‘বামে প্লাস্টিক, সামনে পোকা’: বাস হেলপারদের আরও যত সাংকেতিক কথাবার্তা
আটাশি সালে ডালিমের বয়স ছিল তেরো। চিড়িয়াখানা-টু-সদরঘাট বাসের হেলপার ছিলেন তিনি। দিনে ৭-৮টি ট্রিপ দেওয়া তখন কোনো ব্যাপার ছিল না। কারণ রাস্তায় তখন এতো প্লাস্টিক ছিল না! এই প্লাস্টিক মানে হলো প্রাইভেট কার। ওস্তাদ বাঁয়ে প্লাস্টিক কথাটারও চল ছিল না সেসময়। যতটা মনে করতে পারেন ডালিম, নব্বইয়ের মাঝামাঝিতে কথাটার চল হয়।
দিনে দিনে ঢাকার রাস্তায় গাড়ি বাড়ছিল, বাড়ছিল মানুষ। বাসের ভেতরে আর বাইরে ঝগড়া-ঝাটিও বাড়ছিল। ওস্তাদ ও হেলপারকে চোখ-কান খোলা রাখতে হচ্ছিল আগের তুলনায় অনেক বেশি। কারণ সামনে রিকশা, বামে প্রাইভেট কার, পেছনে পিক আপ, মোড়ে সার্জেন্ট। ভেতরে যাত্রীরাও উত্তেজিত। দু'মিনিট পর পরই খ্যাচ (ঝগড়া) লেগে যাচ্ছে ভাড়া নিয়ে বা গাড়ির গতি নিয়ে। তবে বেশি সমস্যা ওই প্লাস্টিক নিয়েই। একটু গায়ে লাগলেই ট্যাপ খেয়ে যায়। বড়লোকের বাহন বলে ক্ষমতাও বেশি। তাই মামলা দিতে দেরি করেন না সার্জেন্ট। তখনই ওস্তাদ শিখিয়ে দিলেন, 'বাঁয়ে প্রাইভেট কার থাকলে বলবি, ওস্তাদ প্লাস্টিক'। এটুকু বলতে সময় লাগে কম, ড্রাইভার সতর্ক হওয়ার সময় পান বেশি।
'এগার ট্রিপের পিলিয়ার'
২০০০ সালের দিকে ওস্তাদ (গাড়ির ড্রাইভার) হলেন ডালিম। তখনো আজকের মতো ভিড় ছিল না। গাড়ি চালানোয় ডালিমের এতো দক্ষতা ছিল যে, শিকড় গাড়ির রেজিস্ট্রার খাতায় তার নামের পাশে লেখা হয়েছিল, '১১ ট্রিপের পিলিয়ার' (প্লেয়ার)।
সেই ডালিম (মিরপুর সুপার লিংকের ড্রাইভার এখন) আক্ষেপ করে বললেন, হাতখুলে গাড়ি চালাতেই পারি না। আধা কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে আধাঘণ্টা পার হয়ে হয়ে যায়। মানিক মিয়া এভিনিউ শেষ করে আড়ংয়ের মোড় থেকে ২৭ নম্বরের দিকে যেতে একাধিক সিগন্যাল পেরুতে হয়। বাস যদি থাকে ৪টা, প্রাইভেট কার দেখবেন ২০টা, মোটরসাইকেল ৬০-৭০টা।
"আমরা গাড়ি ঘোরালেই এর-ওর গায়ে লেগে যায়, অন্যদিকে ভেতরের যাত্রীরা খ্যাচখ্যাচ করে, 'ওই ড্রাইভার, গাড়ি চালাও না রিকশা?' ভেতরে–বাইরে সব বিপদ গাড়ির স্টাফদের।"
ডালিমের দুঃখ হয় বড়লোকের বিচারবুদ্ধি দেখে। তিনজনের পরিবারের চারটি গাড়ি। একটিতে করে স্যার অফিস যান, অন্যটিতে ম্যাডাম বিউটি পার্লারে। বাবুর স্কুলের ডিউটি করে তৃতীয় গাড়িটি। আরেকটি গাড়ি থাকে এক্সট্রা, বাজারঘাট ইত্যাদি কাজের জন্য। এতগুলো গাড়ি রাস্তায়, মানুষ মাত্র তিনজন, জায়গা দখল করে কতখানি!
গায়ে একটু আচড় লাগলেই বাস ড্রাইভার বা মালিকের দিনের কামাই শেষ। পাঁচটি কাগজ নিয়ে ড্রাইভারকে পথে নামতে হয়— ফিটনেস সার্টিফিকেট, ট্যাক্স টোকেন, ড্রাইভারের লাইসেন্স ইত্যাদি। একটা মামলা মেটাতে ২০ দিন সময় পাওয়া যায়।
'নম্বর' ও 'কাপঝাঁপ'
ডালিমের সঙ্গে দেখা মিরপুর–১২ নম্বর বাসস্ট্যান্ডে। একটি টেবিল আর তিনটি টুল নিয়ে বাসের সিরিয়াল রাখার দপ্তর আছে এখানে। একদিন পর একদিন ডালিম বিশ্রামে থাকেন। আরও যেসব কন্ডাক্টর–ড্রাইভারের ফুরসত থাকে, তারাও এখানে আসেন। বিশ্রামের দিনেও গাড়ির আশপাশেই ঘোরাঘুরি করে সময় কাটান তারা।
যেদিন গাড়ি চালান, সেদিন ভোর সাড়ে চারটায় ঘুম থেকে ওঠেন ডালিম। তারপর ৬টায় গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে বসেন, রাত ১১টা পর্যন্ত টানা ডিউটি দেন। দুপুরে খাওয়ার জন্য বরাদ্দ থাকে মাত্র ১০ মিনিট। তারপর গাড়ি বন্ধ করতে করতে আরও ঘণ্টাখানেক যায়। হিসাব-নিকাশ মালিককে বুঝিয়ে দিয়ে যেদিন হাজারখানেক টাকা নিয়ে ঘরে যেতে পারেন, সেদিন খুশি হয়ে যান।
ডালিমের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আরও দু-চারজন কাছে-পিঠে এসে বসলেন। তাদের মধ্যে একজন হেলপার কাম কন্ডাক্টর সবুজ। সবুজ জানালেন, আগে বাসে স্টাফ থাকত তিনজন, এখন দুজন দিয়ে কাজ চালাতে হয়। কারণ ইনকাম কমে গেছে। রোডে অনেক বাস। একই নম্বরের গাড়িও অনেক। তাই প্রতিযোগিতা বেশি। একই নম্বরের গাড়িগুলোই বেশি প্রতিযোগিতায় নামে, যেহেতু তাদের যাত্রী এক গন্তব্যের।
নম্বর হলো রোড নম্বর। যেমন মিরপুর সুপার লিংকের রোড নম্বর ৩৬। গুলিস্তান টু এয়ারপোর্টের গাড়ির গায়ে লেখা থাকে ১৩২ নম্বর। একই নামের গাড়িগুলোও একই রোড নম্বরের হয়ে থাকে। পিছন দিক থেকে আসা একই নম্বরের গাড়িকে সামনের গাড়িটি চেষ্টা করে যেভাবেই হোক পথ আটকাতে। পিছনের গাড়িটিও সামনেরটিকে অতিক্রম করার সুযোগ কোনোভাবেই ছাড়তে চায় না। কারণ যে আগে যাবে সে-ই সামনের স্ট্যান্ডের যাত্রী তুলে নিতে পারবে। এই রেস করার প্রক্রিয়াটিকে সবুজরা বলেন 'কাপঝাঁপ' মানে হুড়োহুড়ি।
'কড়কড়া হেলপার'
আড্ডায় এরমধ্যে এসে যোগ দিয়েছেন জন। পঞ্চাশের বেশি হবে বয়স। ভারী গলা ও চওড়া শরীরের লোক। ইংরেজিও বলেন টুকটাক। নিজের পরিচয় নিজেই দিলেন, "আমি মোহাম্মদপুর রুটের তরঙ্গ বাস চালাই। এই যে ডালিম, সে আমার ওস্তাদ। তার গাড়িতে আমি ভাড়া কাটতাম। আগে ওস্তাদদের বিরাট সম্মান ছিল। হেলপার, কন্ডাক্টররা সব সময় তার মন বুঝে চলত। ওস্তাদের অনুমতি না নিয়ে স্টিয়ারিংয়ের কাছেও যেত না। এখন একজন কড়কড়া হেলপার পাওয়া অনেক কঠিন। তার দাম কখনো কখনো ড্রাইভারের চেয়েও বেশি। একজন কড়কড়া হেলপার থাকলে একজন ড্রাইভারের কাজ অর্ধেক কমে যায়।"
কড়কড়া মানে দক্ষ ও অভিজ্ঞ। কড়কড়া হেলপার যে বাসে থাকে তার দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমে যায়, যাত্রী ওঠে বেশি বলে ইনকামও বাড়ে। বাস প্যাকেট (দাঁড়ানো যাত্রীর সংখ্যা পনেরোর বেশি) হয়ে গেলে কড়কড়া হেলপার ড্রাইভারকে জানান দেয়, 'জমাইয়া চালান ওস্তাদ'। মানে যাত্রী অনেক, ভাড়া কাটা হয় নাই, স্লো চালান ।
'পোকা' মানে যাত্রী
জন বললেন, "আগের দিনে একটি লুকিং গ্লাস ভাঙলে ঠিক করাতে লাগত ৭ দিন। তাই হেলপারের ওপর নির্ভরশীলতা ছিল বেশি। এখনকার ড্রাইভার অনেক চৌকস। প্রতি চার সেকেন্ডে একবার বামের গ্লাসে তাকান, ডানেরটায় তাকায় মুহুর্মুহু। এখনকার সমস্যা হলো, টেনশন। প্রতিটা সময় ড্রাইভারকে হুঁশে থাকতে। তার একটুও বেদিশা হওয়ার সুযোগ নেই।
তাই হেলপারর ও ড্রাইভারের মধ্যে যোগাযোগ তৈরির জন্য বিশেষ কিছু শব্দ তৈরি হয়েছে, যা সময় বাঁচায়। যেমন— পোকা। এর অর্থ হলো যাত্রী।
এটি কাউকে ছোট বা অসম্মান করার জন্য নয় বরং বলতে সুবিধা। যাত্রী বলতে যত সময় লাগে পোকা বলতে তার চেয়ে কম সময় লাগে। শব্দটি বিশেষ বলে ড্রাইভার মনোযোগীও হন। তাই হেলপার বলেন, 'ওস্তাদ সামনে পোকা (যাত্রী) আছে, ঠিক মতো পার্ক করেন।'
ঘর পালানো, ঘাড়ত্যাড়া কিশোর-যুবারাই হেলপার হয়ে থাকেন। পরে একসময় তারা ড্রাইভার হন। তাদের মধ্যে প্যাচঘোচ কম, সোজাসাপ্টা বুদ্ধিশুদ্ধি তাদের। সারা পৃথিবীর সব বাস স্টাফই একরকম হয়ে থাকেন, স্বাধীনচেতা, সোজা বুদ্ধির বলে জানালেন জন।
'টিপ' ও 'ডবল'
আরো দুটি শব্দ জানলাম জনের কাছ থেকে। সেগুলো হলো টিপ ও ডবল। টিপ মানে গুড়াগাড়া যানবাহন; যেমন— বাইক, ঠ্যালাগাড়ি ইত্যাদি।
ডবল হলো— প্রাইভেট কার, তবে একটি নয় একাধিক।
ডালিম বললেন, "বাসের স্টাফদের মতো ধৈর্যশীল মানুষ পাবেন না। প্রতিদিন কমপক্ষে ৫০০ জনের সঙ্গে আমাদের লেনদেন করতে হয়। সবাই খারাপ ব্যবহার করেন তা নয়, তবে অধিকাংশেরই ধারণা বাসের স্টাফরা মানুষ ভালো না, তারা নিম্নশ্রেণির। গালি না দিলে তাদের সোজা রাখা যায় না। অনেকে গায়ে হাত পর্যন্ত তোলে। এ কারণে আমাদের সমাজজীবন বলতে কিছু নেই। আমাদের বন্ধু বলতে গাড়ির স্টাফরাই।"
বাসের যাত্রীদের মধ্যে কোন বয়সীরা কিছুটা কোমল?— জিজ্ঞেস করলে ডালিম বললেন, "৪০ বছরের বেশি বয়সীরা সাধারণত ভালো ব্যবহার করেন। তাদের মধ্যে কর্মজীবীরা অফিস টাইমে কিছুটা উত্তেজিত থাকেন। নইলে তারা বাস স্টাফদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন না। ভাড়া নিয়ে তো একদমই খ্যাচ করেন না।"
'এখানে কি টেলিভিশন'
সাম্প্রতিককালে বাসে মধ্যবিত্ত মানুষরাও যাত্রী হন। জনের ভাষায় 'স্ট্যান্ডার্ড' লোক প্রচুর ওঠেন বাসে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী এবং কর্মজীবী নারীরাও ওঠেন। সুন্দর দেখতে কোনো মেয়ে উঠলে সেখানে একটা জটলা তৈরি হয়। মেয়েটিকে ঘিরে লোক দাঁড়িয়ে যান এবং তাদেরকে সেখান থেকে নড়ানো যায় না। কন্ডাক্টর সবুজের কাছে এটা খুবই বিরক্তিকর।
জটলা সাধারণত যুবকদের চেয়ে মধ্যবয়সীরাই করেন বেশি। তখন সবুজরা বিদ্রুপ করে বলেন, 'কী ভাই, এখানে কি টেলিভিশন? পিছনে তো অনেক জায়গা খালি।'
জনের মতে, সাম্প্রতিক সময়ে বাসের স্টাফদের আচার আচরণেও কিছু পরিবর্তন এসেছে। যেমন আগে বলা হতো, 'লেডিজ নামবে'। এখন বলা হয়, 'মহিলা নামবে'। জনের কাছে 'লেডিজ' শব্দটি উত্তেজক মনে হয়। আরও অনেকের কাছেই হয়তো মনে হয়ে থাকবে। তাই ধীরে ধীরে শব্দটি 'মহিলা'য় বদলে গেছে। লেডিজের তুলনায় মহিলা শব্দটি কিছুটা ভদ্রোচিত।
এভাবে কথায় কথায় অনেক বেলা হলো। টিপ টিপ বৃষ্টি ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরতে লাগল। শেষ প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করলাম, 'আপনারা খুশি হন কখন?' ৭-৮ জন একসঙ্গে উত্তর দিলেন।
সবগুলো উত্তর মিলিয়ে একটাই কথা দাঁড়ায়, তা হলো, গাড়িটা বন্ধ করতে পারলে খুশি লাগে। বেশি খুশি লাগে যদি পকেটে হাজারখানেক টাকা নিয়ে ঘরে ফেরা যায়।