জেলেদের মাঝে উৎসবের আমেজ: নৌকা সাজিয়ে নেচে-গেয়ে বাড়ি রওয়ানা
নদীর বেশির ভাগ নৌকাই রংবেরঙের কাগজে সাজানো হয়েছে। নৌকায় নৌকায় উচ্চ শব্দে বাজছে গান। নৌকার চুলোয় রান্না হচ্ছে পোলাও। আতশ বাজির শব্দে হৈ হৈ করছেন কেউ কেউ। কেউবা টাকা গুনছে, কেউ নতুন জামা কাপড় নিচ্ছেন। কেউ আবার লগ্গি–বৈঠা ধুয়ে মুছে পরিস্কার করছেন। কেউ মেরামত করে যাচ্ছেন জাল। এভাবে আনন্দ প্রকাশ করছেন জেলেরা।
কারণ আজ (১২ অক্টোবর) রাত থেকেই জেলেদের ছুটি ২২ দিনের।
শনিবার (১২ অক্টোবর) লক্ষ্মীপুর জেলার মেঘনানদীর তীরের মতিরহাটে গিয়ে জেলেদের উৎসবের এমন দৃশ্য চোখে পড়েছে। শনিবার রাত থেকে আগামী ৩ নভেম্বর পর্যন্ত মোট ২২ দিন নদী ও সাগরে মাছ ধরা বন্ধ থাকবে। সরকারি সিদ্ধান্তের ২২ দিনের এমন অবসরকে গত কয়েক বছর যাবত জেলেরা এখন উৎসব হিসেবে উদযাপন শুরু করছেন।
মেঘনা তীরে গিয়ে অন্তত ৪০-৫০জন জেলে ও ব্যবসায়ীর সাথে কথা বললে সবাই এমনটি জানান।
মতিরহাট বাজারে প্রবেশের মুখে জয়বাংলা খালের মধ্যে নোঙর করা প্রতিটি নৌকা সাজানো। নৌকার ছাদে স্পীকারে গান বাজছে। জেলেরা নতুন জামা কাপড় পরে বাড়ি যাওয়ার নানান প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এসময় মোঃ আলী হোসেন ইসলাম (২৫) নামের একজন জেলের সাথে কথা হয়। তিনি জানান, গত প্রায় ৪ মাস যাবত তারা নদীতে মাছ ধরেছেন। এখন ২২ দিন নদীতে মাছ ধরা বন্ধ। এমন অবসরের ঘোষণায় তারা সবাই মিলে মৌসুমের শেষ দিনটি একটু আনন্দে কাটিয়েছেন, ভালো রান্না হয়েছে, হাসি তামাশা হচ্ছে।
আনন্দটা কেমন ছিল?— জানতে চাইলে রহমান বলেন, "শুক্রবার নৌকা সাজিয়ে গান বাজিয়ে কিছুক্ষণ নদীতে ঘুরেছি। শনিবার নৌকায় পোলাও রান্না হয়েছে। সাথে গরুর মাংস রয়েছে। দুপুরে সবাই মিলে পোলাও–গরুর মাংস খাব। বিকেলে মহাজন এসে সবাইকে টাকা দেবেন। প্রত্যক জেলেকে নতুন লুঙ্গি এবং তাদের স্ত্রীদের জন্য শাড়ি দেবেন। বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য কিছু মাছ দেবেন। এসব নিয়েই বাড়ি ফিরব।"
মতিরহাট ঘাটের পাশে নোঙর করা নৌকার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন জেলে স্বপন। তিনি জানান, "আজ জেলেদের বিদায় উৎসব । আগামীকাল থেকে ব্যবসায়ী ও দোকানদারদের হালখাতা উৎসব শুরু হবে।"
জেলেরা গত চার মাস বিভিন্ন দোকানে বাকিতে মালামাল ক্রয় করেছিল। বন্ধের সময় ব্যবসায়ীরা হালখাতা দেবে। তেলের দোকান, জালের দোকান, মুদিদোকান এবং চা দোকানে চলবে হালখাতা। অক্টোবরের হালখাতায় জেলে এবং নৌকার মালিকরা হালখাতা করবেন।
হালখাতায় বিরিয়ানি, পোলাও, খিচুড়ি এবং জিলাপী খাওয়ানো হয়। এ সময় জেলেরা নিজেদের কাছে জমানো টাকা থেকে কিংবা ঋণ নিয়ে দোকানদারদের বাকি পরিশোধ করেন।
তেলের দোকানে কথা হয় ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলী ও নৌকার মহাজন আলমগীরের সঙ্গে। আলমগীর জানান, "তেলের দোকানে কিছু বাকি আছে। আজ হিসেব করলাম। হালখাতার দিন এসে পরিশোধ করবো।"
এই সিজনে লাভ নাকি লস হয়েছে?— জানতে চাইলে আলমগীর জানান, "জাল ও নৌকায় সাড়ে ৪ লাখ খরচ করে আড়াই লাখ আয় হয়েছে। ২ লাখ ক্ষতি। এখন নতুন করে ঋণ নিয়ে দোকানের বাকির জন্য হালখাতা করবো।"
২২ দিনের অবসরে জেলেরা কীভাবে সময় কাটান?— এমনটি জানতে চাইলে মোঃ আবু তাহের (৫০) বলেন, "অবসরের প্রথম ৪-৫ দিন জেলেরা বাড়িতে আর কোনো কাজ করেন না। তবে কয়েক দিন পরেই তারা জাল ও নৌকা মেরামতের কাজ শুরু করেন; সাংসারিক অন্যান্য কাজও করেন। আত্মীয়দের বাড়ি যায় এবং এ সময় জেলেপাড়ায় বিয়েশাদির আয়োজন হয়।"
মতিরহাট বাজার ও মাছ ঘাটের আশপাশে অন্তত ৪০-৫০ জন জেলের সাথে কথা বলে বোঝা যায়, মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা মূলত তাদের জন্য কাজের অবসর। তাই অবসরে যাওয়ার এ দিনটি তাদের কাছে খুবই আনন্দের।
তবে জেলেদের সবাই বলেছিলেন, অবসরের আনন্দে নেচে-গেয়ে বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিলেও আসলে তারা সবাই ঋণগ্রস্ত। অনেকের বাড়িতেই আগামীকাল থেকে ৩ বেলা ভাত রান্না হবে না।
লক্ষ্মীপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, ইলিশ মাছের ডিম ছাড়ার সময়কাল পূর্ণিমা ও অমাবস্যার সঙ্গে যুক্ত। বাংলা আশ্বিনের ভরা পূর্ণিমার আগে এবং পরে ইলিশ মাছ সবচেয়ে বেশি ডিম ছাড়ে।
সেজন্য দেশে প্রথমবারের মতো ২০০৭ সালের অক্টোবর মাসের ১৫-২৪ তারিখ ১০ দিন ইলিশের ভরা/সর্বোচ্চ প্রজনন মৌসুম হিসেবে চিহ্নিত করে ওই সময়ে ইলিশ ধরা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। পরে তা সংশোধিত আকারে ২২ দিন করা হয়েছে। চলতি বছর ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিন ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
উক্ত ২২ দিন সময়কালে একটি পূর্ণিমা ও একটি অমাবস্যা থাকায় সর্বোচ্চ সংখ্যক ডিম ছাড়ার সুযোগ পাবে ইলিশ। একটি ইলিশ ৩ থেকে ২৩ লাখ পর্যন্ত ডিম দেয় বলে জানিয়েছেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা।