রাজশাহীর বাজারে ইলিশ মাছ কেটে টুকরো হিসেবে বিক্রি
রাজশাহীতে ইলিশ মাছ কেটে পিস করে বিক্রি করা হচ্ছে। আজ (বৃহস্পতিবার) রাজশাহীর সাহেববাজার মাছ বাজারে গিয়ে এমন চিত্র দেখা যায়।
তখন অনেক ক্রেতাদেরও কাটা মাছের টুকরো কিনতে দেখা গেছে। এক্ষেত্রে ক্রেতাদের মধ্যে অনেককে পাঁচ পিস, কেউ তিন পিস, আবার কেউ দুই পিসও ইলিশ মাছ কিনতে দেখা গেছে। এভাবে ইলিশ বিক্রির ফলে আপামর জনসাধারণ সবাই ইলিশ মাছ খেতে পারবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী নেতারা।
গতকাল (বুধবার) জেলার মৎস্যজীবী সমিতির সাথে আলোচনা করে আজ থেকে কাটা ইলিশ পিস করে বিক্রির উদ্যোগ নেন রাজশাহীর ব্যবসায়ী ঐক্য পরিষদের নেতারা। তাদের উপস্থিতিতে বেলা ১১টা থেকে সাহেব বাজার মাছ বাজারে এ কার্যক্রম শুরু হয়। ক্রম্বান্বয়ে রাজশাহীর অন্যান্য বাজারেও বিক্রি হবে বলে তারা জানান।
রাজশাহী ব্যবসায়ী সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সেকেন্দার আলী বলেন, "অনেক দিন ধরেই মানুষজন অভিযোগ করে আসছিলেন যে, দামের কারণে তারা ইলিশ মাছ খেতে পারছেন না। কারণ একটা গোটা ইলিশ কিনতে গেলে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা লাগে। এই ইলিশ কেনার ক্ষমতা আমাদের নাই। কেটে বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া হলে আমরা হয়তোবা একশ গ্রাম, ২০০ গ্রাম, আড়াইশো গ্রাম করে খেতে পারতাম। সেক্ষেত্রে আমরা ব্যবসায়ী ঐক্য পরিষদের উদ্যোগে গতকাল মৎস্যজীবী সমিতির সাথে বসে তাদেরকে বোঝানোর পর তারা এভাবে বিক্রি করতে রাজি হয়েছে।"
"আমরা তারপর থেকে প্রচার প্রচারণার জন্য মাইকিং করেছি। আজকে কেটে ইলিশ মাছ পিস করে বিক্রির কার্যক্রম উদ্বোধন করলাম। উদ্বোধনের কয়েক মিনিটের মধ্যে পাঁচটা ইলিশ মাছ বিক্রি হয়ে গেছে", যোগ করেন তিনি।
রাজশাহী ব্যবসায়ী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ফরিদ মামুদ হাসান বলেন, "ইলিশ মাছের আকাশছোঁয়া দামের কারণে গরিব মানুষরা ইলিশ মাছ খেতে পারেন না। তাই আমরা এ উদ্যোগ নিয়েছি যাতে সবাই সচেতন হতে পারে এবং তার ফলে যেন দুই পিস হলেও যেন গরীব মানুষরা ইলিশ মাছ খেতে পারে। এটা সাহেববাজারে শুরু হলেও ক্রমান্বয়ে রাজশাহীর অন্যান্য বাজারেও এই উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।"
তিনি আরও বলেন, "এটা রাজশাহীর জন্য একটি মাইফলক ঘটনা যেটা অন্য জেলাও অনুসরণ করতে পারবে। কেটে মাছ বিক্রি হলে নাড়িভুড়ি ফেলে দেওয়ার কারণে ওজন কিছুটা কমে যেতে পারে। তাই খুচরা ব্যবসায়ীদের বলেছি, সেই ক্ষতি যেন কিছুটা দাম বৃদ্ধি করে হলেও পুষিয়ে নেওয়া হয়।"
মজিবুর রহমান দুলাল নামের এক ক্রেতা কাটা ইলিশের পাঁচ টুকরো কিনেছেন সাড়ে চারশো টাকায়। তিনি বলেন, "আমার পক্ষে আস্ত একটা ইলিশ মাছ কেনা সম্ভব না। তাই কেটে ইলিশ মাছ বিক্রি হচ্ছে দেখে তিনি পাঁচ টুকরো ইলিশ সাড়ে চারশো টাকায় কিনে নিলাম। আমার পরিবারের সদস্য সংখ্যাও ৫ জন।"
এছাড়া বড় সাইজের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার টাকা কেজি দামে। আর প্রতি ২৫০ গ্রাম ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৫০০ টাকায়।
তবে মাছ পিস হিসেবে বিক্রি করায় ক্ষতি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন খুচরো ব্যবসায়ীরা। মো. আবু নামের এক খুচরো ব্যবসায়ী বলছেন, "মাছের নাড়িভুঁড়ি ফেলে দেওয়ার পর মাছ ওজনে কিছুটা কমে। কিন্তু আমাদের কেজি হিসেবের দামই দেওয়া হচ্ছে। আবার অনেকে মাছের মাঝের অংশ নিতে চাইলেও মাথা ও লেজ নিতে চাচ্ছে না। এতে ঝামেলা হচ্ছে। অনেক সময় বাকবিতন্ডাও বেধে যাচ্ছে।"
বিশু নামের আরেক খুচরো ব্যবসায়ী বলেন, "এইভাবে মাছ বিক্রি করাতে অনেক ঝামেলার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। কারণ একেক ভোক্তার চাহিদা একেক রকম। কেউ যদি এসে আমাদের একটা বড় মাছ দেখিয়ে বলেন, আমাকে এখান থেকে দুই টুকুরো দেন তাহলে সেটা তো আমাদের পক্ষে সম্ভব না। তখন দেখা যাচ্ছে ক্রেতার সাথে ঝামেলা তৈরি হচ্ছে।"
গত শতাব্দীর ১৯৭০-এর দশক পর্যন্তও রাজশাহীর পদ্মায় মিলত ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ। আকারে বড় ও স্বাদে অতুলনীয় ছিল সেই ইলিশ। দামে কম ও সহজলভ্য হওয়ায় আপামর জনসাধারণ ইলিশ খেতেন। কিন্তু পদ্মার উজানে ফারাক্কা বাঁধ দেওয়ার পর থেকে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় এ নদীতে ইলিশের পরিমাণ কমতে কমতে এখন প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। তবে পদ্মার পানির গভীরতা বাড়ানো গেলে ও মা ইলিশ ধরা বন্ধ করা গেলে আবারও ইলিশের পুরনো সেই সুদিন ফেরানো সম্ভব হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ইলিশ মাছ দ্রুত বেগে ছোটে এবং উজানের দিকে যেতে পছন্দ করে। চলাচল করে ঝাঁকে ঝাঁকে। এক এক ঝাঁকে শত শত ইলিশ থাকে। পাকিস্তান আমলেও বঙ্গোপসাগর থেকে উজানে রাজশাহী হয়ে ভাগলপুর পর্যন্ত যেত ইলিশ এবং ডিম ছাড়ত। চারঘাট থেকে পদ্মার শাখা বড়াল নদীর বাঘার আড়ানি অংশেও মিলত প্রচুর ইলিশ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও ১৯৭৪-৭৫ সাল পর্যন্ত রাজশাহীতে প্রচুর ইলিশ পাওয়া যেত। তখন সব শ্রেণি-পেশার মানুষের ঘরেই ইলিশ পাওয়া যেত।"
মাহবুব সিদ্দিকী আরও বলেন, "আমি ১৯৬০ সালের আগেও রাজশাহীর বাজার থেকে এক টাকা দিয়ে সোয়া কেজি ওজনের চারটি ইলিশ কিনেছি। পরিস্থিতি এমন ছিল যে ইলিশ খেতে খেতে অরুচি চলে আসত। সপ্তাহে তিনদিনই ইলিশ খাওয়া হতো। তখন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও হাটে ইলিশ বেচা-কেনা হতো। অনেকেই ফেরি করে গ্রামে গ্রামে ইলিশ বিক্রি করতেন।"