মৃত্যুর মিছিল
৩১.
এরপর আরো কিছু সময় কেটে গেল। পরদিন সকালে গ্রেচেন'স এ গেলে ওকে এড়িয়ে চলতে শুরু করল স্যান্ডি। বয়ষ্ক ওয়েটারদের একজন খাবার পরিবেশন করল ওকে। লিপস্টিকের দাগঅলা কাপে কফি এলো, বেকন পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। ডিম হিম ঠাণ্ডা। যা বোঝার বোঝা হয়ে গেল, এরপর থেকে বাড়িতেই নাশতা বানাতে শুরু করল ও। বারান্দায় একাকী বসে পাতার ঝরে পড়া দেখে। ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে দিনগুলো।
বারান্দায় একাকী প্রচুর সময় কাটাচ্ছে ও। স্যান্ডি আদৌ স্বেচ্ছায় ওর বাড়িতে এসেছিল কিনা, নাকি অন্য কারও পক্ষে শত্রু এলাকা রেকি করতে এসেছিল, বোঝার চেষ্টা করেছে।
নাকি, এটা একটা নির্বোধ শব্দ।
সাধারণ জীবন ওকে নরম করে দিচ্ছে না তো?
রনের সাথে আরেক দফা সাক্ষাৎ, এবার ডিসেম্বরে। ওকে জ্বালাতে থাকা একটা জিনিস তাকে জানিয়ে নিজেই অবাক হল ও।
'তুষারের ব্যাপারটা,' দুই হাঁটুর মাঝখানে হাত চেপে ধরে সামনে ঝুঁকে বলল ও। 'জানি শিগগিরই তুষার ঝরতে শুরু করবে। কিন্তু আমি চিরকাল তুষার ঘৃণা করি, বিশেষ করে...'
'বিশেষ করে কখন থেকে?'
'একটা কাজ করার পর থেকে,' বলল ও। ওই অল্প সময়ের মধ্যেই অনেক কিছু মনে পড়ে গেল।
আলীয়া।
'সার্বিয়ায়,' বলল ও।
'বলে যাও,' দুহাত এক করে মুখের সামনে একটা তাঁবু তৈরি করেছে সে।
'বলতে পারব কিনা নিশ্চিত নই আমি।'
জিজ্ঞাসার ঢঙে মাথা একপাশে এলাল রন। 'তুমি জানো আমার ক্লিয়ারেন্স আছে।'
গলা পরিষ্কার করে নিল তারিক। চোখজোড়া জ্বালা করছে। কচকচ করছে। 'জানি। ব্যাপারটা হলো..তুষার, রন।'
'বুঝলাম না,' বলল ও। 'রাতে কখনওই তুষারের বুকে রক্ত দেখেছ?'
লোকটার মনোযোগ কাড়তে পেরেছে বলে মনে হলো। 'না,' বলল সে। 'না, দেখিনি।'
'প্রথমে উষ্ণ থাকায় ভাপ ওঠে,' বলল ও। 'তারপর সত্যিকার অর্থে গাঢ়, প্রায় কালচে হয়ে যায়। কালচে তুষার, আমার কথা যদি বিশ্বাস করো। ব্যাপারটা চিরকাল তোমার মনে থেকে যায়।'
একটা মুহূর্ত অটল দৃষ্টিতে তারিকের দিকে তাকিয়ে থেকে সে বলল, 'ওখানে কি হয়েছিল?'
'ঠিকমতো হয়নি সবকিছু,' বলল ও। 'আরো চারজনকে সাথে নিয়ে গিয়েছিলাম। কেবল আমিই ফিরে এসেছি।'
'এনিয়ে আরও কথা বলতে চাও?'
আলীয়া।
'না।'
৩২.
রন ওকে স্বপ্নের কথা জিজ্ঞেস করায় কিছুটা রূঢ় হয়ে গেল ওর চোখমুখ, কাটাকাটা স্বরে বলল, অবশ্যই স্বপ্ন দেখে, কিন্তু সেসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। রনের ভুরু নাচানোর কায়দা দেখে মনে হলো, ও মিথ্যা বলছে ধরে নিয়েছে সে। কিন্তু এই একবারের জন্যে হলেও মিথ্যা বলেনি ও। স্বপ্ন নিয়ে বিলকুল মাথা ঘামায় না ও।
স্বপ্নের শেষ নেই। লাওসের নিকষ কালো শোরগোলময় রাত থেকে শুরু করে দুনিয়ার প্রতিটি মহাদেশে হয়ে - কেউ বিশ্বাস করুক বা না করুক অ্যান্টার্টিকাসহ, সেই কাহিনী ফাঁস হলে বিশেষ একজন সিনেটরকে মাশুল গুণতে হবে - শেষ হয়েছে মধ্য ইউরোপ আর সার্বিয়ায়। স্বপ্নগুলো বিচিত্র হলেও ধরনের বিচারে একই রকম: রক্তপাত, ফাঁদে পড়া, আগুয়ান শত্রুর সামনে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া এবং গোলাবারুদ ফুরিয়ে যাওয়ায় নিষ্ফল হাপিত্যেশ করা।
জেগে উঠে প্রথম কয়েকটা সেকেন্ড সবসময়ই কিছুটা বিভ্রান্ত থাকে ও, কিঞ্চিত বিচলিতও হয়তো, কিন্তু পিঠের নিচে কঠিন বিছানা আর বনের গাছপালার বুনো গন্ধের কল্যাণে খানিক পরেই শান্ত হয়ে আসে। স্বপ্ন মোটেই ঝামেলার ব্যাপার নয়। একটুও না। স্রেফ ও যে বেঁচে আছে, সেটাই মনে করিয়ে দেয়, ও ভয় পেতে পারে, শঙ্কিত হতে পারে। ওর কজন পুরোনো সতীর্থ কখনও স্বপ্ন না দেখার কথা বলে, ভয় কি জিনিস ওরা চেনে না; ওদের কখনো বুঝতে পারেনি ও।
সাধারণত দুঃস্বপ্ন দেখার পর মৃদু হেসে ফের ঘুমে তলিয়ে যায় ও। কারণ আরো একবার নিজেকে মানুষ প্রমাণ করেছে ও।
একদিন বিকেলে বাইরের পরিবেশ তখন আবছা হয়ে এসেছ। অফিসে রূপান্তরিত করা শোবার ঘরের ছোট খুপরিতে বসে আছে ও। নতুন কম্পিউটারটাকে চালু করার চেষ্টায় ব্যস্ত। দীর্ঘসময় ছোটার উপর থাকার পর নিজেকে আবার সাইবারস্পেসের সাথে সংযুক্ত করার চিন্তায় কৌতূহলী। এখন আর ঘুরে বেড়ানোর মতো মানসিক অবস্থা নেই ওর, তবে সহজাত কৌতূহল আর মেজাজ জানিয়ে দিচ্ছে এখনো সবকিছু জানতে ইচ্ছুক ও, এমনকি সেটা কম্পিউটার আর সাইবার অপটিক কেবলের মারফত হলেও।
সবকিছু ঠিকঠাক গুঞ্জন শুরু করার পর চট করে গলায় কিছু ঢালবে বলে নিচে নেমে এলো ও। বাইরে তাকিয়ে তুষার পাত নজরে পড়ল। প্রবল হাওয়ায় অলস ভঙ্গিতে ভাসতে ভাসতে জমিনে নেমে আসছে বড়বড় পুরু শাদা তুষারকণাগুলো।
ড্রিঙ্কের কথা ভুলে গিয়ে বারান্দায় এসে নিখাদ শাদা বিস্তারের দিকে তাকাল ও। তুষারে ঢেকে যাওয়া ফাঁকা ডালপালা আর ঝোপঝাড় গেছে, লেকের জমাট বাঁধা পানি। তুষারের কারণে লেকের খুব বেশি অংশ দেখা যাচ্ছে না। তবে যতটুকু চোখে পড়ছে, অপূর্ব ওখানে দাঁড়িয়ে জমে ওঠা শাদা চাদরের দিকে তাকিয়ে রইল ও। কোত্থাও কালচে তুষার চোখে পড়ছে না।
আপাতত।
৩৩.
তুষার ঝড়ের দুই দিন পর লেক মেরির জমাট বাঁধা জলে বেরিয়ে এসেছে তারিক। জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে, ঘামাচ্ছে, প্রতিটি সেকেন্ড উপভোগ করছে। আগের দিন গাড়ি নিয়ে ম্যানচেস্টার গিয়েছিল ও। খেলাধুলার সামগ্রীর দোকান থেকে একজোড়া ক্রসকান্ট্রি স্কি কিনেছে। পাতলা বরফে কিভাবে চলতে হয় তার সবক নেয়া আছে ওর। পুরোনো বিদ্যা বেশ দ্রুত মনে পড়ে যাওয়ায় অবাক হয়েছে ও। বাতাস করকরে, তাজা; আকাশটা এত নীল, মনে হচ্ছে এখনই বুঝি তুলির আঁচড় চোখে পড়বে। বেশ অনেকটা আগে বেড়ে পেছনে তাকাল ও। প্রথমবারের মতো লেকের মাঝখান থেকে নিজের বাড়িটা দেখতে পাচ্ছে। দৃশ্যটা ভালো লাগছে। কতগুলো শাদা বার্চগাছের জটলার আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে ওটা। ওটার শাদা রঙ আর শাদামাটা গঠন দেখে বিশেষ কোনো কারণ ছাড়াই মুখে হাসি ফুটে উঠল ওর।
ঘুরে দাঁড়াল ও, ফের স্কি শুরু করল। তুষারের উপর একটা ট্রেইল তৈরি করে বিশেষ ছন্দে চলছে ও। ওর কানে কোনো শব্দ আসছে না। কেবল দূরের প্লেনের মৃদু গুঞ্জন। ওর সামনে তুষারের বুকে সাইনবোর্ড আর কমলা রংয়ের দড়ি বসিয়ে লেকের মাঝামাঝি জায়গার কাছে বৃত্তাকার একটা এলাকা ঘিরে রাখা।
সবগুলো সাইনে একই কথা লেখা: বিপজ্জনক! পাতলা বরফ! থেমে গ্রেচেন'স কিচেনে খাওয়া সারার সময় বলা সেই বুড়োর কথাগুলো মনে করল ও। লেকের তলা দিয়ে বয়ে যাওয়া লুকোনো ধারা কিংবা এই ধরনের কিছু এমনকি শীতলতম আবহাওয়ায়ও লেকের মাঝখানের বরফ কাগজের মতো পাতলা রাখে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিল ও, বরফ থেকে উঠে আসা ক্ষীণ করকর শব্দ কানে আসছে। হঠাৎ শিউরে উঠল ও। ঘরে ফেরার সময় হয়েছে।
বাড়ির কাছাকাছি অর্ধেকটা পথ পেরিয়ে এসেছে, তখনই ঘটল ব্যাপারটা।
প্রথমে খুবই ক্ষীণ গুঞ্জনধনি। প্লেনের শব্দ বলেই ধরে নিয়েছিল ও। তারপর ক্রমেই জোরালো হয়ে উঠতে লাগল শব্দটা। স্পষ্ট এবং আলাদা করে চেনা যাচ্ছে এখন।
এঞ্জিন।
বেশ কয়েকটা। ঘুরে তাকাল ও। বন ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো ওরা, তুষারের বুকে প্রবল বেগে ধেয়ে আসছে। অন্তত আধ ডজন স্নোমোবাইল সোজা ওর দিকে ধেয়ে আসছে।
অস্ত্রের জন্যে এমন আফসোস হচ্ছে যে, মুখের ভেতরটা রীতিমতো তেতো ঠেকছে।
ফের ঘুরে দাঁড়াল ও, গতি বজায় রাখার চেষ্টা করে আগুয়ান এঞ্জিনগুলোর ক্রমবর্ধমান শব্দের নাগালের বাইরে চলে যেতে চাইছে। মেরুদ- বেয়ে শিরশিরে একটা অনুভূতি করোটির নিচে ছড়িয়ে পড়ছে। ওকে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার মুহূর্তে জোরালো আওয়াজ যেন বিস্ফোরিত হলো।
এমনকি এঞ্জিনের গর্জন সত্ত্বেও স্নোমোবাইলগুলো সাঁই করে পাশ কাটানোর সময় ওদের উন্মত্ত চিৎকার কানে এলো। তুষারের ছিটে ছুটে এলো ওর দিকে। প্রত্যেকটা মেশিনে দুজন করে লোক। দেখে মানুষের মতোই মনে হচ্ছে। প্রত্যেকের পরনে বড় আকারের যিপ লাগানো জাম্পস্যুট, ভারী বুট এবং প্যাডেড মোটরসাইকেল ক্র্যাশ হেলমেট। ওকে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার একটু বাদেই ফের চক্কর মেরে ধেয়ে আসতে লাগল ওরা। এবার ওরা পাশ কাটানোর সময় কুকড়ে গেল ও। তাতে মোটেই গর্ব হলো না ওর - কিন্তু এঞ্জিনের আওয়াজ ভীষণ চড়া, প্র্রত্যেকটা বাহনের হেডলাাইট জ্বলছে। এবার গোটা দুই খালি বিয়রের ক্যান ছুঁড়ে মারা হলো ওর দিকে।
তৃতীয় দফা চক্করের পর বাড়ির বেশ কাছে এসে গেল ও। ওর কানে স্নোমোবাইল মেশিনের গর্জনের সাথে করোটির ভেতরের গর্জন পাল্লা দিচ্ছে। ব্যাপারটা চুকে গেছে ভাবছে যখন, হঠাৎ একটা স্নোমোবাইল বাকিগুলো থেকে আলাদা হয়ে সোজা ওর দিকে তেড়ে এলো। আনুমানিক পঞ্চাশ ফুট দূরে আছে ওটা।
ওটার ড্রাইভার এমনভাবে ঘুরল, যার ফলে মেশিনটা আড়াআড়ি পড়ল ওর সামনে। চালক লোকটা সিটে বসে ওর দিকে তাকিয়ে থ্রটল ঘোরাতে লাগল। পেছনে বসে আছে তার সঙ্গী। এবার দুইহাতে হেলমেট খুলে হিংস্র চেহারা আর পুরু গোঁফ দেখাল সে।
কয়েক মাস আগেও লোকটাকে দেখেছে ও, চিনতে পারল। ওর বাড়ির কাছে পাওয়ার বোট নিয়ে এসেছিল সে। হেলমেটটা নারী সঙ্গীর হাতে তুলে দিয়ে স্নোমোবাইল থেকে নামল লোকটা, সামনের যিপার টেনে নামাল। মাত্র একটা মুহূর্ত, ধোঁয়া ওঠা পেশাবে বরফের বুকে দীর্ঘ একটা রেখা আঁকল। তারপর কাপড় ঠিক করে মেশিনের কাছে ফিরে সবেগে বিদায় নিল। অন্য স্নোমোবাইলারদের কণ্ঠে হাসির হররা উঠল।
নোংরা বরফের উপর স্কি করে সময় নিয়ে তুষার ছাওয়া লেকের কিনারা বেয়ে উঠে এলো ও। স্কি আর খুটিগুলো অস্ত্রের মতো কাঁধে ফেলে ঘরে ঢুকল। রণক্ষেত্রে পরাস্ত সৈনিকের মতো লাগছে নিজেকে।
এই অনুভূতি ঘৃণা করে ও।
৩৪
এর পর থেকে রোজ রাতেই ফিরে আসতে শুরু করল ওরা। এঞ্জিনের গুমগুম, অট্টহাসি, মাতালামির হুল্লোড়ের সাথে পোর্টেবল সাউন্ডসিস্টেম থেকে ছড়িয়ে পড়া গানের শব্দ মিশে গিয়ে রাতের নিস্তব্ধতা খানখান হয়ে যাচ্ছে। হর রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে ওদের ফেলে যাওয়া আবর্জনা সাফ করছে ও, নোংরা দাগের উপর তাজা তুষার ছিটাচ্ছে। তারপর ঘরের নিরিবিলি পরিবেশে অবিরাম উত্তেজিত অবস্থায় আবিষ্কার করছে নিজেকে, সারাক্ষণ অকস্মাৎ এঞ্জিনের শব্দ ফিরে এসে দিনটা বরবাদ করে দেয়ার আশঙ্কায় থাকছে।
পুলিস ডিপার্টমেন্টে আরও বার দুই ফোন করেছে ও। ওর জানা বিষয়ই ফের নিশ্চিত করেছে টাউন হল। আবর্জনা রেখে যাওয়ার ব্যাপারটা বাদে অন্য কোনো আইন ভাঙা হচ্ছে না।
বিশেষভাবে শোরগোলময় এক রাতে নিজের কাছে করা ওয়াদা ভেঙে ছোট, স্যাঁতসেঁতে সেলারে নেমে এলো ও। সবুজ ধাতব বাক্সের কম্বিনেশন লক খুলে একটা পিস্তল বের করে আবার ঘেরাও করা বারান্দায় ফিরে এলো। বাতি নিভিয়ে নাইট ভিশন স্কোপ চোখে লাগিয়ে নিচের দৃশ্যের দিকে চোখ রাখল ও।
তুষার ঢাকা বরফে ছয়টা স্নোমোবাইল বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে আছে। ওগুলোর মাঝখানে আগুন জ্বলছে। বরফের উপর হোঁচট খেয়ে হাঁটাহাঁটি করছে লোকজন। কথা বলছে, হাসছে। এদিক ওদিক বিয়ারের খালি ক্যান ছুড়ে মারছে। দুটো স্নোমোবাইলের সিটের উপর পোর্টেবল স্টেরিও রাখা। গমগম আওয়াজ তুলে বাজনা বাজছে, বরফের বুকে ঠিকরে গিয়ে বারবার প্রতিধ্বনি তুলছে। লেক মেরি এই অঞ্চলের অন্যতম বিশাল জলধারা হলেও সবসময় ওর জানালার নিচেই ক্যাম্প করছে ওরা।
ফুর্তি চালিয়ে গেল ওরা। কিছুক্ষণ জরিপ করল ও। এমনকি ওদের দুজন বরফের বুকে কালো দুটি অবয়ব মারপিট শুরু করলেও ব্যাপারটা যেন ভয়াবহ নিত্যকার রুটিনে পরিণত হতে চলেছে বলে মনে হচ্ছে ওর। আরো হল্লা, অট্টহাসি, তারপর লড়াই শেষ হয়ে গেল। কেউ একজন আরো চড়িয়ে দিল স্টেরিওর আওয়াজ। দুম, দুম, দুম।
নাইট ভিশন স্কোপের সুইচ অফ করে সেলারের বাক্সে তুলে রাখল। তারপর শুয়ে পড়ল। কানে হলদে রংয়ের রাবারের ইয়ারপ্লাগ লাগানো, তবু করোটির ভেতরে যেন ধনিত হচ্ছে গানের চড়া আওয়াজ। বালিশটা মুখের উপর চেপে ধরল ও। মনের ভেতর থেকে উচ্চারিত ফিসফিসানি উপেক্ষা করার চেষ্টা করছে। এসবের সাথে মানিয়ে নিতে বলছে ওই কণ্ঠটা। বলছে সারা শীত জুড়েই চলবে এমন: এই শোরগোল, আবর্জনা পাহাড় আর মদমত্ততা। বসন্ত কাল এলে স্নোমোবাইল তুলে রেখে নৌকা বের করবে ওরা। তারপর গোটা গ্রীষ্মকালও থাকবে ওখানে।
ওইসব ফিসফিসানি অগ্রাহ্য করার চেষ্টার পাশাপাশি সেলারে ফিরে গিয়ে থাতব বাক্সটার তালা খুলতে তাগিদ দিয়ে চলা কণ্ঠস্বরটাকেও উপেক্ষা করার চেষ্টা করল ও।
দুম, দুম, দুম।
৩৫.
রনের সঙ্গে একটা সেশনে কয়েক মিনিট আবহাওয়ার হালচাল নিয়ে হালকা আলাপসালাপ করল ওরা। কিন্তু তারপর কষ্টকর নরীবরতা নেমে এলো। শেষমেশ তীক্ষ চোখে ওর দিকে তাকাল রন। 'বলো দেখি, কি সমস্যা?'
মনে মনে বলার মতো একগাদা বানোয়াট কাহিনী উল্টেপাল্টে দেখল তারিক। তারপর মোটামুটি সত্যির কাছাকাছি একটা কিছু বলবে বলেই ঠিক করল। 'আসলে ঠিক মানিয়ে উঠতে পারছি না, ব্যস।'
'কিসের সাথে মানাতে পারছ না?'
'নিজের বাড়ির সাথে,' হাতজোড়া সামনে এক করে বলল ও। 'এমন কথা বলতে হবে, কখনো ভাবিনি, কিন্তু জীবনে এই প্রথম কোথাও থিতু হতে যাচ্ছিলাম। তুমি কখনও মিলিটারিতে ছিলে, রন?'
'না, কিন্তু আমি জানি -'
হাত তুলে ওকে বাধা দিল ও। 'হ্যাঁ। জানি তুমি কি বলতে যাচ্ছ। তুমি কনসালটেন্ট হিসাব কাজ করেছ, আমাদের সাথে বিভিন্ন জায়গায় গেছ, বক্তৃতা দিয়েছ, কিন্তু কখনোই আমাদের কেউ ছিলে না, রন। কখনো না। আসলে ব্যাপারটা কেমন কোনোদিন জানতে পারবে না তুমি। সারাক্ষণ হুকুমের ভেতর থাকা; তোমাকে একটা জায়গায় যেতে বলে দেয়া হচ্ছে, কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আবার সবকিছু ছেড়ে এক সপ্তাহের মধ্যে দুনিয়ার আরেক প্রান্তে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি আর পরিবেশে লোকজনের ভেতর গিয়ে থাকতে বলা হচ্ছে। আসলে সত্যিকার অর্থে থিতু হওয়ার কোনো জো থাকে না, বাড়ি বলার মতো কোনো জায়গা হয়ে ওঠে না।'
কালো চামড়ার চেয়ারে একটা পাক খেল রন। 'কিন্তু এখন তো আর সে অবস্থা নেই।'
'তা ঠিক,' বলল ও। 'জীবনে এই প্রথম নিজের বলার মতো একটা জায়গা আছে আমার।'
পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল ওরা। কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল। তারপর রন বলল, 'কিন্তু একটা কিছু সমস্যা হচ্ছে।'
'অবশ্যই হচ্ছে।'
'বলো আমাকে।'
কিন্তু তখনই ও বুঝতে পারল, ওসব কথা বলা যাবে না। অন্তত পুরোটা তো নয়ই। রনের সাথে ওর সেশন এবং ওর বাড়ির ঘটনাপ্রবাহের মাঝখানে একটা ফায়ারওয়াল খাড়া করা হয়েছে। ওকে সত্যি ঘটনা জানালে ব্যাটা বিশেষ একটা রিপোর্ট করবে। তারপর এক সপ্তাহের মধ্যে অন্য কোথাও যেতে বলে দেয়া হবে ওকে। বয়স আরও কম থাকলে আর মাসিক চেকের উপর অতটা নির্ভর করতে না হলে ঠিক রুখে দাঁড়াত ও।
কিন্তু এখন লড়াইয়ের উপায় নেই। এক মুহূর্তের জন্যে অন্যদিকে তাকাল ও। 'সমস্যাটা মনে হয় অভ্যস্ত হতে না পারার,' বলল তারপর।
'সাধারণ মানুষের জীবনে অভ্যস্ত না হতে পারা?'
'তারচেয়ে বেশি কিছু,' বলল ও। 'নানসেনের জীবনের সাথে খাপ খাওয়ানো। এটা দারুণ একটা শহর। কিন্তু...এখনও নিজেকে কেমন যেন বহিরাগত বলেই মনে হয়।'
'এমন কিছুই তো আশা করার কথা।'
'ঠিক, কিন্তু আমার পছন্দ হচ্ছে না। জানি, ঠিক হতে বেশ খানিকটা সময় লাগবে, কিন্তু...বেশ, আমার কি মনে হয়, আরো ভালোভাবে মিশতে পারলে ভালো হতো। ব্যস। লোকজন কিভাবে যেন আমার দিকে তাকায়, আলপটকা মন্তব্য করে। এড়িয়ে যায়।'
মনে হলো সতর্কতার সাথে শব্দ চয়ন করছে রন। 'সেটা কি বড় ধরনের সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে?'
এক মুহূর্তও দ্বিধা করল না ও, সরাসরি মিথ্যা কথা বলে বসল: 'না, মোটেই না।'
'তা এব্যাপারে কি করবে বলে ভাবছ?'
নিরীহ ভঙ্গিতে কাঁধে ঝাঁকাল ও। 'তেমন কিছু না। ¯্রফে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করব। ভালো পড়শী হওয়ার চেষ্টা করব।'
'ব্যস?'
জোরের সাথে মাথা দোলাল ও। 'ব্যস।'
৩৬.
কিছু তত্ত্বতালাশ করার দরকার হলেও শেষতক ওর এলাকায় চিহ্ন রেখে যাওয়া গুঁফোর পরিচয় বের করে ফেলল ও। জেরি টম্পকিন্স। ম্যানচেস্টারের বাইরে এক কম্পিউটার প্রতিষ্ঠানে ফ্লোর সুপারভাইজরের কাজ করে সে। বিবাহিত, তিন ছেলেমেয়ের বাপ। সারাক্ষণ নৌকা, স্নোমোবাইল নিয়ে মেতে থাকে; দক্ষ শিকারী, সবমিলিয়ে আড্ডাবাজ ধরনের মানুষ। কয়েক প্রজন্ম ধরে নানসেনে বাস করছে ওর পরিবার। শহরের হর্তাকর্তা বিধাতাদের একজন ওর বাবা।
পুরোনো গোটা দুই কায়দা কাজে লাগিয়ে তার হদিস বের করে ফেলল ও। একদিন বিকেলে চারপাশ অন্ধকার হয়ে এলে নানসেনের বাইরে পিটার'স পাব নামে এক ট্যাভার্নের তুষারঢাকা পার্কিংয়ে তার ট্রাকের পাশে ট্রাক থামাল ও। ওটার জানালাগুলোয় গরাদ লাগানো, অন্ধকার।
লোকটা ট্রাক থেকে বেরিয়ে পাবের দিকে পা বাড়াতেই বেরিয়ে এলো ও। তাকে উদ্দেশ করে হাঁক দিল। ঘুরে তাকিয়ে চোখ রাঙাল সে। 'কি হয়েছে?'
'তুমি জেরি টম্পকিন্স না?'
'আলবত,' বলল সে। সবুজ পার্কার পকেটে হাত ঢুকিয়ে রেখেছে। 'আর তুমি তো গেরিশদের ওখানে থাকছ।'
'হ্যাঁ। তোমার সাথে একটা মিনিট একটু কথা বলতে চাই,' বলল তারিক।
লোকটার চেহারায় এক ধরনের রুক্ষতা, বেশিরভাগ সময় বাইরে হাওয়া-বাতাস আর বৃষ্টিতে কাটানোর পাশাপাশি সমান হারে ঘরের ভেতর বিয়র আর সিগারেট নিয়ে পল্লীগীতি শুনলে এমন হতে পারে। মুখে মৃদু হাসি নিয়ে হালকা চাল ফিরে এলো সে। 'বলে ফেল। কি বলতে চাও।'
'ধন্যবাদ,' বলল ও। 'কি জানো, জেরি, আমি একটা জিনিস খুঁজছি।'
'তা কি সেটা?'
'শান্তি চুক্তির খোঁজ করছি আমি।'
চোখ সরু করে মাথা দোলাল সে। 'কি ধরনের চুক্তি, শুনি?'
'শান্তি চুক্তি। আমার বাড়ির আশপাশে স্নোমোবাইল পার্টিগুলো বাদ দাও, আমার ড্রাইভওয়েতে আর আবর্জনা ফেল না, বেনামী ফোনও করো না। এসো, নতুন করে শুরু করা যাক। আমরা যে যার মতো থাকি। তুমি কি বল? তারপর গ্রীষ্ম কালে চড়–ইভাতির জন্যে আমার ওখানে আসতে পারো। দরকার হলে আমিই বিয়রের ব্যবস্থা করব।'
চিবুকের খোঁচা-খোঁচা দাড়ি চুলকাল সে। 'একতরফা চুক্তি বলে মালুম হচ্ছে। এখান থেকে আমার কি ফায়দা হবে ঠিক বুঝতে পারছি না।'
'এখন যেসব করছ তার যুক্তিটা কি?'
চকিত হাসি খেলে গেল তার মুখে। 'আমার ভালো লাগে, ব্যস।'
মেজাজ ঠিক রাখতে পারবে না বলে মনে হলো তারিকের। 'তুমি শান্তিচুক্তিতে সায় দিলে আমরা সবাই জিতব।'
'তবু আমার ফায়দা কোথায় বুঝছি না,' বলল সে।
'শান্তিচুক্তির উদ্দেশ্যই তাই,' বলল ও। 'শান্তি পাবে তুমি।'
'আমার কাছে তো এখনই বেশ শান্তিপূর্ণ মনে হচ্ছে।'
'সেটা বদলে যেতে পারে,' বলেই বুঝল ঠিক হয়নি।
চোখজোড়া গভীর হয়ে এলো তার। 'হুমকি দিচ্ছ?'
এখানে আসার সময় নিজের সাথে করা ওয়াদার কথা ভেবে কিঞ্চিৎ পিছু হটল তারিক। 'নাহ, মোটেই হুমকি দিচ্ছি না, জেরি। তোমার কি মত?'
কিছুই না বলে ঘুরে চলে গেল সে। মাথা ঘুরিয়ে ওর দিকে এক নজর তাকাল ওর দিকে। 'তোমার এক মিনিট অনেক আগেই ফুরিয়ে গেছে, দোস্ত। এক মিনিটের মধ্যে এখান থেকে বিদায় নিলেই ভালো করবে, নইলে আমি ভেতরে গিয়ে আমার সব বন্ধুদের নিয়ে ফিরে আসব। তোমার ভালো লাগবে না।'
উঁহু, ভালো লাগবে না। তবে তোমার যেমন মনে হয়, সেটা কারণ নয়।
ওরা বেরিয়ে এলে পুরোনো স্বভাব আর পুরোনো কাজে ফিরতে বাধ্য হবে ও। কিন্তু নিজের সাথে তেমন কিছু না করারই ওয়াদা করেছে। তাই পারবে না।
'আমার কথা তুমি শুনেছ, জেরি,' বলল ও। পিছিয়ে এলো। 'কথাটা একটু মনে রেখ, জেরি। সবসময়।'
'কি সেটা?'
'শান্তিচুক্তির কথা,' বলল ও। পিকআপ ট্রাকের দরজার দিকে ফিরে গেল। 'যে কথা বলছিলাম।'
- [চলবে]