প্রায় অর্ধেক খাতেই নিয়মিত বেতন বৃদ্ধি হয় না: গবেষণা
বাংলাদেশের সর্বনিম্ন মজুরি বোর্ডের তত্ত্বাবধানে থাকা প্রায় অর্ধেক খাতে নিয়মিত বেতন বাড়ানো হয় না বলে এক গবেষণায় উঠে এসেছে। ৪২টি খাতের মধ্যে ২০টি খাতই—প্রায় ৪৮ শতাংশ—কর্মীদের বেতন বাড়ায়নি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অভ লেবার স্টাডিজ (বিলস) গতকাল (২৭ অক্টোবর) 'মজুরি নির্ধারণে নিম্নতম মজুরি বোর্ডের সুযোগ, চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ পথ' শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় এই গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করে। রাজধানীর দ্য ডেইলি স্টার সেন্টারে এই আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুযায়ী, সর্বনিম্ন মজুরি প্রতি পাঁচ বছরে একবার পর্যালোচনা ও হালনাগাদ করার কথা। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, এই ২০টি খাত নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে বেতন বাড়ায়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিয়মিত মজুরি পর্যালোচনা না থাকা, নির্ধারিত পাঁচ বছরের সময়সীমা অনুসরণে ব্যর্থতা, নিয়োগকর্তা ও কর্মী উভয়পক্ষ থেকে প্রতিনিধির রাজনৈতিক প্রভাব এবং অপর্যাপ্ত প্রস্তুতি সাধারণ সমস্যা।
ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে অ্যালুমিনিয়াম ও গ্লাস এনামেল, অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ, বেকারি, বিস্কুট ও কনফেকশনারি, ট্যানারি, জাহাজভাঙা, চা প্যাকেজিং, ওষুধ, সাবান ও প্রসাধনী, হোটেল ও রেস্টুরেন্ট, স্থলবন্দর, পাট প্রেসিং এবং বেলিং, দেশলাই শিল্প, কোল্ড স্টোরেজ, লবণ উৎপাদন, তেলের মিল, সবজি প্রক্রিয়াজাতকরণ ইত্যাদি।
নিম্নতম মজুরি বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, কিছু খাত গত ২০ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে মজুরি বাড়ায়নি। উদাহরণস্বরূপ, পেট্রোল পাম্প খাত সর্বশেষ মজুরি নির্ধারণ করেছে ১৯৮৭ সালে।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, মজুরি বোর্ড গঠন হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে নতুন মজুরি প্রস্তাব দিতে পারেনি।
গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপনকালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'তৈরি পোশাক খাতের মজুরি প্রস্তাব করতে মজুরি বোর্ড সাত মাস সময় নিয়েছে। অন্যদিকে ট্যানারি খাতের জন্য ১৩ মাস, চিংড়ি খাতের জন্য ১৮ মাস ও চা খাতের জন্য প্রায় ৪ বছর সময় লেগেছে।'
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, মজুরি বোর্ডে কর্মী প্রতিনিধিদের নির্বাচনের প্রক্রিয়া বিতর্কিত। মজুরি নির্ধারণের হিসাব কীভাবে করা হয়, তার কোনো স্পষ্ট তথ্য-উপাত্ত নেই, হিসাব প্রকাশ করা হয়নি এবং স্বতন্ত্র সদস্য আলাদাভাবে মজুরি হিসাব করেননি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে এবং ঘোষিত মজুরি কর্মীদের সন্তুষ্ট করেনি।' প্রতিবেদনে একটি জাতীয় নিম্নতম মজুরি স্থাপন এবং নিয়মিত মজুরি পর্যালোচনার আহ্বান জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশ অ্যাপারেল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি মো. তৌহিদুর রহমান বলেন, 'জাতীয় নিম্নতম মজুরি এখন সময়ের দাবি।'
অন্যান্য শ্রমিক নেতা ও বিশেষজ্ঞরাও এই আহ্বানের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, জাতীয় নিম্নতম মজুরি দেশের সব খাতের জন্য একটি মানদণ্ড স্থাপন করবে।
কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের আইনি কর্মকর্তা মাসুম বিল্লাহ বলেন, 'আমরা ইতিমধ্যেই জাতীয় মজুরি নীতির একটি খসড়া চূড়ান্ত করেছি।' এছাড়াও শ্রমিক নেতারা মজুরি বোর্ডের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব কমানোর দাবি জানান।
শ্রম অধিকার সংস্থা আওয়াজ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক নাজমা আক্তার বলেন, 'প্রধানমন্ত্রীই যদি মজুরি বাড়ান বা মজুরি নির্ধারণে হস্তক্ষেপ করেন, তাহলে মজুরি বোর্ডের কী প্রয়োজন?'
পোশাক কর্মীদের জন্য নিজের মজুরি প্রস্তাব উপস্থাপন করার পর পরোক্ষ হুমকি পাওয়ার কথা জানান নাজমা। তিনি বলেন, 'আমি ফেসবুকে একটি মজুরি প্রস্তাব পোস্ট করার পর আমাকে বলা হয়েছিল, "এই তথ্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে গেছে।"'
উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাব মোকাবিলা করতে মজুরি পর্যালোচনার সময়সীমা পাঁচ বছর থেকে কমিয়ে আনার প্রস্তাব করেছেন শ্রমিক নেতারা।
শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের প্রতিনিধি রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, 'যারা মজুরি বোর্ডে কাজ করেন, বিশেষ করে কর্মী প্রতিনিধিরা, তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খতিয়ে দেখা উচিত। কারণ, মজুরি ঘোষণার পর অনেকের অ্যাকাউন্টই ফুলে-ফেঁপে ওঠে।'
'বাহ্যিক চাপে বেতন সমন্বয়'
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রকল্প ব্যবস্থাপক নীরণ রামজুথান এশিয়া ফ্লোর ওয়েজ অ্যালায়েন্সের তথ্যের বরাত দিয়ে বলেন, 'বেতন অনিয়মিতভাবে সমন্বয় করা হয়। কাজটি সাধারণত বাহ্যিক চাপে করা হয়। এতে বোর্ডের সক্রিয় ভূমিকা সীমিত হয়ে পড়ে।'
তিনি আরও বলেন, 'এর ফলে মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে বেতনে বৈষম্য তৈরি হতে পারে।'
তিনি আরও জানান, মজুরি বোর্ড কাগজভিত্তিক প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভরশীল, যা মজুরি নির্ধারণ প্রক্রিয়াকে ধীর করে দেওয়ার পাশাপাশি স্বচ্ছতা কমায়। মজুরি পর্যালোচনা ও ট্র্যাকিং সিস্টেম ডিজিটালাইজ করলে কার্যকারিতা ও দায়বদ্ধতা বাড়বে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আইএলও বিশেষজ্ঞ নিয়মিত মজুরি সমন্বয় শিডিউল প্রণয়ন, ডিজিটাল সিস্টেম আরও উন্নত করা এবং সামাজিক অংশীদারদের সঙ্গে পরামর্শ জোরালো করার পরামর্শ দেন।
নিম্নতম মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান মামুনুর রশিদ বলেন, 'বাংলাদেশের কর্মীদের অবস্থা শোচনীয়।'
বিলসের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ শ্রমিকবিরোধ মূলত মজুরিকেন্দ্রিক। কাজেই আমাদের এ বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে।'
বিলসের মহাসচিব নজরুল ইসলাম খান ও সেক্রেটারি আবুল কালাম আজাদও আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন।