দিতে হয়
নিকোলাই চশেস্কু তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন কমিউনিস্ট সক্রিয়বাদী হিসেবে। ১৯৩০-এর দশকের কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রোমানিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির নানা স্তর টপকে যেতে থাকেন তিনি।
স্তালিনের মৃত্যুর পর চশেস্কু নিজেকে অনুগত এবং স্বতন্ত্র কমিউনিস্ট নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের মদদে রোমানিয়া কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদকের পদ বাগিয়ে নেন। ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দের ঘটনা। দুই বছরের মধ্যেই ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে রোমানিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির স্টেট কাউন্সিলের সভাপতির দায়িত্বও পেয়ে যান।
চশেস্কুর নীতিমালা রোমানিয়াকে অর্থনৈতিক স্থবিরতা এবং ব্যাপক দারিদ্র্যের পথে নিয়ে যায়। ১৯৮৯-এর প্রচণ্ড শীত এবং খাদ্যঘাটতি জনতার অসন্তোষকে উসকে দিল। টিমিসোয়ারা নগরে বিক্ষোভে ফেটে পড়ল মানুষ। সে বিক্ষোভের সংক্রমণ ঘটল অন্যান্য শহরেও, এমনকি গোটা রোমানিয়ায়।
চশেস্কু এবং তার স্ত্রী এলেনা চশেস্কুকে গ্রেপ্তার করে সামরিক আদালতে বিচার করা হয়। গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধসহ অন্যান্য অপরাধে তারা দোষী সাব্যস্ত হলেন। ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ ডিসেম্বর, ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের বড়দিনে রোমানিয়ার একনায়ক ও তার স্ত্রীর প্রাণদণ্ড কার্যকর করা হয়।
চশেস্কুর পতনের মধ্য দিয়ে কমিউনিস্ট শাসিত স্বাদহীন রোমানিয়ার জীবনে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার শুভযাত্রা শুরু হয়।
আলবার্তো ফুজিমোরো: অধ্যাপক হলেন একনায়ক
জাপানি বংশের পেরুর নাগরিক আলবার্তো ফুজিমোরোর জন্ম ২৮ জুলাই, ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে। তার মা-বাবা বৌদ্ধ ধর্মের হলেও তাকে ক্যাথলিক খ্রিষ্টান হিসেবে গড়ে তোলা হয়। রাজনীতিতে ঢোকার আগে কৃষি-প্রকৌশলবিদ ফুজিমোরো ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেখটর। অর্থনৈতিক সংকট এবং সন্ত্রাসবাদের প্রেক্ষাপটে পেরুর রাজনীতিবিদদের হারিয়ে দিয়ে ১৯৯০-এ দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হন। 'ফুজিশক' নামে পরিচিত উগ্র নব্য-উদারবাদ সংস্কারে নামে তার প্রশাসন। টালমাটাল অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার এই প্রয়াসকে সমর্থন করে পেরুর মানুষ। এ ছাড়া মাওবাদী শাইনিং পাথ এবং এমআরটিএ গেরিলাদের বিরুদ্ধে সামরিক কৌশল প্রয়োগ করেন। সহিংসতা কমে আসে ঠিকই; কিন্তু এ সময়ে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের কর্মকাণ্ড ঘটে।
১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে এসে নিজেই এক অভ্যুত্থান করেন ফুজিমোরো। পেরুর কংগ্রেস ভেঙে দেন। নিজের হাতে তুলে নেন সব ক্ষমতা। ধীরে ধীরে তার একনায়কত্বের স্বরূপ বিকটভাবে প্রকাশ পেতে থাকে। কঠোর নিষেধাজ্ঞা বা সেন্সরশিপ আরোপ এবং ডেথ স্কোয়াডের ব্যবহার শুরু করেন তিনি। এ সময়ে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠতে থাকে।
এ ছাড়া বলপূর্বক বন্ধ্যাকরণ এবং শাইনিং পাথের গেরিলা দমনের নামে কঠোর নির্যাতনের অভিযোগ উঠতে থাকে। এ ছাড়া অভিযোগ ওঠে নির্বাচনে জালিয়াতির। বিশেষ করে ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে তৃতীয় দফা নির্বাচনের পর এ অভিযোগ জোরালো হয়ে ওঠে। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং তহবিল তছরুপের অভিযোগ উঠতে থাকে।
তার উপদেষ্টা ভ্লাদিমিরো মোনটিসিনোসের দুর্নীতির কেলেঙ্কারির মুখে ২০০০ খ্রিষ্টাব্দের শেষ দিকে পেরু থেকে ব্রুনেই সফরে যান এবং সেখান থেকে টোকিওতে ভেগে যান। টোকিও থেকে ফ্যাক্সযোগে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে ইস্তফাপত্র দাখিল করেন। পেরুর কংগ্রেস তার এ পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেনি, বরং ৬২-৯ ভোটে তাকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করে। পরে জাপানে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন তিনি।
২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে তাকে চিলি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে তাকে পেরুতে ফিরিয়ে আনা হয়। মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম, খুন এবং দুর্নীতির দায়ে ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে তার বিচার হয়। বিচারে ফুজিমোরাকের ২৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। পেরুর ইতিহাসে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে স্বদেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের ঘটনা এই প্রথম। এর মধ্য দিয়ে দেশটিতে নজির স্থাপন করা হলো।
এ নজির ছড়িয়ে পড়ুক সবখানে। এমনটিই কামনা করবে একনায়কতন্ত্রের স্বাদহীন পরিবেশে জীবন কাটানো মানুষ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বৈরতন্ত্রের জোয়াল অপসারণ করে স্বাধীনতা পাওয়ার পর।