ডিসি, ইউএনওদের জন্য ২০০ নতুন গাড়ি কেনার পরিকল্পনা করছে সরকার
অর্থনৈতিক সংকটের সময় সরকার যখন কৃচ্ছ্রতাসাধনে গুরুত্ব দিচ্ছে, তখন জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) জন্য ২০০ মিৎসুবিসি, পাজেরো কিউএক্স জিপ গাড়ি কিনতে চায় জন প্রশাসন মন্ত্রণালয়— যার প্রতিটি গাড়ির দাম ১.৬৯ কোটি টাকারও বেশি।
বিলাসবহুল ২,৪৭৭ সিসির গাড়িগুলো কিনতে সরকারের ব্যয় হবে প্রায় ৩৩৯ কোটি টাকা।
জনপ্রশাসনে গতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাসহ পরিবহন সেবা স্বাভাবিক রাখার জন্য এসব গাড়ি কেনা প্রয়োজন বলে অর্থ মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
ডিসি ও ইউএনওদের জন্য ২০০ নতুন গাড়ি কিনতে বাজেট বরাদ্দ চেয়ে গত ৭ অক্টোবর অর্থসচিবকে চিঠি দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়— যার একটি কপি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড দেখেছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আব্দুল্লাহ আরিফ মোহাম্মদ স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, বর্তমান বাজারে গাড়ির দাম বেড়েছে। অনুর্ধ্ব ২,৭০০ সিসির প্রতিটি জিপ গাড়ির দাম পড়বে ১,৬৯,৩৫,০০০ টাকা।
অর্থবিভাগের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পাঠানো প্রস্তাব পর্যালোচনা করছে অর্থবিভাগ। এখনও এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
এদিকে, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন টিবিএসকে বলেন, "এখন দেশে অর্থনৈতিক সংকট চলছে। পণ্যমূল্যের চাপে মানুষ জর্জরিত, গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে না পেরে অনেক ব্যাংকের ম্যানেজার পালাচ্ছে। এমন সময় এতোগুলো বিলাসবহুল গাড়ি কেনা হলে তা দেশবাসীকে 'রং সিগন্যাল' দেওয়া হবে।"
তিনি বলেন, "ডিসি ও ইউএনওদের অনেক শক্তিশালী জিপ গাড়ি দেওয়া হয়। আমরা সাধারণ গাড়ি ২০ বছর ব্যবহার করি। সেখানে ডিসি, ইউএনওদের জিপ গাড়িগুলো যে বসে গেছে, তা তো নয়। অন্তর্বতীকালীন সরকার অনেক সিদ্ধান্ত এখন না নিয়ে আগামী দিনের নির্বাচিত সরকারের জন্য রেখে দিচ্ছে। ডিসি, ইউএনওদের জন্য গাড়ি কেনার বিষয়টিও নির্বাচিত সরকারের জন্য রেখে দিতে পারে।"
"গাড়ির দরকার হলেও টাইমিংটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই মুহূর্তে ৩৩৯ কোটি টাকা কম নয়," বলেন ফাহমিদা খাতুন।
এ বিষয়ে কথা বলতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অধীন সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরের ট্রান্সপোর্ট কমিশনার মো আবুল হাসানাত হুমায়ূন কবিরের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি একঘণ্টা পর কল করতে বলেন। তবে একঘণ্টা পর তাকে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
গাড়ি কেনা নিয়ে আগের বিতর্ক
ডিসি, ইউএনওদের গাড়ি কেনা নিয়ে বিতর্ক এবারই প্রথম নয়।
গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সমালোচনার ভয়ে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি গোপনে ডিসি, ইউএনওদের জন্য ২৬১টি গাড়ি কেনার প্রস্তাব অনুমোদন করেছিল।
পরে বিষয়টি জানাজানি হলে, তা নিয়ে সমালোচনা হয় এবং এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় গাড়ি কেনা স্থগিত করে।
গত বছরের ১১ অক্টোবরে ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি ডিসি-ইউএনওদের জন্য ২৬১টি জিপ কেনার প্রস্তাবে সম্মতি দেওয়ায় সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় কেনা গাড়ির বর্তমান অবস্থা, কোন মানদণ্ডে এসইউভির দাম নির্ধারণ করা হয়েছে, মাঠ পর্যায়ে প্রশাসনের কতগুলো গাড়ি রয়েছে এবং তাদের অবস্থা কী— তা জানতে চায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। পরে অবশ্য গাড়িগুলো কিনতে অনুমোদন দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ওই সময় প্রতিটি গাড়ি কেনা হয় ১,৪৬,২০,০০০ টাকা দরে। এখন একই গাড়ির দাম বেড়ে ১,৬৯,৩৫,০০০ টাকা হয়েছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে জন প্রশাসন মন্ত্রণালয়।
এ হিসাবে, এখন প্রতিটি গাড়ি কিনতে অতিরিক্ত ২৩.১৫ লাখ টাকা ব্যয় হবে। এতে ২০০ গাড়ি কিনতে অতিরিক্ত ব্যয় হবে ৪৬.৩০ কোটি টাকা।
রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এর মাধ্যমে গাড়িগুলো কিনবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
সরকারের কৃচ্ছ্রতার নীতি
চলতি অর্থবছরের শুরুতেই কৃচ্ছ্রতাসাধন করতে মন্ত্রণালয়গুলোকে নির্দেশনা দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়।
গত ৪ জুলাই জারি করা নির্দেশনায় বলা হয়েছে, বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রতাসাধনের জন্য ২০২৪-২৫ অর্থবছরের পরিচালন বাজেটের আওতায় সকল প্রকার যানবাহন ক্রয়ের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় বন্ধ থাকবে।
তবে ১০ বছরের অধিক পুরনো টিওএন্ডইভুক্ত যানবাহন প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে অর্থবিভাগের অনুমোদন সাপেক্ষে ব্যয় করা যাবে। এছাড়া, উন্নয়ন বাজেটের আওতায় সকল প্রকার যানবাহন ক্রয় বন্ধ রাখা হয়েছে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরের আওতাধীন সরকারি সড়ক পরিবহন শাখার অনুকূলে মোটরযান ক্রয়খাতে ৩৭৭ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে।
ডিসি ও ইউএনওদের জন্য নতুন ২০০ গাড়ি কিনতে বাড়তি টাকা চেয়ে গত মাসে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় সরকারি যানবাহন অধিদপ্তর।
অধিদপ্তরের পরিবহন কমিশনার মো আবুল হাসানাত হুমায়ূন কবির স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, গত অর্থবছর ডিসি ও ইউএনও কার্যালয়ে ১৪ বছরের আয়ুষ্কাল উত্তীর্ণ হয়েছে এমন গাড়ির সংখ্যা ছিল ৪৬১টি। এর মধ্যে গত অর্থবছর ২৬১টি মিৎসুবিশি পাজেরো কিউএক্স জিপ কেনা হয়েছে।
এছাড়া, ৬৪ জন ডিসি এবং ১৯৭ জন ইউএনও ইউএনও'র গাড়ি বরাদ্দ কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
পরিবহন কমিশনার চিঠিতে লিখেছেন, সারাদেশে ৪৯৫ জন ইউএনওর প্রত্যেকের জন্য একটি করে জিপ গাড়ি রয়েছে। এর মধ্যে চলতি অর্থবছরের মধ্যে ১৪ বছর আয়ুষ্কাল শেষ হবে এমন গাড়ির সংখ্যা ৪৬১টি। গত মধ্যে গত অর্থবছরে প্রতিস্থাপন করার জন্য ১৯৭টি গাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হবে।
জনপ্রশাসনে গতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে ডিসি ও ইউএনওদের মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাসহ পরিবহন সেবা স্বাভাবিক রাখার জন্য বাকি ২০০ গাড়ি প্রতিস্থাপন করা প্রয়োজন বলে জানানো হয় চিঠিতে।
গত বছরের জুলাই মাসে বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের মূল্য নির্ধারণ করে অর্থ মন্ত্রণালয়। তাতে অনুর্ধ্ব ২৭০০ সিসির প্রতিটি জিপ গাড়ির মূল্য (রেজিস্ট্রেশন, ভ্যাট, ট্যাক্সসহ) নির্ধারণ করা হয়েছে ১,৪৬,২০০০০ টাকা।
গত অর্থবছরের বাজেটে সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরের জন্য মোটরযান কেনা বাবদ ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। তখন ৪৬১টি নতুন গাড়ি কিনতে আরও ৬১২.৩৪ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় ৩৮১ কোটি টাকা দিতে রাজি হয়। ফলে গাড়ির সংখ্যা কমিয়ে ২৬১টি কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়।