রাষ্ট্রপতির অপসারণ নিয়ে সংলাপ: ঐকমত্য নেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতাদের সাথে প্রথম দফা সংলাপে, বিএনপি-সহ বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলই রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের অপসারণ প্রসঙ্গে 'সাংবিধানিক সংকট' তৈরি হওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করেছে।
রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের বিষয়ে ৩০টি রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে পৃথক সংলাপ সম্পন্ন করেছে। এর মধ্যে ২৬টি দল সাংবিধানিক সংকট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। একইসাথে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে অপসারণ করার ব্যাপারে রাজনৈতিক ঐকমত্য গঠন, আদালতের আশ্রয় নেওয়া এবং নতুন রাজনৈতিক সংকট পরিহারের পরামর্শ দিয়েছে দলগুলো।
তবে জামায়াতে ইসলামী, এবি পার্টি, ইসলামী আন্দোলন ও গণঅধিকার পরিষদের একাংশ সাংবিধানিক সংকটে গুরুত্বারোপ করছে না। তারা বলছে, সাহাবুদ্দিনকে পদে রাখার জন্য সংবিধানকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা উচিত হবে না।
ছাত্রনেতারা জানিয়েছেন, এ বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে শিগগিরই দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফা সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে।
অন্তর্বর্তী সরকার জানিয়েছে, এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তারা ঐকমত্যে পৌঁছবে।
গত ২৭ অক্টোবর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সাংবাদিকদের বলেন, "রাষ্ট্রপতির অপসারণ বা পদত্যাগের বিষয়ে একটি রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হচ্ছে। রাজনৈতিক ঐকমত্যের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।"
তিনি বলেন, "এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। আমরা তাড়াহুড়ো করতে পারি না, আবার খুব বেশি দেরিও করতে পারি না।"
সংলাপের পর কী বলছে রাজনৈতিক দলগুলো?
বিএনপি: এ ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারকে হঠকারী কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
তিনি বলেছেন, "গণ–অভ্যুত্থানের ফসলকে ঘরে তোলার জন্য বাংলাদেশের বিপ্লবকে যদি সংহত করতে হয়, তাহলে হঠকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। এটা সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় হওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি। তার জন্য বেশি প্রয়োজন অতি দ্রুত নির্বাচনকেন্দ্রিক সংস্কার শেষে নির্বাচন করা।"
জামায়াত: এদিকে, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পারওয়ার বলেছেন, "আমরা পরিষ্কার বলেছি যে, বাংলাদেশে সংবিধানের কথা বলে রাষ্ট্রের এই সংকট জিইয়ে রাখা হয়েছে। এই সংবিধানের অযুহাত দেওয়া উচিত নয়, কারণ গণঅভ্যুত্থাণ সংবিধান মেনে হয়নি, উপদেষ্টা পরিষদ সংবিধান মেনে হয়নি।"
তিনি বলেন, "আমরা উপদেষ্টা পরিষদকে বলবো, জাতীয় ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে আমরা যেমন সরকার গঠন করেছি, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে বিদায় করেছি– তেমনি রাষ্ট্রপতি ইস্যুকেও আমরা সমাধান করতে চাই। এটাকে কেন্দ্র করে জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হোক, সেটা আমরা কামনা করিনা।"
১২-দলীয় জোট: অন্যদিকে, গত রোববার নাগরিক কমিটির সাথে ১২-দলীয় জোটের বৈঠক শেষে জোটের মুখপাত্র শাহাদাত হোসেন সাংবাদিকদের জানান, এই মুহূর্তে রাষ্ট্রপতি পদে শূন্যতা হলে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হবে এবং বিলম্বিত হবে নির্বাচন। বৈঠকে তারা তাদের এ অবস্থানের কথা জানিয়েছেন।
বাম গণতান্ত্রিক জোট: বৈঠক শেষে বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক মাসুদ রানা বলেন, "রাষ্ট্রপতি অপসারণের বিষয়ে আমাদের নৈতিক আপত্তি নেই। কিন্তু এটার প্রক্রিয়া কী হবে, সাংবিধানিক ভিত্তি কতটুকু আছে— এ বিষয়গুলোতে আমাদের নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার বিষয় আছে। সংবিধান কিন্তু কোনো সরকারের না। আমরা সংবিধানকে অস্বীকার করিনা।"
তিনি বলেন, "আমরা সংবিধানের একটা ভিত্তি থাকা উচিত বলে মনে করি। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য দরকার এবং রাষ্ট্রপতি অপসারণের সাংবিধানিক ভিত্তি কতটুকু আছে, সেটাও দেখতে হবে।"
এ সময় বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের সহকারী সাধারণ সম্পাদক কমরেড রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, "এমন কোনো পথ আমরা এখনি নিতে চাইনা বা পারিনা যা নতুন কোনো ষড়যন্ত্রের পথ খুলে দিতে পারে। তাই সকল রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা করে একটা সাধারণ ঐকমত্য তৈরি করা উচিত। যাতে ফ্যাসিবাদ থেকে গণতন্ত্র উত্তরণে রোডম্যাপ তৈরি হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেন অন্তর্বর্তীকালীন ভূমিকাতেই থাকে।"
গণতন্ত্র মঞ্চ: এর আগে, ৬ দলের জোট গণতন্ত্র মঞ্চের সাথে বৈঠক শেষে জোটের সমন্বয়ক মাহমুদুর রহমান মান্না সাংবাদিকদের বলেছেন, "যেহেতু অপসারণের প্রশ্নে জটিলতার কথা এসেছে, সে কারণে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ঐকমত্য হতে হবে।"
জাতীয় নাগরিক কমিটি: যদিও জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, সবগুলো রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রপতি অপসারণের প্রশ্নে ঐকমত্যে এসেছে। তবে সেটি কী প্রক্রিয়ায় হবে, সে বিষয়ে দ্বিতীয় রাইন্ডে একটি আলোচনার কথা জানিয়েছেন তিনি।
বলেছেন, "আমড়া দ্বিতীয় রাউন্ডে আলোচনা শুরু করবো এবং এই রাউন্ডের আগেই আমরা জনগণের কাছে যাবো। রাষ্ট্রপতিকে যেতেই হবে, এখন সেটা কী প্রক্রিয়ায় তা রাজনৈতিক দলগুলোকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ফ্যাসিবাদের কোনো অংশ আমরা এই রাষ্ট্রে বিদ্যমান দেখতে চাই না।"
রাজনৈতিক ঐকমত্যের প্রসঙ্গে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী জানান, এ বিষয়ে তারা সরকারের কাছে সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে একটি কাউন্সিল গঠনের পরামর্শ দেবেন। সেখানে ঐকমত্যের ভিত্তিতে কে কোন প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপতি হবেন, তা তারাই আলোচনা করে নির্ধারণ করবেন।
এদিকে নাগরিক কমিটির সদস্য আদীব আরিফ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এখন পর্যন্ত বিএনপি, জাময়াতে ইসলামী, ১২ দলীয় জোট, গণতন্ত্র মঞ্চের ৬ দল, বাম গণতান্ত্রিক জোটের ৬ দল, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদের দুই অংশ এবং ইসলামী আন্দোলনের সাথে আমদের বৈঠক হয়েছে। সবাই অপসারণ চায়, কিন্তু এক টেবিলে বসে। সবাই চাচ্ছে যেন রাজনৈতিক ঐকমত্য করা যায়।"