ব্যবসা বহুমুখীকরণে ছয় বছরে ৩৬০ কোটি টাকা বিনিয়োগ অলিম্পিকের
দেশের সবচেয়ে বড় বিস্কুট ও কনফেকশনারি কোম্পানি অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ গত ছয় বছরে প্রায় ৩৬০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। কারখানা সম্প্রসারণ, ব্যবসা বহুমুখীকরণ এবং পুরো কনফেকশনারি শিল্পে শক্ত অবস্থান অর্জনের লক্ষ্যেই মোটা অঙ্কের এই বিনিয়োগ বলে জানা গেছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) দায়েরকৃত মূল্য সংবেদনশীল তথ্যে জানা গেছে, কোম্পানিটি জমি ক্রয়ের জন্য বিনিয়োগ করেছে মোট ১৮১ কোটি টাকা। এর মধ্যে বসুন্ধরায় ১১০ দশমিক ২৬ কোটি, তেজগাঁওয়ে ৫২ দশমিক ৬২ কোটি, পূর্বাচলে ৮ দশমিক ৯১ কোটি এবং নারায়ণগঞ্জে ৮ দশমিক ৫৯ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।
কারখানা কার্যক্রম সম্প্রসারণে ১৭৮ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে অলিম্পিক। এর মধ্যে চানাচুর উৎপাদনের জন্য ২২ দশমিক ৭১ কোটি, নুডুলসের জন্য ২৪ দশমিক ৭৫ কোটি, চকোলেটের জন্য ১২ কোটি, কেকের জন্য ২৫ দশমিক ৬৫ কোটি, বিস্কুটের জন্য ৬৪ কোটি এবং অবকাঠামো ও প্যাকেজিংয়ের জন্য ২৮ দশমিক ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে।
এনিয়ে কথা বলার জন্য অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান আজিজ মোহাম্মদ ভুইয়া এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক নূরজাহান হুদার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও, মুঠোফোন বন্ধ থাকায় তা সম্ভব হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, গত ছয় বছরে কনফেকশনারি শিল্পে প্রতিযোগিতা বেড়েছে। মেঘনা গ্রুপ, টিকে গ্রুপ, বসুন্ধরা, আকিজ, নিউজিল্যান্ড ডেইরি এবং প্যারাগন গ্রুপের মতো বড় কোম্পানিগুলো বাজারে প্রবেশ করায় প্রতিযোগিতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
তিনি বলেন, "এ পরিস্থিতিতে অলিম্পিক তাদের শীর্ষস্থান বজায় রাখতে বড় বিনিয়োগ করেছে"।
কোম্পানিটি বসুন্ধরায় নিজস্ব কর্পোরেট অফিস এবং পূর্বাচলে কর্মচারীদের আবাসন সুবিধার জন্য জমি কিনেছে। তেজগাঁওয়ের জমিটি বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য রাখা হয়েছে। আর নারায়ণগঞ্জের বেশিরভাগ জমি কারখানা সম্প্রসারণে ব্যবহার হবে বলে জানান তিনি।
ইবিএল সিকিউরিটিজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অলিম্পিক ইন্সট্যান্ট নুডুলস, ড্রাই কেক, সফট কেক, চকোলেট ওয়েফার, ক্যান্ডি, টফি, টোস্ট, রাস্ক এবং স্যাভরি স্ন্যাকসের মতো বিভিন্ন পণ্যে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করেছে। এই বিনিয়োগগুলো কোম্পানির সম্প্রসারণ কৌশলকে স্পষ্ট করে তুলে ধরে।
একটি ব্রোকারেজ সংস্থার গবেষক পূর্বে উল্লেখ্য করেছিলেন যে, বিনিয়োগকারীরা অলিম্পিককে একটি শক্তিশালী শেয়ার স্টক হিসেবে বিবেচনা করেন। তবে ২০২১ থেকে ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাজারের মন্দাবস্থার ফলে এর শেয়ার মূল্য ৫০ শতাংশেরও বেশি কমেছে।
কিন্তু অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও অলিম্পিকের ব্যবসা খুব একটা প্রভাবিত হয়নি। বরং, কোম্পানিটি সংকটের সময় ব্যবসার সম্প্রসারণে বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছিল, যা বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হয়েছে।
বাংলাদেশ অটো বিস্কুট ও ব্রেড প্রস্তুতকারক সমিতি এবং বাংলাদেশ ব্রেড বিস্কুট ও কনফেকশনারি প্রস্তুতকারক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, অলিম্পিক তার প্রতিযোগীদের মধ্যে প্রথম স্থানে রয়েছে— স্ন্যাকস শিল্পে ২২ শতাংশ এবং অটো বিস্কুট উৎপাদনে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বাজার শেয়ার ধরে রেখেছে।
এদিকে, কোম্পানির বৈচিত্র্যকরণের কৌশল ২০২২-২৩ অর্থবছরে রেকর্ড ২৫৭৮ কোটি টাকার রাজস্ব অর্জনে সহায়তা করেছে, যা গত ছয় বছরে প্রায় ১০০ শতাংশ বৃদ্ধি। এছাড়াও, কোম্পানিটি ২০২৩ অর্থবছরে শেয়ারহোল্ডারদের ৬০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ বিতরণ করেছে।
২০২৪ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে, অলিম্পিকের রাজস্ব সামান্য হ্রাস পেলেও মুনাফা বেড়েছে। জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত রাজস্ব ১,৯৪১ কোটি টাকায় নেমে এসেছে, যা ২০২৩ অর্থবছরের একই সময়ে ১,৯৭৮ কোটি টাকা ছিল। তবে, এবছরে মুনাফা বেড়ে ১৫৭ কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা ২০২৩ অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১৪৫ কোটি টাকা।
অলিম্পিক বোর্ডে দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রবেশ
আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের বাবা, মোহাম্মদ ভাই, ১৯৭৯ সালে বেঙ্গল কার্বাইড লিমিটেড নামের একটি ব্যাটারি ব্যবসা দিয়ে কোম্পানিটি শুরু করেছিলেন। পরে কোম্পানির নাম পরিবর্তন করে অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড রাখা হয়। ১৯৯৬ সালে, কোম্পানিটি বিস্কুট উৎপাদন ব্যবসায় প্রবেশ করে।
মোহাম্মদ ভাই তার দুই পুত্র, আজিজ মোহাম্মদ ভাই এবং রাজা মোহাম্মদ ভাই, পাশাপাশি তার কন্যাদের কোম্পানির মালিকানায় অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। আর কোম্পানি পরিচালনার জন্য ভাই মুবারক আলীকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিযুক্ত করেন।
২০২৩ সালের জুনে, আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের ছেলে ও ভাতিজা বোর্ডে পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার মাধ্যমে এ পরিবারের দ্বিতীয় প্রজন্ম অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজের বোর্ডে প্রবেশ করে। মুবারক আলীর ছেলে, মুনির আলী, এর আগেই কোম্পানিতে পরিচালক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন।
কোম্পানির সূত্র অনুযায়ী, আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের পুত্র আসার মোহাম্মদ ভাইকে পরিচালক হিসেবে মনোনীত করে অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজের ৩ দশমিক ২৯ শতাংশ শেয়ারধারী অ্যাম্বি লিমিটেড। আজিজের মৃত ভাই রাজা মোহাম্মদ ভাইয়ের পুত্র আহাদ মোহাম্মদ ভাইকে শেয়ারহোল্ডার পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছে।
গত বছর জুলাইয়ে, আজিজ মোহাম্মদ ভাই কোম্পানিটির চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত হন। এছাড়া, তার বোন, নূরজাহান হুদাকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান রাজা মোহাম্মদ ভাই ২০১৮ সালে এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুবারক আলী ২০২৩ সালে মারা যাওয়ার পর এই দুটি পদ শূন্য ছিল।
এই বছর এপ্রিল মাসে, আজিজ মোহাম্মদ ভাই কোম্পানিতে তার মালিকানা শেয়ার বাড়ানোর কৌশল হিসেবে অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজের ২৭ লাখ শেয়ার অধিগ্রহণ করেন। বর্তমানে কোম্পানিটির ১৮ শতাংশ শেয়ারের মালিক তিনি।
এছাড়া, জুলাই মাস পর্যন্ত, কোম্পানির স্পন্সর এবং পরিচালকরা ৪৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ, সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা ১১ দশমিক ০৯ শতাংশ, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ২৩ দশমিক ৯৬ শতাংশ, এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা ১৮ দশমিক ২০ শতাংশ শেয়ার ধারণ করছে।