সরকারি চাকরি ছেড়েছেন, ৩০০ ছবির গল্প লিখেছেন, ৭৯ বছর বয়সেও এফডিসির ‘সিনিয়র ইয়াংম্যান’
নাম আসলে সৈয়দ উদ্দিন আহমেদ। সরকারি চাকরি করে দুটি কাজ করা যায় না, তাই নাম বদলাতে হবে। বাবা আদর করে ছোটকা বলে ডাকতেন। প্রথম প্রথম ছোটকা আহমেদ নাম নিয়ে কাজ চালিয়ে যেতে থাকলেন। কিন্তু ভালো শোনাচ্ছিল না। শেষে হাসান ইমাম ছোটকাকে ছটকু করে দিলে বেশ যুৎসই হলো। আর সে নাম নিয়েই তিনি গত চার দশক ধরে চলচ্চিত্র জগত মাত করে চলেছেন। হয়ে উঠেছেন খ্যাতিমান, পেয়েছেন যশ ও সম্মান।
চলচ্চিত্রে ছটকু আহমেদের আগমন একেবারেই হঠাৎ করে তা বলা যাবে না। ষাটের দশকে নারায়ণগঞ্জে যখন তার যুবকবেলা কাটছিল, তখনই তিনি মঞ্চনাটক, গীতি আলেখ্য তথা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন।
বাহাত্তর সালে 'তিতাস একটি নদীর নাম' চলচ্চিত্রটি করতে ঋত্বিক ঘটক বাংলাদেশে আসেন। তখন ছটকু আহমেদ ছিলেন ঠাকুরগাঁওয়ে ওয়াপদা ইরিগেশনের সেকশন অফিসার। তার নারায়ণগঞ্জের বন্ধু হাবিবুর রহমান খান 'তিতাস'-এর প্রযোজক ছিলেন। তিনি ঠাকুরগাঁওয়ে খবর পাঠালেন, 'ঋত্বিকের সহকারী হবে কি না তুমি?'
ছটকু ভাবলেন, এ সুযোগ তো বারবার আসবে না। তিনি চাকরি রেখে চলে এলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। একটা লঞ্চ ভাড়া নেওয়া হয়েছিল। পাত্র-পাত্রী ও সহকারীরা সেটায় চড়ে শুটিং করতেন।
কেমন লাগছিল কাজ করতে? গল্পের মাঝপথে জিজ্ঞেস করে বসলাম। ছটকু আহমেদ বললেন, 'ঋত্বিক ঘটক বলে কথা, কাজ তো উচ্চমানের। তবে আমার খুব হাইথটের কাজ ভালো লাগে না। আমি পছন্দ করি জনঘনিষ্ঠ ছবি; আমি কমার্শিয়াল প্যাটার্নের লোক। বোদ্ধা দর্শকের জন্য ঋত্বিক বাবু অতুলনীয়, কিন্তু সাধারণ দর্শকের কথা ভাবলে ব্যাপারটি আলাদা।'
এ সুযোগে আলাপের ঢংয়ে পরপর আরও কয়েকটি প্রশ্ন করে বসলাম, যার প্রথমটি ছিল নায়ক মান্নাকে নিয়ে। মান্না কেন জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন? ছটকু আহমেদ বললেন, 'কারণ তিনি সাধারণ মানুষের ভাষায় কথা বলতেন। দর্শক তাকে আপন ভাবত। তার প্রতিবাদী চরিত্রেরও ভক্ত ছিল দর্শকরা। বস্তিবাসী ও মেহনতী মানুষের পক্ষের চরিত্রগুলো করতেন।'
অল্প ছবি করেও সালমান শাহ কীভাবে দর্শকের মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন? ছটকু বললেন, 'সালমানের ছিল অফুরান আবেগ। আবেগ দিয়েই তিনি দর্শককে কাছে টেনে নিতেন। তার ওপর ছিলেন স্টাইলিশ। তার দুঃখ দেখলে দর্শক ভাবত, আহারে, এত সুন্দর ছেলেটার এত কষ্ট কেন?'
'এবার তবে শাবানার কথা বলুন। প্রচলিত আছে, শাবানা যেদিন থেকে এফডিসি ছাড়লেন সেদিন থেকে এফডিসির বিপদ শুরু হলো। কথাটা কি সত্যি?'
ছটকু আহমেদ বললেন, 'হ্যাঁ, সত্যি। শাবানা আমাদের চলচ্চিত্রের একটি বড় দর্শকগোষ্ঠী ধরে রেখেছিলেন। একটা কথা প্রচলিত আছে, শাবানা যে ছবিতে কাঁদেন, প্রযোজক সে ছবিতে হাসেন। তাই শাবানা ছবি করা ছেড়ে দেওয়ার পর ক্ষতিটা বেশ মারাত্মক হয়েছিল।'
জসিমের ব্যাপারে ছটকু বললেন, 'খুব মনোযোগী অভিনেতা ছিলেন। অ্যাকশন ছবিতে যেমন, সামাজিক ছবিতেও সফলতা পেয়েছেন। নায়কোচিত দেহগড়ন ও ভাব-সাব না থাকার পরেও আন্তরিকতা থাকার কারণে তিনি সাফল্য পেয়েছেন।'
এফডিসির 'ওয়ান অব দ্য মোস্ট সিনিয়র ইয়াংমেন' ছটকু আহমেদ। ধোপদুরস্ত পোশাক পরে দৃপ্ত পদক্ষেপে আজ ৭৯ বছর বয়সেও ঢাকার এমাথা-ওমাথা চষে বেড়ান। তিনি একাধারে নির্মাতা এবং কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচয়িতা। তিন শতাধিক চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেছেন তিনি।
সাধারণ দর্শক কী ধরনের ছবি পছন্দ করে? ছটকু আহমেদের ভাষ্যে, 'সাদা কথায়, যে ছবি বুঝতে কষ্ট হয় না, সে ছবি পছন্দ করে দর্শক। জহির রায়হানের 'জীবন থেকে নেয়া' বুঝতে কষ্ট হয়েছে? 'কাচের দেয়াল'? কাজী জহির কত সুন্দর সব ছবি করেছেন। ছিমছাম, জটিলতামুক্ত। এসব ছবি দেখতে কষ্ট হয় না। চলচ্চিত্র বৃহৎ গণমাধ্যম, আমি মনে করি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছালেই সেটা ভালো।'
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বেশ কিছুদিন শুটিং টিমের সঙ্গে থেকে ছটকু আবার ফিরলেন চাকরিতে। কিছুদিন পরে 'তিতাস' মুক্তি পেল। নাম, সুনাম, যশ, খ্যাতি পেলেন, কিন্তু টাকা উঠে আসেনি। ততদিনে ছটকু আহমেদ ঢাকা নারায়ণগঞ্জ ডেমরা (ডিএনডি) প্রকল্পে বদলি হয়ে এসেছেন। একদিন হাবিবুর রহমান বললেন, 'চলো আড্ডা মারতে মারতে ছবি বানাব।' ছটকু আহমেদ বললেন, 'কি রকম?'
হাবিবুর রহমান বুঝিয়ে বললেন, 'আমরা শাওন-সাগর [হাবিবুর রহমানের দুই ছেলে] নামে একটা প্রতিষ্ঠান বানাব। আড্ডা মারতে মারতে কিছু টাকা জমাব। তারপর ছবি বানাব।'
এ জে মিন্টু, তমিজউদ্দিন রিজভী, আওলাদ হোসেন চাকলাদার, ফখরুল হাসান বৈরাগীসহ সাতজনকে নিয়ে গঠিত হলো শাওন-সাগর লি.। ঠিক করা হলো, পালাক্রমে প্রত্যেকেই পরিচালক হবেন। অলিভিয়া ও প্রবীর মিত্রকে নিয়ে প্রথম যে ছবিটি করা হলো, তার নাম 'সেয়ানা'। পরিচালক ছিলেন ফখরুল হাসান বৈরাগী। কিন্তু ছবিটি চলল না।
এরপর বেবী ইসলামের একটি ছবি 'চরিত্রহীন'-এ হাবিবুর রহমান বিনিয়োগ করলেন, কিন্তু সেটিও চলল না। ততদিনে এ জে মিন্টুর পরিচালক হওয়ার পালা। তিনি বললেন, 'ঠান্ডা ছবি নয়, আমি একটা মারদাঙ্গা ছবি বানাব।'
তিনি বানালেন 'মিন্টু আমার নাম'। সুপার ডুপার হিট হলো সে ছবি। বোম্বের (এখন মুম্বাই) 'জনি মেরা নাম' ছবির আদলে তার চিত্রনাট্য লিখেছিলেন ছটকু আহমেদ। সেটিই তার প্রথম চিত্রনাট্য। তখন ভিডিও ক্যাসেটেও বোম্বের ছবি দেখার সুযোগ বেশি ছিল না। কেউ একবার দেখে এসেছিলেন, ভাসা ভাসা গল্পটি বলেছিলেন, আর তা থেকেই চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেছিলেন ছটকু আহমেদ। পরে শুনেছেন তার লেখা সংলাপ বোম্বের চেয়েও ভালো হয়েছিল। 'মিন্টু আমার নাম'-এ প্রধান পাত্র-পাত্রী ছিলেন সোহেল রানা ও ববিতা।
এ জে মিন্টুর পরে রিজভীর ডিরেক্টর হওয়ার পালা। কিন্তু সবাই বলল, মিন্টুর ছবি হিট হচ্ছে, ও আরেকটা ছবি করুক। পরে তিনি করলেন 'প্রতিজ্ঞা' এবং সেটিও সুপার ডুপার হিট। 'প্রতিজ্ঞা'-তে সব বড় বড় আর্টিস্ট ছিলেন—প্রবীর মিত্র, ফারুক, জসীম, ববিতা, নূতন।
এদিকে ছটকু আহমেদের প্রথম দুটি স্ক্রিপ্টই সুপারহিট। তাকে নিয়ে ফিল্মপাড়ায় টানাটানি পড়ে গেল। সবাই বলে, চলে আসেন। কিন্তু তখন তার নিজেরই সাগর-শাওনে ডিরেক্টর হওয়ার পালা। তিনি রাজ্জাক-ববিতাকে নিয়ে বানালেন 'নাতবৌ'। এটি ছিল একটি ফ্যামিলি ছবি। সুপার হিট না হলেও টাকাও মার যায়নি।
এমন অবস্থায় তখনকার বিখ্যাত এক পরিচালক মোতালেব হোসেন এলেন ছটকু আহমেদের বাসায়। বললেন, একটি চিত্রনাট্য লিখে দিতে। সঙ্গে দিয়ে গেলেন ২০ হাজার টাকা। এটিকেই বলা যায় ছটকু আহমেদের প্রথম বাণিজ্যিকধারার মৌলিক চিত্রনাট্য। ছবির নাম 'অশান্ত সংসার'। সুপার ডুপার হিট হলো সে ছবি।
ছটকু আহমেদের মতে, 'সংলাপই ছবির আশি ভাগ, নাচ-গান বাকি ২০ ভাগ। ভালো ভালো সংলাপে ছবি হিট হয়। যে ছবির গল্প মানুষ বলে আনন্দ পায়, সে ছবির প্রচার তত বেশি হয়, দর্শকও বেশি আসে।'
ছটকু আহমেদ পরিচালিত সুপারহিট ছবি 'সত্যের মৃত্যু নেই'তে মিশা সওদাগরের মুখে একটি ডায়ালগ ছিল—'ঐ ডায়ালগ কম, ডায়ালগ কম...'। এটি দর্শকের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়েছিল। 'আশা ভরসা' ছবিতে রিপিট ডায়ালগ দিয়েছিলেন—'কি কইছি? কি কইছি ক…।'
সাধারণত ভিলেনের মুখেই ডায়ালগ বেশি জমে। ডিপজলের মুখে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল 'সানডে মানডে ক্লোজ কইরা দিমু...'। নায়কের মুখেও ডায়ালগ জমে, যেমন কলকাতার এক ছবিতে মিঠুনের ডায়ালগ—'মারব এখানে, লাশ পড়বে শ্মশানে…' এখনো লোকমুখে ফেরে।
ছটকু আহমেদ আরও বলছিলেন, 'সংলাপ দর্শককে গল্প বুঝতে সাহায্য করে। সংলাপ ছাড়া অভিনয় জমে না। ভালো সংলাপ বলা একটি বড় গুণ।'
ছটকু আহমেদকে জিজ্ঞেস করলাম, 'চৌধুরী সাহেব নামে একটি দাম্ভিক, দাপুটে চরিত্র এফডিসির অনেক ছবিতেই দেখা যায়। এর কারণ কী?'
তিনি উত্তর দিলেন, 'চৌধুরী সাহেবের মেয়ের সঙ্গে কাজের ছেলের প্রেম একটি খুব শক্তিশালী প্লট। এখানে ধনী-গরিবের দ্বন্দ্ব দেখানো যায়। শেষে গরিবের জয় হলে দর্শক আনন্দ পায়।
'খান সাহেব নামেও একই রকম ধনী শ্রেণির প্রতিভূ থাকে, যারা মূলত গরিবের ধন আত্মসাৎ করে প্রাসাদ গড়েছেন। গরিবের ছেলে যখন খান সাহেবের মেয়ের মন জয় করে নেয়, তখন পুরো শোষিত শ্রেণীই বিজয়ের আনন্দ অনুভব করে। এতে ছবি যেমন ব্যবসাসফল হয়, আবার ন্যায়ের কাছে অন্যায় পরাজিত হয়। আমাদের ছবিতে যতই নাচ-গান থাকুক, এ বিজয় অনিবার্য।'
গল্প, চিত্রনাট্য ও সংলাপ লেখার উপকরণ কোথায় পান?
ছটকু আহমেদ: সাধারণত পরিচালক এসে ফরমায়েশ দেন পারিবারিক, সামাজিক অথবা রোমান্টিক ছবির। আমাদের দেশে এসব ধারার ছবিই বেশি চলে। আমি ছবির মূল চরিত্রকে ধরে গল্প এগিয়ে নিয়ে যাই। সমান্তরাল দুটি বা তিনটি প্লট নিয়ে কাজ আমরা করি না। আমাদের তেমন দর্শকও নেই। বুঝতে কষ্ট হয় বা মনোযোগ দিয়ে দেখতে হয়, এমন ছবি আমাদের এখানে চলে না। আমরা খেয়াল রাখি কতক্ষণ পরে দর্শককে হাসাব, কতক্ষণ পরে কাঁদাব বা কখন ধাক্কা দেব।
ফখরুল ইসলাম বৈরাগী চিত্রনাট্য লেখার একটা ফর্মুলা বের করেছিলেন। তিনি একটি রুমাল বিছাতেন টেবিলের ওপর। একটা একটা করে কোনা ভাঁজ করতেন, তারপর বলতেন, ইন্টারভেল বা বিরতির আগে চারটি প্যাঁচ দিবা আর ইন্টারভেলের পরে প্যাঁচগুলো খুলবা, তাহলেই ছবি হয়ে যাবে। আমরা অবশ্য তার ধারা বেশি অনুসরণ করি না।
কাহিনীর শুরুতেই একটি চমক রাখার চেষ্টা করি। যেমন, একটি অ্যাম্বুলেন্স তীব্র শব্দে হাসপাতাল অভিমুখে ছুটে চলেছে। হাসপাতালের বিছানায় ওঠানোর পরে নায়ককে দেখানো হলো। তিনি তীব্র বেদনায় কাতরাচ্ছেন। রাস্তায় বদমাশ লোকজনের হাত থেকে এক সুন্দরী মেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে তার এ দশা। এদিকে হাসপাতালের নার্স তাকে মনপ্রাণ দিয়ে সেবা করে সারিয়ে তোলে। নায়ক মন দিয়ে ফেলেন নার্সকে, ওদিকে বদমাশদের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া সুন্দরী মেয়েটি মন-প্রাণ সঁপে দিয়েছে নায়ককে। নায়ক পড়ল বিপাকে—সে কাউকেই কষ্ট দিতে চায় না। এ ত্রিমুখী প্রেম নিয়ে এফডিসিতে অনেক ছবি হয়েছে। এ প্রেমের জট ছাড়ানোর কাজটিই আমরা করি।
আরেকটি প্যাটার্নের ছবি হয়েছে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক, সেটি হলো লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড। কোনো এক ঝড়ে বাবা-মা থেকে সন্তানরা আলাদা হয়ে যায়। তারপর তারা শহরের অলিগলিতে বড় হয়ে ওঠে। একটি ক্রাইসিস মোমেন্টে সবাই একত্রিত হয় এবং পরস্পরের পরিচয় জানতে পারে।
ছটকু আহমেদ স্বীকার করলেন, আমাদের দেশের ছবিতে চিৎকার হয় অনেক বেশি। এটা এসেছে যাত্রাপালা থেকে। দর্শক উত্তেজনা পছন্দ করে। নায়ক যখন চিৎকার করে বলে, 'চৌধুরী সাহেব আপনি বড়লোক হতে পারেন, কিন্তু মন বোঝার ক্ষমতা আপনার নেই,' তখন দর্শকের হাততালিতে কান পাতা দায় হয়। আবার কেঁদে বুক ভাসানোর ছবিও হয়। সেগুলোর দর্শক মূলত নারীরা। ছবির নায়িকা অসহায় হলে তার কান্নায় দর্শকও ভেসে যায়।
'সত্যের মৃত্যু নেই' ছবির গল্পটি ছটকু আহমেদ পেয়েছিলেন অদ্ভুতভাবে। প্রযোজক পানাউল্লাহ আহমেদ বলেছিলেন, 'মা ছেলের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেয়, ছেলের তাই ফাঁসির দণ্ডাদেশ হয়।' এ বাক্যটিকেই চিত্রনাট্যে পরিণত করেন ছটকু আহমেদ। ছেলে যখন জেলখানায় দণ্ডাদেশ কার্যকর হওয়ার প্রহর গুনছে, তখন আচম্বিত মা জানতে পারে তার ছেলে দোষী নয়। এবার ছেলেকে বাঁচানোর নতুন লড়াইয়ে নামে সে এবং লড়াইয়ে জিতে যায়। সে কারণেই ছবির নাম 'সত্যের মৃত্যু নেই'।
আপনারা অনেক সময় ইংরেজি সংলাপ রাখেন, অথচ নায়ক-নায়িকা তা বলার ক্ষমতা রাখেন না। তাহলে কেন?
ছটকু আহমেদ: কিছু ছবিতে দেখবেন নায়িকা বিদেশফেরত। তখন গল্পের প্রয়োজনেই তাকে দুটি ইংরেজি বাক্য বলাতে হয়। আবার কোনো কোনো নায়ক-নায়িকা এসে আবদার করেন ইংরেজি ডায়লগ রাখার জন্য, যেন লোকে তাকে শিক্ষিত ভাবে। অথচ ইংরেজি বলার জন্য লেখাপড়া লাগে। একদিনেই হয়ে যাওয়ার বিষয় নয়। এটা অনেকটা অনুরোধে ঢেঁকি গেলা।
সংলাপ লিখেছেন একজনের জন্য, ছবিতে নেওয়া হয়েছে আরেকজনকে—এমন কি হয়েছে?
ছটকু আহমেদ: হ্যাঁ, হয়েছে। আমি পরিচালককে জিজ্ঞেস করেছি, আপনার পাত্র-পাত্রী কে? তিনি ধরুন শাকিব খানের নাম বলেছেন। আমি সংলাপ লিখেছি শাকিবের মেজাজ ও ভঙ্গি বুঝে। পরে দেখি ছবিতে নেওয়া হয়েছে আরেকজনকে, যার ভাব-ভঙ্গি অনেকটাই ভিন্ন। আমি বলেছি, ডাক্তারের কাছে অসুখ লুকালে লোকসানই বেশি।
এক সময়ের অনেক ছবিতেই 'তালাক... তালাক...' সংলাপ থাকত। সাধারণত মাতব্বরের স্ত্রীরা এমন অনাচারের মুখে পড়তেন। বাস্তবে এর প্রভাব কি পড়ত না?
ছটকু আহমেদ: প্রথমত, এটি খুব ভারী শব্দ। এটা শোনার পর অনেকের হার্ট অ্যাটাকও হয়ে যেতে পারে। আমরা লিখতাম, 'তালাক শোনার পর রাবেয়া মাথা ঘুরে পড়ে গেল।' বাস্তবে এর ভালোই প্রভাব পড়ত, যেহেতু চলচ্চিত্র একটি বৃহৎ শিল্প মাধ্যম। তবে এটাও সত্য, আমরা যারা কাহিনী লিখি, তারা কিন্তু সমাজের অবস্থা বিচার করেই লিখি। সমাজে যদি হানাহানি চলে, তবে ছবিতে তার প্রভাব দেখবেন। দর্শকও সেটাই দেখার আগ্রহ প্রকাশ করে। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেক কিছুই ছবিতে না দেখানোর পক্ষে, কারণ এগুলো সমাজে প্রভাব ফেলে।
আপনার ছবির নামগুলো খেয়াল করলে দেখা যায়, সময় যত গেছে, ছবি ততই মারকুটে হয়েছে। এটি কি ভালো হয়েছে?
ছটকু আহমেদ: ছবিতে ব্যবসাই প্রধান বিষয়। ছবির গুণাগুণ বিচার হয় ব্যবসায়িক সাফল্য দিয়ে। আগেই বলেছি, সমাজ যখন যেমন, ছবিও তেমনই হয়। সমাজ থেকে উপাদান নিয়েই ছবির গল্প তৈরি হয়। তাই বিরাশি, নব্বই, পঁচানব্বই বা দুই হাজার সালে সমাজের চাহিদা মনে রেখেই 'নাতবৌ', 'সত্যের মৃত্যু নেই' বা 'মাথা নষ্ট' তৈরি হয়েছে।
বাণিজ্যিক ছবির ব্যাপারে অনেকেরই মন্দ ধারণা আছে। আপনি এটাকে কীভাবে দেখেন?
ছটকু আহমেদ: না, বাণিজ্যিক ছবি খারাপ কিছু নয়। চলচ্চিত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর কথা মাথায় রেখে তৈরি হলেই ভালো। ছবি যেমন অবোধ্য হওয়া ঠিক নয়, আবার শুধুই মনোরঞ্জনের জন্য হওয়াও ঠিক নয়। আমরা ছাত্রাবস্থায় 'ক্রেইনস আর ফ্লাইং', 'রোমান হলিডে', 'ব্যালাড অব আ সোলজার', 'বেনহার' দেখে দারুণ আনন্দ পেয়েছি। আমার মনে হয়, ছবি মাঝামাঝি পর্যায়ের হওয়া ভালো।
আপনি বলিউডের কোন চিত্রনাট্যকারকে পছন্দ করেন?
ছটকু আহমেদ: আমার পছন্দের চিত্রনাট্যকার হলেন বলিউডের সেলিম-জাভেদ (সেলিম খান ও জাভেদ আখতার)। বলা হয়ে থাকে, সত্তরের দশকে তারা বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছিলেন। বলিউডে তারাই অ্যাংরি ইয়ং ম্যান, স্প্যাগেটি ওয়েস্টার্ন, মশলা ফিল্ম, আন্ডারওয়ার্ল্ড ক্রাইম ফিল্মের ঘরানার সূচনা করেন। তাদের লেখা 'জাঞ্জির', 'দিওয়ার', 'শোলে', 'হাতি মেরে সাথি', 'শক্তি', 'মিস্টার ইন্ডিয়া', 'দোস্তানা', 'জামানা'—বলিউডকে বিত্ত, বৈভব, ইজ্জত সবই দিয়েছে। সমগ্র ভারতকে এক অদৃশ্য সুতায় গেঁথে দিয়েছিলেন সেলিম-জাভেদ। তারাই আমার প্রেরণা।
ঢাকাই ছবির আজকের দুরবস্থার পেছনের কারণ কী?
ছটকু আহমেদ: কারণ একটা নয়, অনেকগুলো। একদিনে তৈরি হয়নি। আমাদের এখানে আর্টিস্ট সংকট, মেধার সংকট ব্যাপক। সবাই যেন সবকিছু জেনে-বুঝে বসে আছে। একজন প্রযোজক ধরে আনতে পারলেই যে কেউ পরিচালক হয়ে যেতে পারেন। তারপর সিনেমা হলগুলো হলো গুদামঘর। দর্শককে যা ইচ্ছা গিলিয়ে দেবেন, এটা ভাবলে তাকে অপমানই করা হয়। অপমান সয়ে দর্শক কতদিন হলে আসবে?
ছবি সৌজন্য: ছটকু আহমেদ