আহ, উপহার বটে: জাতিসংঘ কর্মীদের বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেবে রাশিয়া
আপনি যদি রাশিয়ার তৈরি করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকাটি বিনামূল্যে পাওয়ার সুযোগ পান- সেক্ষেত্রে কী করবেন? বিশেষত আপনি যদি জানেন, খোদ রাশিয়ার সিংহভাগ চিকিৎসক এক ওয়েব জরিপে জানিয়েছেন, তারা এটি স্বেচ্ছায় নিতে ইচ্ছুক নন। এরপর কী ভয় কাজ করবে আপনার মনে?
অথচ, এমন উপহারের পাল্লাতেই পড়েছেন জাতিসংঘ কর্মীরা। গত মঙ্গলবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৫ বর্ষপূর্তিতে দেওয়া ভাষণে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তাদের সাহায্যে এগিয়ে এসে, স্পুতনিক-ভি টিকাটি উপহার হিসেবে দেওয়ার ঘোষণা দেন।
এই ঘোষণায় অবাক হয়েছেন জাতিসংঘ সদর দপ্তর নিউইয়র্ক এবং বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে অবস্থান করা সংস্থার কর্মীরা।
আনন্দের বদলে বিস্ময়ের কারণ আর কিছুই নয়; রাশিয়ার কোভিড ভ্যাকসিন তৈরির প্রক্রিয়া নিয়ে অসচ্ছতা। শুধুমাত্র এর প্রাথমিক দুই স্তরের পরীক্ষার ফল সম্পর্কে কিছু তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।
তৃতীয় স্তরে বড় আকারের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সম্পন্ন না হওয়ায়- বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এটি গণহারে দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেনি। স্পুতনিক-ভি'র নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া নিয়ে বিশ্বব্যাপী অনেক জল্পনা-কল্পনা আর ব্যঙ্গবিদ্রুপও দেখা গেছে।
চলতি বছরের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন হয়েছে ভার্চুয়াল ব্যবস্থায়, যা সংগঠনটির ইতিহাসে প্রথম। অধিবেশন ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত অধিকাংশ কর্মী ঘরে থেকেই কাজ করেছেন।
মস্কো থেকে রেকর্ডকৃত এক সম্প্রচারে পুতিন বলেন, ''আমাদের মধ্যে যে কেউ বিপজ্জনক এ জীবাণু সংক্রমণের শিকার হতে পারে। জাতিসংঘের সদর দপ্তর বা এর শাখা কার্যালয়ের কর্মীদেরও ছাড় দেয়নি এটি। প্রয়োজনে রাশিয়া জাতিসংঘ কর্মীদের প্রয়োজনীয় এবং মানসম্মত সাহায্য দেবে। বিশেষ করে, রাশিয়ায় উৎপাদিত টিকা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে জাতিসংঘ এবং তার সহযোগী সংস্থার কর্মীদের দেওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছি।''
গত মাসে ব্যাপক প্রচারণা আর আয়োজনের মধ্য দিয়ে রাশিয়ার তৈরি প্রথম ভ্যাকসিনের অনুমোদন ঘোষণা করেন পুতিন। জানান, তার এক কন্যা নাকি এর ইঞ্জেকশন গ্রহণ করেছেন।
মঙ্গলবার পুতিন জানান, রাশিয়ার উৎপাদিত টিকা নিতে অনেকের ভেতরেই আগ্রহ রয়েছে। সেই দাবিতে সাড়া দিয়েই তিনি এ প্রস্তাব দিয়েছেন।
'জাতিসংঘের কিছু সহকর্মী আমার কাছে টিকাটির জন্য অনুরোধ করেছেন, আর আমরাও তাদের বঞ্চিত করতে চাইনি।'
পুতিনের প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়ায় জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টেফানে দুজারিক বলেন, 'এমন মহৎ প্রস্তাব দেওয়ায়, আমরা প্রেসিডেন্ট পুতিনকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই। তবে আমাদের জনস্বাস্থ্য শাখা এ ব্যাপারে বিস্তারিত গবেষণা করেই সিদ্ধান্ত নেবে।'
এব্যাপারে অবশ্য জেনেভায় অবস্তিত জাতিসংঘের বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্থা- ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের (হু) মুখপাত্র ডা. মার্গারেট হ্যারিস কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।
ইতোপূর্বে, চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিখ্যাত সাময়িকী ল্যানসেটে প্রকাশিত এক নিবন্ধে রুশ গবেষকরা দাবি করেন, তাদের তৈরি টিকাটি কার্যকর এবং তা দ্বিতীয় স্তরের পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ৪০ জন স্বেচ্ছাসেবকের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ভাইরাসের বিরুদ্ধে উদ্দীপ্ত করতে পেরেছে।
তবে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে অংশ নেওয়াদের মাত্র ৪২ দিন পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছিল, বলেও তারা স্বীকার করে নেন। ট্রায়ালের আকারও ছিল ছোট এবং সেখানে নিরপেক্ষ বিশ্লেষণের জন্য আবশ্যক বিকল্প প্রতিষেধক বা ওষুধের ব্যবহার করা হয়নি।
অর্থাৎ, শুরু থেকেই চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত ধাপগুলো লঙ্ঘন করেছে স্পুতনিক-ভি'র গবেষণা।
এর তুলনায় বরং তৃতীয় পর্যায়ের ট্র্যায়ালের অংশ হিসেবে ইতোমধ্যেই বিশ্বের নানা দেশের হাজার হাজার মানুষের দেহে পরীক্ষা করা অন্য কিছু প্রার্থী টিকা এখন ব্যাপক সম্ভাবনা দেখাচ্ছে।
এসব গবেষণার তথ্য নিয়ে এখনও চলছে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ। বাজারে সম্পূর্ণ নিরাপদ এবং ফলপ্রসূ টিকা আনার জন্য যার কোনো বিকল্প নেই। আর কোনো প্রার্থী টীকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে শুধুমাত্র বড় আকারের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতেই নিশ্চিত হওয়া যায়।
গত সোমবার রুশ গণমাধ্যম জানায়, হু'র ইউরোপীয় শাখার আঞ্চলিক পরিচালক হান্স ক্লুগে রুশ স্বাস্থ্যমন্ত্রী মিখাইল মুরাস্কোর সঙ্গে এক বৈঠকে রাশিয়ার ভ্যাকসিনটি নিয়ে প্রশংসা করেছেন।
রাষ্ট্রায়ত্ত বার্তা সংস্থা তাস এজেন্সি ক্লুগের বক্তব্য উল্লেখ করে জানায়, 'করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রাশিয়ার স্পুতনিক ভ্যাকসিন তৈরির উদ্যোগকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বাগত জানায়।' এসময় তিনি একে 'নিরাপদ' ও 'ফলপ্রসূ' বলেও উল্লেখ করেছেন বলে সংবাদ সংস্থাটি দাবি করে।
শুরু থেকেই স্থানীয়ভাবে আবিষ্কৃত এ ভ্যাকসিনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সকল সমালোচনা নাকচ করে দিয়ে আসছেন রুশ কর্মকর্তারা।
ইতোমধ্যেই, দেশটি ভারত, সৌদি আরবসহ বিশ্বের আরও কয়েকটি দেশে স্পুতনিক-ভি'র তৃতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পরিচালনার চুক্তি করেছে। রাষ্ট্রীয় অনুমোদনের পরবর্তীকালে এই প্রথম বিশ্বের কোনো ভ্যাকসিনকে এভাবে ট্রায়ালের সম্মুখীন হতে হচ্ছে।