বীণা সিক্রি যে কথা বলেননি
বীণা সিক্রি একজন ভারতীয় পেশাদার কূটনীতিক ছিলেন। ২০০৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশনারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৭০ সালে তিনি ভারতীয় আইপিএস অফিসার হিসাবে যোগদান করেন। বীণা সিক্রি ২০০৬ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করেন তার পেশা থেকে।
সেই সময় জ্যেষ্ঠতার হিসাবে বীণা সিক্রি ছিলেন জ্যেষ্ঠতম কর্মকর্তা। কিন্তু তার চেয়ে দুই বছরের কনিষ্ঠ কর্মকর্তা শিবশঙ্কর মেননকে (১৯৭২ ব্যাচ) ভারতের পররাষ্ট্র সচিব পদে পদায়ন করলে তিনি তার পেশা ত্যাগ করেন।
ওই একই ঘটনায় বীণা সিক্রির স্বামী ১৯৭০ ব্যাচের রাজীব সিক্রিও একই সময় পদত্যাগ করেছিলেন সিনিয়রিটি রক্ষা না পাওয়ায়। ভারতে তখন ক্ষমতায় কংগ্রেস দল ও তার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মনমোহন সিং।
বর্তমানে বীণা সিক্রি দক্ষিণ এশিয়া নারী নেটওয়ার্ক নামক সংগঠনের আহ্বায়ক।
গতকাল প্রাক্তন এই নারী কূটনীতিকের এক প্রতিবেদন বাংলাদেশের একটি অন্যতম বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে মূল প্রতিবেদনের অনুবাদ হিসাবে।
প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল- "তিস্তার পানি বন্টন চুক্তি দ্রুত সম্পন্ন হওয়া উচিত।"
দীর্ঘ এই লেখার শিরোনাম ব্যাখ্যা না করে এই প্রাক্তন কূটনীতিক ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের নানা ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরেছেন, বাংলাদেশকে উপদেশ দিয়েছেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ও তার উন্নয়ন সহযোগিতায় কি করা উচিত, তা নিয়েও কথা বলেছেন।
তার এই বর্ণনায় দুই দেশের সম্পর্কের ভিত্তিমূল ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেছেন সংবিধানের বর্ণনা অনুসারে। যদিও তার দেশের বিজেপির মোদী সরকার ধর্ম নিরপেক্ষতার আদর্শের জায়গা থেকে বহু আগেই সরে এসেছে ধর্মভিত্তিক নাগরিকত্ব প্রদানের আইন সিএএ গ্রহণ করার মাধ্যমে।
নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনী সিএএ আইন যখন ভারতীয় পার্লামেন্টে পাস করে, তখন তাদের রাজ্যসভায় বিজেপির অপর নেতা অমিত শাহ বাংলাদেশকে একটি ইসলামী রাষ্ট্র হিসাবে উল্লেখ করেন। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী আওয়ামী লীগের ক্ষমতাকালে বাংলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্র বলা রাজনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত, তা নিয়ে কোনো মন্তব্য নাই এই প্রতিবেদনে।
দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতার কথা উল্লেখ করে তিনি ভারতের অর্থনৈতিক সহযোগিতার লম্বা তালিকা তুলে ধরেছেন। রেলের ইঞ্জিন, বাস প্রদান, বিদ্যুৎ চুক্তির তালিকা প্রকাশ করেছেন; বলেছেন, কত কত অর্থনৈতিক চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে, ভারতের দেওয়া ৮০০ কোটি ডলারের কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে।
কিন্তু পেশাদার এই কূটনীতিক একটি বাক্য উল্লেখ করেননি, আমাদের বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে কোন কোন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতকে সহযোগিতা প্রদান করেছে।
পূর্ব ভারতের মাওবাদী আর উলফার প্রধান সরবরাহ পথ ছিল বাংলাদেশ, যা আমাদের বর্তমান সরকার চিরতরে বন্ধ করে ভারতের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এক স্বস্তির অবস্থা এনে দিয়েছে।
পূর্ব ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রায় বিনামূল্যে চট্টগ্ৰাম বন্দর ব্যবহার করা ও বাংলাদেশের রাস্তা ব্যবহার করে পণ্য নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।
বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রথমে আসামের এনআরসি চুক্তি বাস্তবায়নের যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে, তখনকার ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি আসামের রঞ্জন গৈগই এখন বিজেপির রাজ্যসভার সাংসদ।
এরপরই বিজেপির মোদী সরকার বাঙালি মুসলমান অধ্যুষিত পশ্চিম বাংলায় এনআরসি বাস্তবায়নের কর্মসূচি হাতে নেয়, যা বাংলাদেশের জন্য ছিল অস্বস্তিকর। ভারতের এই এনআরসির কারণে আরেকটা রোহিঙ্গা সমস্যা তৈরি হবে, বাংলাদেশোর জন্য লেখায় এ বিষয়ে নিশ্চুপ বীণা সিক্রি।
ভারত দেশব্যাপী এনআরসি বাস্তবায়নের মে কর্মসূচী হাতে নেয়, তা বাস্তবায়নের বৈধতা প্রমাণ করার জন্য, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তকে পৃথিবীর প্রধান সীমান্ত হত্যার সীমান্তে রূপান্তর করেছে- এটা বলা ভুল হবে না। গত দশ বছরের হত্যার হিসাব করলে দেখা যায়, এ হত্যাকাণ্ড বেড়েই চলছে, যা আমাদের বর্তমান সরকারকে ব্যাপক অস্বস্তিতে রেখেছে। ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতবিরোধীরা তাদের রাজনৈতিক শক্তি অর্জন করে চলছে এই সীমান্ত হত্যার মাধ্যমে। একইসঙ্গে বীণা সিক্রি মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীদ্বয়ের সফরের কথাও উল্লেখ করেছেন, কিন্তু তিনি উল্লেখ করেন নাই বাংলাদেশের দুই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী কেন তাদের পূর্ব নির্ধারিত সফর বাতিল করেছিলেন। বাংলাদেশের বহু গণমাধ্যম তখন বিষয়টি তাদের নাগরিকত্ত্ব আইনের (সিএএ) পরিণাম হিসেবে উল্লেখ করেছিল।
বিদ্যুৎ সরবরাহের চুক্তির কথা উল্লেখ করেছেন বীণা সিক্রি, অথচ সেই বিদ্যুৎ বিক্রয় চুক্তি নিয়ে ভারতের বিরোধীদল কংগ্রেস প্রশ্ন তুলেছে, ভারতীয় অংশের প্রতিনিধি হিসাবে অনিল আম্বানির কোম্পানিকে ভারতীয় পক্ষের প্রতিনিধি করায়। যে সময়ে বাংলাদেশ সেই চুক্তি করেছিল, তখন বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা আজকের পর্যায়ে উন্নীত হয় নাই। তবু আমাদের সরকার সেই ক্রয় চুক্তি বাস্তবায়ন করছে।
১৯৭৫ সালে যখন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়, তখন ভারতের রাষ্ট্র ক্ষমতায় ভারতীয় কংগ্রেস আর তার নেতৃত্বে ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী আর দেশটিতে তার কয়েক দিন আগে জুলাই মাস থেকে চলছিল জরুরি অবস্থা। ভারতের স্বাধীনতা দিবসে সংগঠিত সেই হত্যাকাণ্ডের পর দীর্ঘকাল ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এক দীর্ঘ সংকটে নিমজ্জিত হয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকে তখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসাবে দেখেছিল ভারত। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারত কতটা প্রতিবাদী ছিল, তা প্রশ্নযোগ্য।
ভারত বাংলাদেশের দীর্ঘ কালের সমস্যা রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন নিয়ে কোনো সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। বৈধ-অবৈধ বিপুল সংখ্যক ভারতীয় ( প্রায় ৫/৬ লক্ষ) বাংলাদেশে কর্মরত। যারা প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় চার-৬ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স ভারতে নিয়ে যায়। এবং বাংলাদেশ থেকে ভারতের রফতানী আয় প্রায় সাত বিলিয়ন ডলার। এ বিষয়টিও ভারতীয় সরকার কিংবা বীনা সিক্রিদের মনে রাখতে হবে । তাই কর্তৃত্ববাদীতা না, প্রকৃত প্রতিবেশীসুলভ বন্ধুত্ব চাই।
বীণা সিক্রি বাংলাদেশে চীনের অর্থনৈতিক সহযোগিতা চুক্তি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন, বিষয়টি যে কুটনৈতিক শিষ্টাচার পরিপন্থী তা তিনি উপলব্ধি করেন নাই। তিনি হয়তো ভুলে গেছেন, বর্তমান সরকারের প্রথমবার, ২০০৯ সালের পরে একজন পূর্ণ মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে যখন বিশ্বব্যাংকসহ অন্য অর্থায়ন সংস্থা সরে দাঁড়িয়েছিল পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে, তখন চীন তার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে সরকারের দীর্ঘদিনের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে এক দৃঢ় বন্ধুত্বের ভূমিকা পালন করেছিল।
চীন-বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ১৯৭২ সালের বাংলাদেশের জাতিসংঘের সদস্য পদের বিরুদ্ধে চীনের ভেটোর কথা উল্লেখ করেছেন, অথচ বিজেপি তথা মোদী সরকার দীর্ঘকালের পরীক্ষিত রাশিয়ার পরিবর্তে জায়গা করে দিয়েছে ট্রাম্পকে। দ্বিতীয় দফায় ভারতে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে আমেরিকা আর ভারত সম্পর্ক উন্নয়নের পথে হাঁটছে ভারত। যদিও ভারত দীর্ঘকাল আমেরিকার বৈরিতার মুখোমুখি ছিল। ভারতের আপত্তির মুখেও আমেরিকা পাকিস্তানের কাছে এফ-১৬ যুদ্ধ বিমান বিক্রি করেছিল। বিশ্বায়নের এই যুগে রাজনৈতিক বন্ধুত্ব সবসময় প্রাধান্য পায় না, বরং অর্থনীতি অনেক বেশি কার্যকর ভূমিকা পালন করে। চীন-বাংলাদেশের সম্পর্ক আজ সেই অর্থনীতির ওপর দাঁড়িয়ে।
ভারতের সঙ্গে স্থল ট্রানজিট চুক্তির সময় তিস্তা পানি বন্টন চুক্তি হওয়ার অঙ্গীকার ছিল বিজেপি সরকারের, কিন্তু পশ্চিম বাংলার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কারণে সেই চুক্তি অধরা। চীন যখন তিস্তা প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে এসেছে, তখন মিসেস সিক্রির তিস্তা পানি চুক্তির বাস্তবায়নের আহবান সহজেই অনুমেয়।
তবে মিসেস সিক্রির এ কথা সত্য যে, চীনের অর্থনৈতিক চুক্তি বন্ধুত্বের চেয়ে অর্থ-বাণিজ্য গুরুত্ব পায়। চীনা অর্থনৈতিক সহযোগিতার মাধ্যমে উচ্চ সুদের ঋণ ভার বইতে হয়। তবে সেই ঋণের ভার বহনের সক্ষমতার বিষয় আমাদের সরকার নিশ্চয় সচেতন।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক