রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সমস্যার ভিত্তিমূল অনেক গভীরে
পৃথিবীতে বসবাসরত যে সম্প্রদায়গুলোর ইতিহাস অনুসন্ধান বেশ কঠিন তেমনই একটা সম্প্রদায়ের নাম রোহিঙ্গা। ২০১৩ সালে জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের বিশ্বের অন্যতম নিগৃহীত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী হিসেবে উল্লেখ করেছে। ঐতিহাসিকভাবে রোহিঙ্গাদের আরাকানী ভারতীয়ও বলা হয়ে থাকে। রোহিঙ্গা হলো পশ্চিম মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের একটি রাষ্ট্রবিহীন ইন্দো-আর্য জনগোষ্ঠী।
আরবদের আগমনের মধ্য দিয়ে আরাকানে বসবাস শুরু হয়। আরব বংশোদ্ভুত এই জনগোষ্ঠী মধ্য আরাকানের নিকটবর্তী ম্রক-ইউ এবং কাইয়্যুকতাওয়ে বসবাস করতে পছন্দ করতো। এই অঞ্চলের জনপদে বসবাসরতরাই পরবর্তীকালে রোহিঙ্গা নামে পরিচিতি লাভ করে। ধর্ম পরিচয়ে এরা আরব ও ভারতীয় ধর্মের অনুসারি। হিন্দু ও মুসলিম উভয় ধর্মের উপস্থিতি আছে এই সম্প্রদায়ে।
১৭৮৫ সালে বর্মিরা আরাকান দখল করে। ১৮২৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বার্মা দখল করে। কৃষিকাজের জন্য আরাকানের কম জন-অধ্যুষিত এবং উর্বর উপত্যকায় আশপাশের এলাকা থেকে দরিদ্র অধিবাসীদের অভিবাসন করার নীতি গ্রহণ করেছিল ব্রিটিশরা। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলাকে আরাকান পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিল।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বার্মা দখলের পর ব্যাপকভাবে আফিম চাষ শুরু করে। আফিম চাষের প্রয়োজনে আশেপাশের হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীকে উচ্চ আয়ের প্রলোভন আর দাস ব্যবস্থার সহায়তায় অভিবাসী বানায় এই রাখাইনে। যে কারণে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে রাখাইন রোহিঙ্গাদের গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত রাখাইনের এই রোহিঙ্গা সম্প্রদায়। এর পরে আছে ফিলিস্তিনি ও কাশ্মীরিরা। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এই তিন ভুখন্ডের মুল সমস্যার সাথে বৃটিশ উপনিবেশিকতার গভীর সম্পর্ক। বিংশ শতাব্দীর বৃটিশ ঔপনিবেশিকতার পরিণাম এই তিন ভুখন্ডের আজকের সংকট। অষ্টাদশ শতাব্দীতে বিশ্বের এই তিন ভূখন্ডের দুটি বার্মা এবং ফিলিস্তিন ছিল বৃটিশ ঔপনিবেশ আর কাশ্মীর ছিল বৃটিশ নিয়ন্ত্রীত রাজা শাসিত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানিরা বার্মা আক্রমণ করে। বার্মায় আন সান সুচির বাবা জেনারেল আন সান তখন বৃটিশ বিরোধী অবস্থান নিয়েছিলেন। রাখাইনের রোহিঙ্গারা বৃটিশদের পক্ষ অবলম্বন করে। সেই সময় থেকে শুরু হয় বার্মিজ জাতীয়তাবাদের সাথে রোহিঙ্গা জাতীয়তাবাদের সংকট। ১৯৪৩ সালে জাপানী সম্রাট আন সানকে জাপানের জাতীয় পদবীতে ভুষিত করে। জাপান পরবর্তীতে আন সানদের বার্মার স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখায়। আন সানদের জাপানের পক্ষ নেবার কারণে বৃটিশ সেনাবাহিনী পিছু হঠতে বাধ্য হয়। যা ছিল বৃটিশদের পশ্চাৎপসারনের প্রথম ইতিহাস।
অন্যদিকে বার্মার ইতিহাসের পাতায় বৃটিশ ইন্ডিয়ার নানান স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রভাব পরে বহু বার্মিজ সম্প্রদায়ের ওপর। কিন্তু রোহিঙ্গা নেতাদের প্রলোভন দেখানো হয় স্বায়াত্বশাসনের। বৃটিশ স্বায়ত্বশাসনের প্রলোভনে পড়ে রোহিঙ্গারা বৃটিশদের সহায়তায় লিপ্ত হয়। এদিকে ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টির সময় রোহিঙ্গারা মুসলীম লীগের নেতা জিন্নাহের সাথে একাধিক বৈঠক করে পাকিস্তানের সাথে থাকার ইচ্ছা ব্যক্ত করে। তাদের এই উদ্যোগ আরাকানের অন্য জাতিগোষ্ঠিরা মেনে নিতে পারে নি। তাদের কপালে "বেঈমান" তকমা লেগে যায়। এদিকে জিন্নাহ রোহিঙ্গাদের প্রস্তাবে অস্বীকৃতি জানান। তখন তারা নিজেরাই রোহিঙ্গা মুসলিম পার্টি গঠন করে আরাকান স্বাধীন করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে। ফলে বার্মার স্বাধীনতা আন্দোলনের মুল ধারা থেকে রোহিঙ্গারা বিছিন্ন হয়ে পড়ে। স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে বার্মিজ বৌদ্ধ ধর্মীয়গোষ্ঠী।
রাখাইনের রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের সাথে বার্মিজ বৌদ্ধ ধর্মীয়গোষ্ঠির স্বতন্ত্র সংঘাত শুরু হয় বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। রোহিঙ্গারা আরবি বর্ণমালায় নতুন ভাষার জন্ম দেয়। রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের সাথে বর্মিজ বৌদ্ধদের সংকট আরও বৃদ্ধি পায় বার্মিজ সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের যোগ না দেয়ায়।
বিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে গড়ে ওঠা রোহিঙ্গা আর বৌদ্ধ ধর্মীয়গোষ্ঠির মধ্যকার সংকটের প্রেক্ষিতে মিয়ানমারের সামরিক চক্র ১৯৮২ সালে তাদের সংবিধান পরিবর্তন করে এবং রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের নাগরিকত্ব বাতিল করে দেয়। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্যমতে, ১৯৮২ সালের আইনে "রোহিঙ্গাদের জাতীয়তা অর্জনের সম্ভাবনা কার্যকরভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। ৮ম শতাব্দী পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের ইতিহাসের সন্ধান পাওয়া সত্ত্বেও, বার্মার আইন এই সংখ্যালঘু নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীকে তাদের জাতীয় নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করছে। এছাড়াও তাদের আন্দোলনের স্বাধীনতা, রাষ্ট্রীয় শিক্ষা এবং সরকারি চাকুরীর ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ হলো, তারা রাখাইনে স্বাধীনতা দাবী করে। রোহিঙ্গা সম্প্রদায় অস্ত্রধারন করে বার্মিজ সেনা বাহিনীর বিরুদ্ধে। ধারনা করা হয় প্রতিবেশী বৃহৎ শক্তি ছিল এই অস্ত্রের উৎস। সেই সময় থেকেই বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যা মোকাবেলা করছে। যখনই রাখাইনে রোহিঙ্গা লিবারেশন আর্মি স্থানীয় বৌদ্ধ বসতি কিংবা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর উপর আক্রমন করে তারই প্রতিক্রিয়ায় পাল্টা আক্রমনের শিকার হয় সাধারণ বেসামরিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। এমন ঘটনার বড় অধ্যায় সৃষ্টি হয় ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে। রোহিঙ্গা গ্রামগুলোর অর্ধেকের বেশি সংখ্যায় তিনশতের কাছাকাছি, মায়ানমার পুরোপুরি তাদের দেশ থেকে রোহিঙ্গাদের বিতড়িত করতে চায়। ২০০৮ সালের সংবিধান অনুসারে, মায়ানমারের সেনাবাহিনী এখনো সরকারের অধিকাংশ বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে থাকে যার মধ্যে অন্তুর্ভূক্ত রয়েছে স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও সীমান্ত বিষয়ক মন্ত্রণালয়। সেনাবাহিনীর জন্য সংসদে ২৫% আসন বরাদ্দ রয়েছে এবং তাদের মধ্য থেকে একজন উপ-রাষ্ট্রপতি থাকবেন। রাখাইনের সমুদ্র পথ আর বাংলাদেশে প্রবেশ করা রোহিঙ্গা সংখ্যা এখন প্রায় ২৬ লক্ষ, যার অর্ধেকই বাংলাদেশে।
রোহিঙ্গা সমস্যার এই সংকট বহুকালের। কিন্তু আমাদের 'রক্তের বন্ধু' ভারত কিংবা 'অর্থের বন্ধু' চীন কোনদিন স্পষ্ট কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির এই সমস্যা তীব্র আকার ধারন করে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট। রাখাইন লিবারেশন আর্মী যখন ১০টি থানা আক্রমন করে তখন। পরের দিন থেকে মিয়ানমারের জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধ ধর্মগোষ্ঠি ও সেনাবাহিনী যৌথভাবে ২৭০টি রোহিঙ্গা গ্রামে অগ্নি সংযোগ করে। এবং প্রায় ৬৭০০ রোহিঙ্গা নারী পুরুষ ও দুই শতাধিক শিশুকে হত্যা করে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তথা জাতিসংঘ নামক ক্ষমতাবানদের 'ক্লাব' রোহিঙ্গা সমস্যা ফিলিস্তিন কিংবা কাশ্মীরের মতই দীর্ঘ স্থায়ী রূপ দেওয়ার পথে হাঁটছে। ফিলিস্তিন, রাখাইন ও কাশ্মীর এই তিন ভুখন্ডের জাতীয়তাবাদী সমস্যা ধর্মতত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বিশ্ব রাজনীতির কেন্দ্রে পরিনত হয়েছে। পৃথিবীর ৫০- ৭০% অস্ত্র ব্যবসা এই তিন ভুখন্ডকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।
প্রাকৃতিক গ্যাসের বিশাল মজুতের দেশ মিয়ানমার। ২০০৩/৪ সালে এক দারুন সুযোগ এসেছিল বাংলাদেশের দ্বারে। তিন জাতির প্রাকৃতিক গ্যাস লাইন নির্মানের প্রস্তাব। মিয়ানমারের গ্যাস বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে ভারতে পাঠানো। যেখানে বাংলাদেশের পক্ষে স্বল্প মূল্যে গ্যাস পাওয়া সম্ভব ছিল। সেই গ্যাস লাইন নির্মিত হলে বাংলাদেশ মিয়ানমারের মধ্যে প্রতিবেশী হিসাবে সম্পর্ক সৃষ্টি হতো। কিন্তু দূর্ভাগ্যের বিষয়, সেই সময়ের সরকার তা অনুধাবন করতে পারেনি। রাখাইনের সেই গ্যাস আমাদের 'অর্থের বন্ধু' চীনের বাজারে পৌঁছে।
ফিলিস্তিন / কাশ্মীর / রাখাইনের সমস্যা সমাধানের জন্য 'সাম্রাজ্যবাদী ক্লাব' নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের আগ্রহ দেখা যায়নি। যে কারনে ওই ভূখন্ডগুলোতে কালোবাজারি পন্থায় অস্ত্র সরবারহ অব্যাহত আছে।
রাখাইনের রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা রাখে আমাদের 'আর্থিক বন্ধু' চীন। কিন্তু চীন কখনই কোনো কার্যকর ভুমিকা নেয়নি।
শান্তিতে নোবেলজয়ী সুচি'র দেশ আন্তর্জাতিক আদালতের সম্মুখীন হয়েছে ২০১৭ সালের হত্যাকান্ডের জন্য। সুচির দেশের উপর গণহত্যার অভিযোগ এনেছিল গাম্বিয়া। সেই আদালতের সামনে সুচি নিজে স্বাক্ষ্য দিয়ে দেশের পক্ষ অবলম্বন করে গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করে।
'রক্তের বন্ধু' ভারত দীর্ঘকাল রোহিঙ্গা বিষয়ে কখনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ উদ্দ্যোগ নেয় নাই। তাই হঠাৎ রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয় আগ্রহ সন্দেহের সৃষ্টি করে। বিষয়টা আবার তিস্তার পানি বন্টন না হয়। কিংবা আসামের NRC ও নতুন CAA আইন যখন সেই প্রাক্তন পূর্ববঙ্গের মানুষদের কেন্দ্র করে তখন শ্রিংলার বাংলাদেশ সফর সুখকর হয় না। বর্ডার হত্যায় বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন 'রক্তের বন্ধু' ভারত যখন চীনের সাথে কুটনীতিতে ও অর্থনীতিতে পরাস্ত ভারত তখন চীনের উদেশ্যে সমরাস্ত্র প্রদর্শনে ব্যস্ত। অর্থনীতির সূচকে নিন্মগামী ভারত রাফায়েল যুদ্ধ বিমানের মহড়া ঐদেশের দারিদ্র্যকে আরো ক্লিস্ট করে তুলছে। ঠিক সেই সময় রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের ভারতীয় উদ্যোগ যে ছেলে ভুলানো গান তা সবাই জানে। আমাদের সরকারও তা বোঝে।
রাখাইনের রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের প্রকৃত কর্তৃত্ব চীনের হাতে। আমাদের 'অর্থের বন্ধু' চীন যদি সেই পদক্ষেপ নেয় তবে হয়ত সমাধান হবে। তবে এ ক্ষেত্রে শরণার্থী রোহিঙ্গারা যেন সঠিক নিরাপত্তা নিয়ে সেখান ফেরত যেতে পারে তা লক্ষ্য রাখতে হবে। আর তা সম্ভব কেবলমাত্র তাদের বৈধ নাগরিক হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া। এক্ষেত্রে যদিও বড় বাধা হলো রোহিঙ্গাদের ধর্ম পরিচয়।